ইনসাইড ট্রেড

বাজারের হাল বেসামাল


প্রকাশ: 15/10/2021


Thumbnail

ভয়ঙ্কর ভাবে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্নবিত্তের মানুষ ছাড়িয়ে মধ্যম ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ঘরে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এখন। ধাপে ধাপে দাম বাড়তে থাকা সয়াবিন তেল, চাল, ডালের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, মুরগি, সবজি, ডিমসহ মাছের দাম। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামও বাড়তি। বাজারে গিয়ে কোনটা রেখে কোনটা কিনবেন, এই চিন্তায় বেসামাল অবস্থা ক্রেতাদের।  

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত ফয়সাল আহমেদ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাস করেন। পাশাপাশি চার বছর ধরে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসলেই তার চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে ওঠে এখন। তিনি বলেন, গত বছরের এপ্রিল মাসে আমার পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে আর হয়নি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ঠিকই বাড়ছে। এমন একটা কিছু নাই, যেইটা দুই মাস আগেও সেইম দাম ছিল। এমন পরিস্থিতি আর কোথাও আছে কি না, তা তার জানা নেই বলেও এসময় জানান তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক জানান, সরকারি টিসিবির ট্রাকের অপেক্ষায় থাকেন তিনি। সেখান থেকে নিত্যপণ্য কিনে বাসায় ফেরেন। বাজারের যা দাম, তাতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। প্রতিষ্ঠান খোলা হলেও করোনা প্রভাবে অভিভাবকরা যে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, তাতে ছাত্র পাওয়াই দুষ্কর। এ দিকে আমার পরিবারেও আমরা চার জন সদস্য। দুই বছর ধরে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যে বাড়ছেই সংসারের ব্যয়।

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সবজি বাজার ও দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিনির দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, ময়দার দাম বেড়েছে ৮ থেকে ১২ শতাংশ, পেঁয়াজের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ এবং ডিমের দাম ডজনে বেড়েছে প্রায় ১০ টাকা। ৫০ টাকার উপরে বেশিরভাগ সবজির দাম। মুরগির দামও উর্ধ্বমূখী। এগুলো দাম বাড়ার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এর সঙ্গে বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দামও। যেমন মাস তিনেক আগে বাজারে ১০০ গ্রাম ওজনের যে সাবানটি বিক্রি হতো ৩৫ টাকায়, সে সাবানটি এখন ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বেড়েছে ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, নারকেল তেল, শৌচাগারে ব্যবহার করা টিস্যুসহ বিভিন্ন পণ্যের দামও। সুপরিচিত ব্র্যান্ডের এক প্যাকেট টিস্যুর দাম যেখানে ছিল ১৭ টাকা, তা এখন ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। 

বাজারে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ১২০ থেকে ১৪০ টাকা দিয়ে শীতের আগাম সবজি শিম কিনতে হচ্ছে। গাজার বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় এবং কেজি প্রতি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়। ঢেঁড়স ও পটল কেজি প্রতি ৫০ থেকে ৬০টাকা, করলা ৬০ থেকে ৮০ টাকা, ঝিঙে ৬০ থেকে ৭০ টাকা, বরবটি ৮০ থেকে ৯০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

একই ভাবে কাঁচা মরিচের দাম ৭০ টাকা থেকে বেড়ে কেজিতে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এখন। এ ছাড়া গরুর মাংসের দাম স্থিতিশীল থাকলেও বয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৮০ টাকায়। এক মাস আগেও বয়লার মুরগির দাম কেজি প্রতি ১২০ থেকে ১২৫ টাকা ছিল। ফার্মের মুরগির এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। আর খুচরা দোকানে এক পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১০-১১ টাকায়। চলতি মাসের শুরুতে এক ডজন ডিম ৯০-৯৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছিল।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এমনিতেই সেপ্টেম্বর অক্টোবরে সাধারণত সবজির সরবরাহ কম থাকে। কয়দিন পর থেকে শীতের সবজি আসবে। এর সঙ্গে এবার অনেক জায়গায় বন্যাও হয়েছে। বন্যায় অনেক সবজি ক্ষেত ও মুরগির ফার্ম নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে সবজি ও মুরগির দাম একটু বেশি বলে জানান তারা।

মোহাম্মপদপুর টাউনহল বাজারের সবজি ব্যবসায়ী মো. আলী জানান, টমেটো থেকে শুরু করে পেঁয়াজ, সবই আসে ভারত থেকে। এখন চলছে পূজা। টপ করে দাম বাড়িয়ে দেয়। আমরা কিনি পাইকার থেকে। এর থেকে দুই চার টাকা যাই লাভ করি, তা দিয়া বউ-বাচ্চা লইয়া বাইঁচা আছি। এখন একদিকে যেমন বেচা কেনা কম, অন্যদিকে সংসারের খরচ বাড়ছেই।

চিটাগাং বয়লার হাউজের মালিক সাইফুল ইসলাম জানান, জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় ব্যবসা ডাউন। কাস্টমার নাই। সকাল সাড়ে সাতটায় দোকান খুলছি, এখন বাজে ১২টা, মাত্র একজন কাস্টমার পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, রুই মাছ ২৮০-৩৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মৃগেল ২৪০ থেকে ২৮০, তেলাপিয়া ১৬০ থেকে ১৮০, পাবদা ৪৫০ থেকে ৫০০ ও পাঙ্গাশ ১২০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আগের মতোই বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ। বড় (এক কেজির উপরে) ইলিশের কেজি ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা। মাঝারি আকারের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি। আর ছোটগুলো ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে সপ্তাহের ব্যবধানে ইলিশের দাম অপরিবর্তিতই রয়েছে বলা যায়।

চাল ও পণ্যসামগ্রীর বাজার ঘুরে জানা যায়, এক কেজি চালের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এগুলোর মধ্যে মিনিকেট ৬০ টাকা, নাজিরশাইল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা ও স্বর্ণা চাল ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন তেল এক মাস আগে ১৪৫ টাকা লিটারে কেনা গেলেও ভোক্তাকে এখন আরও ৫ টাকা বেশি খরচ করে ১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এদিকে, বাজারে দেশি পেঁয়াজ এখন ৭০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগে এই দাম ছিল যথাক্রমে ৪৫ টাকা ৩৮ টাকা। মাসের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ২৫ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ কেজিতে ২৭ টাকা বেড়েছে। তবে দোকানিদের তথ্য অনুযায়ী, স্থির আছে ডাল ও চিনির দাম। এখন দেশি ডাল ১১০ টাকা, ভারতীয় ৯০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন যে, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি বিধায় এখানেও তার প্রভাব পড়েছে। তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তার বলছেন, এখানকার বাজারের অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দামের অজুহাতে অনেক পণ্যে টাকা বেশি নিচ্ছে। আর এ টাকা, আমার, আপনার, আমাদের সবার টাকা। তবে অনেক বাজার বিশ্লেষক এবারের দাম বাড়ার পেছনে করোনাকালে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া, উৎপাদন কমে যাওয়া, জ্বালানি তেলের দাম ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন দেশের মজুতপ্রবণতাকে দায়ী করছেন। 

টিসিবি লাইনে গরীব থেকে মধ্যবিত্ত

করোনা যখন জীবনকে নানাভাবে বিব্রত করছে, ঠিক সেই সময় নিম্নআয়ের মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। টিসিবির ডিলারদের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে চিনি, মসুর ডাল ও বোতলজাত সয়াবিন ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। পণ্য নেওয়ার লাইনে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি অনেক মধ্যবিত্তও দাঁড়াচ্ছেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে লাইনে দাঁড়ানো একজন উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, সরকার বলছে যে, জিনিসপাতির দাম বাড়লেও দেশে মঙ্গা অবস্থা সৃষ্টি হয় নাই। তাহলে সরকার কি চাইছে দেশে মঙ্গার কবলে পড়ুক, তারপর সব দেখবে। রাগে ফেটে পড়েন তিনি। তিনি বলেন, পেটে ভাত থাকলে উন্নয়ন দেখতে ভালো লাগে। একদিকে পেটে নাই ভাত, অন্যদিকে মন্ত্রী বলে যে, দু-এক মাসের মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা নাই। পরে দেখা গেল মন্ত্রীর কথায় আশকারা পেয়ে দাম আরো বাড়িয়ে দিল ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা কিভাবে পণ্যের দাম বাড়ায়, জানতে চাইলে বাজার বিশ্লেষকরা জানান, দেশে এবার বোরোতে বাম্পার ফলন হয়েছে। এরপরও দাম বেড়েছে চালের। এর কারণ হচ্ছে বাজারে ধান অপর্যাপ্ত। তাহলে এতো ধান গেল কোথায়। ধান চলে গেছে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের হাতে। ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের হাতে। এ কারণে গত এক-দেড় বছর ধরে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এরপর ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অজুহাত দেয়া হচ্ছে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি। বিশ্ববাজারে দাম যে হারে বেড়েছে তার চেয়েও বেশি বাড়ানো হয়েছে দেশের বাজারে। এখানেও অনৈতিকভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাধারণ মানুষ মনে করে, উন্নয়ন তো অবশ্যই দরকার। কিন্তু বেঁচে-থাকাটা তার চেয়ে বেশি জরুরি। মানুষ যদি অভাবে থাকে, মানুষ যদি ঠিকঠাক মত বাজার-সদাই করতে না পারে, তাহলে উন্নয়ন তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। সেরকম পরিস্থিতির দিকে দেশ যেন না যায়, সেজন্য এখনই সবাইকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে হবে সরকারকে, তা যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে। তা না হলে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের যে আবেদন তা জনগণের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়তে পারে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭