ইনসাইড থট

চাই ইতিবাচক খবর, চাই ইতিবাচক গণমাধ্যম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/11/2017


Thumbnail

গৃহবধু রেশমা খবরের কাগজ পড়েন না,দেখেন না বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন চ্যানেলও। কেন? কারণ ভালো লাগেনা, এমনিই সারাদিন বিভিন্ন চাপে আর নাগরিক যন্ত্রণায় থাকেন তাই এই সব গণমাধ্যমে ছাপানো আর প্রচারিত নেতিবাচক খবর তাঁকে আর টানেনা। ছন্দা একটি বেসরকারি টেলিভিশনে চাকরি করেন কিন্তু তার খবর পড়াটা অনেকটা তেতো ঔষধ গেলার মতোই। আগ্রহ পাননা তিনিও, কেন সকালটা আমার শুরুই করতে হবে নেতিবাচক খবর পড়ার মধ্য দিয়ে? ভালো কি একটি সংবাদও আমাদেও প্রতিদিন ঘটে না?

 নিউজ এডিটর বলেন যত খুন, হত্যা, নিপীড়ন এর খবর তত রমরমা আর গরম খবর! বেশ ক্ষোভ নিয়েই বললেন এক রিপোর্টার রমরমা খবর প্রচারের পর কিন্তু ফলোআপ শূন্যর কোঠায়! অথচ একজন রিপোর্টার হিসেবে একটি ধর্ষণ বা খুনের রিপোর্ট করেই তিনি ক্ষান্ত হন না বরং তার ইচ্ছা থাকে শেষ পর্যন্ত কেসটা নিয়ে কাজ করা কিন্তু মজার বিষয় হলো এই ইচ্ছাটা তার থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর সেই রিপোর্ট নিয়ে তার ফলোআপ হয়না !কেননা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হয়তো তখন অন্য কোনো গরম খবরের জন্য তাকেই মনোনীত করেছেন।একটা বিষয় একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবেই দীর্ঘ ১২ বছর জানার চেষ্টা করেছি ইতিবাচক খবর কেনও বিশেষ পাতার জন্য? কেন সেগুলো অন্য বাংলাদেশ বা আলোর পথের দিশারী নামে বিশেষ রিপোর্টেই বিশেষ দিনে ছাপানোর জন্য? কেনও স্থাপত্যে আর্কেশিয়া অ্যাওয়ার্ড বা সোলার প্যানেল নিয়ে এক বাংলাদেশির উদ্যোগকে বিশেষ পাতায় স্থান দেওয়া হয় প্রথম পাতায় নয়?কিছু পত্রিকা ইতিবাচক খবরের জন্য আলাদা দিন বেছে নিচ্ছেন এটাও একটি ভালো উদ্যগ আর তাই চয়নের মতো অনেক কিশোরই সেই বিশেষ দিনের জন্য অপেক্ষা করেন! তার মুঠোফোন আর ইন্টারনেটের মায়া ছেড়ে হয়তো কিছু সময়ের জন্য ডুব মারেন তারই বয়সী কোনও কিশোরের সফলতার গল্পে! প্রতিদিন পড়ে না পত্রিকা বা টিভি? আরে মাথা খারাপ! কি আছে আমার টিভিতে আমাদের জন্য দেখার?সেইতো খবর যেটা সকালে দেখাবে সেটাই সারাদিন চলবে আর না আছে আমাদের উপযোগী কিছু! কেন দূরন্ত টিভিতো এসেছে,দেখছোনা? সেটা কি আর আমার জন্য? আমার  ৫ বছরের ভাই অর্নবের জন্য! কি ভয়ংকর কথা! যে জেনারেশনটা হাল ধরবে একদিন এই দেশের তাদের জন্য নেই কোনও গণমাধ্যমে অনুষ্ঠান বা তাঁকে অনুপ্রাণীত করে এমন কোনো খবর! তথ্য প্রযুক্তিতে যুগে যেখানে একটা ক্লিকেই একটি কিশোরের সামনে খুলে যাবে হাজারটা জানালা সেখানে কার দায় পড়েছে নিরানন্দময় বস্তাপচা অনুষ্ঠান আর পুনপ্রচারিত একঘেয়ে খবরের জাবর শোনার?

একটি জাতি তৈরি হচ্ছে যারা জানেনা লালনের গানের মর্ম,জানেনা নিজের দেশের মাটির সোঁদা গন্ধ কেমন হয়! তারা জানে না জীবনকে অর্থবহ করে তোলার রঙ্গীন গল্প! এর দায় শুধুই পরিবার আর রাষ্ট্রের?গণমাধ্যমের নয়?বাসে ধর্ষণের ঘটনা,বা পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু হত্যার খবর যখন রগরগে করে উপস্থাপন হয় গণমাধ্যমে তখন একই সাথে তা উস্কে দেয় এক অপরাধপ্রবনতার বিকৃত সুপ্ত আকাঙ্খাকেও! আর তাই একই খবর ঘুরে ফিরে জায়গা করে নেয় আবারও গণমাধ্যমের পাতায়! পাঠক, একবার ভেবে দেখুন এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির দায় কি গণমাধ্যমের নয়? গণমাধ্যম কি নিপীড়নকামী মানুষগুলোকেই উস্কে দিচ্ছেনা? অথচ যে নিষ্ঠা নিয়ে এই নিপীড়ন বা হত্যার ঘটনাটি প্রচার করা হয় তার বিচার বা আইনসংক্রান্ত বিষয়গুলোর পরবর্তী ধাপগুলো কি ফলোআপ করা হয়?এখানে কি গণমাধ্যম দায়বদ্ধ নয়? গণমাধ্যম কি চাইলেই পারেনা এই নিপীড়নের স্বীকার মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে? তারা পারেনা এই ঘটনার আসামিদের সাজা প্রাপ্তির বিষয়টাও ফলাওভাবে প্রচার করতে? তাতে অন্তত অন্য কেউ এই নিপীড়নের আগে সাজার কথা ভেবেই নিজেকে বিরত রাখতে পারে!গণমাধ্যমতো গণমানুষের কথাই বলবেন,সেটাইতো হওয়া উচিত,তাই নয় কি পাঠক?  কিন্তু বলছে কি কথা গণমাধ্যম গণমানুষের জন্য? সকালটা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভোরের গান না শোনাতে পারি কিন্তু শোনাতেতো পারি এমন কোনও সংবাদ যা তার সকালটাকে আলোময় করে তুলবে! মানুষ অনুকরণপ্রিয়,আর বাংলাদেশের মানুষের ধৈর্য ও রসবোধ অসাধারন!আর তাই ইতিবাচক কিছু খবর এর প্রভাব পড়বে এই গণমানুষের মনেও যেমন করে নেতিবাচক খবরের প্রভাব পড়ছে জনমনে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয় একজন মানুষকেই আর সেখানে একটি রাষ্ট্রের বা সমাজের জন্য গণমাধ্যম যখন বেশী করে ইতিবাচক খবর প্রচার করবেন তখন সেই প্রভাবই একদিন হয়তো তৈরি করবে ছোট্র একটি ভালো উদ্যেগের আর অনেকগুলো ছোট ছোট ভালো উদ্যেগ একসাথে হয়ে “না” বলবে একদিন এই দেশমাতার উপর নেমে আসা অনাচারগুলোকে!

গণমাধ্যমের  যে কি অপরিসীম ক্ষমতা সেটা আমি আমার ছোট একটি অভিজ্ঞতায় বলি, সাল ২০১২ সময় টিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রযোজক হিসেবে কাজ করছি।বার্তাপ্রধান তুষার আব্দুল্লাহ  বললেন, একটি নারীবিষয়ক অনুষ্ঠান নির্মান করতে হবে। অনেক গবেষণা ও মাঠপর্যায়ের কাজ শেষে সেই অনুষ্ঠানটির প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। এই অনুষ্ঠানটিতে নারীর অধিকার,ক্ষমতায়ন এবং সর্বোপরি নারীর অগ্রযাত্রাকেই গভীর মমতায় তুলে আনা হতো।  তো এই অনুষ্ঠানটিরই একটি শ্যুটিং এর কাজে মানিকগঞ্জের এক গ্রামে গেছে অনন্যা টিম। জানতে পারলাম ভ্যানচালক রহমতউল্লাহর ছয়টি মেয়ের প্রত্যেকেই মেধাবী কিন্তু ইভটিজিং এর কারণে তার চার মেয়েকেই বাল্যবিয়ে দিয়েছেন। বাকী দুজনও ইভটিজারদের ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। মজার বিষয় শুধুমাত্র ক্যামেরা তাদের  বাড়ি যাওয়ার কারণে এলাকার প্রভাবশালীমহল দাড়িয়ে গেলো এই হতদরিদ্র ভ্যানচালকের পাশে এবং যারা এই মেয়ে দুটিকে উত্যক্ত করতো তারাও পুলিশ আর এলাকার মানুষের হস্তক্ষেপে সাহস পেলোনা মেয়ে দুটিকে উত্যক্ত করার! কি করেছিলাম আমরা? মাত্র একটি রিপোর্ট করেছিলাম আর সেই রিপোর্ট পাল্টে দিলো দুটি মেয়ের জীবন! ২০১৪ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি নির্মাণের কাজ চলেছিল।তারপর আর এই অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার এগোয়নি। রানা প্লাজা বা তাজিন ফ্যাশন এর গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছিল গার্মেন্টসকর্মীদের উপর বিশেষ তথ্য চিত্র “পিঁপড়ার জীবন”,,যা প্রচারিত হওয়ার পর সেই মেয়েদের জন্য অনেকেই এগিয়ে এসেছেন ফোন করেছেন। বৃদ্ধাশ্রমের এক মায়ের গল্প দেখে সেই সুদুর আমেরিকা থেকে একজন ফোন করে জানান তিনি এই মাকে দত্তক নেবেন।কেউ শুনেছেন মাকে দত্তক নেয়ার কথা?  এরকম আরোও অনেক ইতিবাচক গল্প জন্ম দিয়েছিলো এই টেলিভিশন প্রযোজনাটি। হয়তো আমার মতো হাজারটার ইতিবাচক গল্প জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের আরো অনেক টিভি চ্যানেল।কিন্তু সেই ইতিবাচক খবরগুলোর কয়টা পৌছায় সাধারণ মানুষের কান অবধি।

গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তি বর্গ ভেবেই বসে আছেন নেতিবাচক খবরই পাবলিক খাবে বেশি আর তাই এই খবরগুলোই আগে দেওয়া দরকার কিন্তু এই ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্বটাও কিন্তু কাউকে না কাওকে নিতে হবে। জণগণকেও  উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন ইতিবাচক খবর দেখার ব্যাপারে। কেননা এই অস্থির সময়ে গণমাধ্যমের হস্তক্ষেপ আজ বিশেষ প্রয়োজন। শুধু ব্যবসায়িক মুনাফা নয় আজ গণমাধ্যম সামাজিকভাবেও দায়বদ্ধ তার ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে, দায়বদ্ধ গণমানুষের কাছে। খারাপ খবরের পাশাপাশি ভালো খবরগুলোও পৌঁছে দিতে হবে সাধারণ মানুষের দ্বারে।  আর এই কাজটি গণমাধ্যম যত সুন্দর পারবে সেটা আর কোনও মাধ্যমেই সম্ভব নয়। হাতের ফোনে গান,খবর যাই দেখা হোক না কেনও দিনশুরুতে এক কাপ চায়ের সাথে খবরের কাগজ বা অনলাইনে পত্রিকাটি যেমন চোখ বুলিয়ে নিই ঠিক তেমনি দিনশেষে আমার টেলিভিশনে সুইচটিও অন করি। তাই এই দুটো মাধ্যমেই যত বেশি মানুষের কাছে পৌছানো যাবে তেমনটি আর কোথাও নয়! আর তাই যত বেশী একটি ইতিবাচক বিষয়গুলোকে এই মাধ্যমে তুলে ধরতে পারবো, ততবেশী এক ইতিবাচক মেধাবী বাংলাদেশ এর জন্য কয়েকধাপ এগিয়ে যাবো আমরা। নিপীড়ন বা শিশুহত্যার খবর নয় বরং কলসুন্দর বা রাঙ্গাটুঙ্গির  সোনার মেয়েদের মাঠ দাপানোর খবরটাও দেখতে চাই প্রথম পৃষ্ঠায়। আমি আন্তরিক ভাবেই বিশ্বাস করি গণমাধ্যমে কর্মরত প্রত্যেকেই শুধুই চাকরী বা জীবনধারনের জন্য এই পেশা বেছে নেননি বরং এই প্রতিটি মানুষই দিনশেষে স্বপ্ন দেখেন এক ইতিবাচক বাংলাদেশের আর তাই এই ইতিবাচক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের গণমাধ্যমকেও ইতিবাচক খবর প্রচারে আরোও অনেক বেশী আন্তরিক হতে হবে, আন্তরিক হতে হবে গণমানুষের জন্য তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে,তাদের জন্য তাদের উপযোগী অনুষ্ঠানমালা নির্মান ও প্রচারের উদ্যেগ নিতে হবে।

যদি সুন্দর দেখে এই চোখ তবেই তো অনুভবেও চর্চা হবে সুন্দরের, সুন্দর হবে মানুষের মন, সম্পর্ক, প্রকৃতি, সমাজ…

সুন্দর হবে আমার প্রিয় বাংলাদেশ।


আফরোজা চৈতী
কলামিস্ট, লেখক
 
বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭