ইনসাইড পলিটিক্স

বাম দলগুলো সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে নীরব থাকে কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/10/2021


Thumbnail

দেশের বামপন্থীরা একটা সময় প্রচার করতো যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জাদুকাঠিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তাবৎ সমস্যা মিটিয়ে ফেলেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), এবং এই ধারাবাহিকতায় দেশে যদি সমাজতন্ত্র কায়েম হয়, তবে আর সাম্প্রদায়িক সমস্যা কিছুই থাকবে না । কিন্তু পরে, পৃথিবীর গোলকায়নের ফলে প্রমাণিত হয় যে, তার মধ্যে বিশেষ সত্যতা ছিল না। এটা ছিল বামপন্থী কর্তৃক ডাহা মিথ্যা কথা প্রচার। সব দেশের মতো রাশিয়াতেও সংখ্যালঘুরা নানা ধরণের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এবং সামাজিক ভয়ভীতির মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সেই চল্লিশের দশক থেকে এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের ছড়াছড়ি চলছেই! ধীরে ধীরে ক্ষয় হওয়া বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রদায়িক কোনো ইস্যুতে এখন আর কথা বলছেন না। বললেও যেটুকু না বলে আর পারা যায় না সেটিুকু বলছেন। নীরব থাকছেন। বিষয়টি বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে বলে মনে করছেন অনেকেই।

বাংলাদেশে হিন্দু সমাজের তথা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কথা আলোচনা করার সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্বাভাবিকভাবেই নির্যাতিত হয়ে থাকেন, এ কথাটি মনে রেখেই অগ্রসর হওয়া দরকার। সম্প্রতি কুমিল্লায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজার একটি অস্থায়ী মণ্ডপে কোরআন শরীফ রাখাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লাসহ সারাদেশে অনেকগুলো মণ্ডপে হামলা চালায় ও নির্যাতন করে একটি কায়েমি গোষ্ঠী। এ ঘটনায় ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগ তীব্র প্রতিবাদ ও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলে। বিএনপির অন্তরে যাই থাক, মুখে প্রতিবাদ করেছে, যদিও দোষ ক্ষমতাসীনদের ঘাড়ে তথ্য, প্রমাণ ছাড়াই দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যাদের সবচেয়ে বেশি সামনের সারিতে থাকার কথা ছিল, যারা কথায় কথায় সমাজ বদলাতে চায়, সেইসব প্রগতিশীল দলগুলো কোনো এক দৈব কারণে চুপটি মেরে বসে আছেন। এবং এটি শুধু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নয়, অনেকদিন ধরেই সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে তারা কথা বলছেন না। পিন পতন নীরবতা চলছে তাদের। এর আগে, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করেই। সেখানেও কোনো সক্রিয়তা ছিল না বাম শিবিরের। এরও আগে, ২০১২ সালের শেষ দিকে ফেসবুকে কথিত কুরআন অবমাননার ছবি ছড়িয়ে তাণ্ডব চালানো হয় কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধ বস্তিতে। সে সময় ১২টি বৌদ্ধমন্দির এবং বৌদ্ধদের ৩০টি বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। সেখানেও সহমর্মিতা জানাতে ভুলে গেছে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা লাল শিবিরের দলগুলো। তবে যদি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বা প্রেস রিলিজকে সক্রিয়তা ধরা হয়, তবে হাতে গোনা কয়েকটি বাম দলের আছে। কিন্তু এর তীব্র প্রতিবাদ করা, এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া, মাঠে নেমে ঐসকল মৌলবাদীদের প্রতিহত করা, প্রতিরোধ করা, এসব কিছুতে একটি বাম দলও নেই। বাম গণতান্ত্রিক জোট, জাসদ, বাসদ, ন্যাপ, ওয়ার্কাস পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, সবাই নিজ নিজ তল্পিতল্পা নিয়ে ব্যস্ত। দেশে যে একটা কিছু হয়েছে, তা ইনু-মেননদের সক্রিয়তা দেখে বুঝার জো নেই। সমাজে সংখ্যালঘু, অমুসলমান জনগোষ্ঠীর নানা আবেদন-নিবেদন অনেকদিন ধরেই অগ্রাহ্য করে আসছে এই বামদলগুলো।

`বাম` কি `ইসলাম` রাজনীতির পথে 

কিছু দিন আগে পশ্চিম বঙ্গের কয়েকটি এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছিলেন। পুলিশসহ আহত হয়েছেন আরো অনেকে। পরে জানা গেল `এটা ছিল রাজনীতির ব্যাপার।` বাম দল `তৃণমূল কংগ্রেস` বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রামনবমীর মিছিল করেছে। প্রগতির কথা দূরে রেখে ভোটের রাজনীতিতে ধর্মকেই বড় করে দেখেছে দলটি। এর সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে আমাদের দেশের বাম দলগুলোর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমে ছিল কয়েকটি বাম দল। ফলে বাম দলগুলো ভোটের রাজনীতিকে আদর্শ থেকে বড় করে দেখে ধর্মের রাজনীতির দিকেও ঝুঁকতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, একটা বাম দল যখন বলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রে ইসলামের একটি `স্পেস` জরুরি, এবং সেই `স্পেস` দেয়ার দাবি তুলেন, তখন বুঝতে হবে যে দলটি তার আদর্শ ভূলুণ্ঠিত করছে। দলটি তখন সত্য-অসত্যের মিশ্রণে একটি ধোঁয়াটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সত্য হলো এই যে, শুধু রাজনীতি ও রাষ্ট্রে কেবল নয়, পরিবার এবং সমাজেও ইসলাম দোর্দণ্ড প্রতাপে উপস্থিত আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

তারা বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ইসলামের প্রভাবে প্রভাবাধীন। আমাদের রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম। এটি সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে। বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টিসহ সমমনা দলগুলো সব সময়ই এর পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। আর এখন এদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে বাম দলগুলো। তারা একসময় বিপ্লব করে সমাজটাকে বদলানোর কথা বলতেন, এখনো বলেন। তারা মুখে একটি বারের জন্যও বলেন না যে, আমাদের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ গোটা রাষ্ট্রে ইসলাম ধর্মেরই জয়জয়কার। ফলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ধর্মের `স্পেস` ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। সমস্যাটি বাড়তে বাড়তে এখন তিলে তিলে তিলোত্তমায় পরিণত হয়েছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সাম্প্রদায়িকতা থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারি প্রশ্নে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে বলেছেন যে, সাম্প্রদায়িকতাকে দূর করতে হলে বঙ্গবন্ধু যেই চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংবিধানে যেটি বলা হয়েছিল, ধর্মের নামে কোনো রাজনীতি চলবে না। এখানে ধর্মের নামে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ৭২ এর সংবিধানে ফিরে না যাওয়া ছাড়া এটা করা যাবে না। নির্মূল কমিটি ৩০ বছর ধরে এটা নিয়েই আন্দোলন করে আসছি বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ সম্প্রীতির ইতিহাস হাজার বছরের। বাম দলগুলোর ভোট কম আমরা জানি। তাই বলে মৌলবাদীদের ভোট পাওয়ার জন্য সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে কথা বলবে না, আদর্শের বিচ্যুতি ঘটাবে, এটি মেনে নেয়া যায় না। আজ কার্ল মার্ক্স বেঁচে থাকলে বামদলগুলোর সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে এ ধরণের নির্লজ্জ নিষ্ক্রিয়তা দেখলে তিনি নিশ্চিত বলতেন যে, এই দলগুলো যদি বাম দল হয়, তবে আমি আর যাই হই, বামপন্থী না!



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭