ইনসাইড বাংলাদেশ

‘আমরা কোথায় থাকব, কী করব, কী খাব?’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 18/10/2021


Thumbnail

পূজা মণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনার রেশ না কাটতেই এবার রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড়করিমপুর গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। আগুন দেবার ঘটনার পর গ্রামের সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। গ্রামটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা।  আগুনে পুড়ে গেছে ২১টি বাড়ি। 

আজ সোমবার (১৮ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত এ ঘটনায় অন্তত ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাশের মাঝিপাড়া গ্রামের পরিতোষ রায় নামের এক তরুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছেন, এমন অভিযোগ তুলে একদল লোক সেখানে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করেন। ঘটনা আঁচ করতে পেরে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে পুলিশ মাঝিপাড়া গ্রামের পরিতোষের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে নিরাপত্তা দেয়। তখন উত্তেজিত শত শত লোক ওই গ্রামের পাশের বড়করিমপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে বসতবাড়িতে ঢুকে দুর্বৃত্তরা গ্রামজুড়ে তাণ্ডব চালায়। এ সময় তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে মারধর করে, হুমকি দেয়, অকথ্য ও আপত্তিকর ভাষায় গালাগাল করে। প্রাণ বাঁচাতে নারী, পুরুষ ও শিশুরা বাড়ি ছেড়ে পাশের ধানখেতে আশ্রয় নেয়। দুর্বৃত্তরা তখন একের পর এক বাড়ি আগুন ধরিয়ে দেয়। 

প্রশাসনের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা গ্রামের বসতবাড়িতে ঢুকে অন্তত আধা ঘণ্টা ধরে তাণ্ডবলীলা চালালেও পুলিশের ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল না। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর পুলিশ গ্রামে গেলে ধানখেতে আশ্রয় নেওয়া লোকজন বাড়িতে ফেরেন।

প্রদীপ চন্দ্র বলেন, রাতে শত শত মানুষ ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এ সময় দুজন তাকে মারধর করলে তিনি দৌড়ে কোনো মতে রক্ষা পান। পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভয়ে বাড়ি থেকে চলে যান। হামলাকারীরা ঘরে থাকা ২৫ হাজার টাকা, টিভি ও একটি গরু নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

তারা রাণী নামে আরেকজন জানান, তার চারটি টিনের ঘর, ধান-চাল ও আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়েছে। তারা রাণী আহাজারি করে বলছিলেন, ভগবান, আমরা কী দোষ করছিলাম? কেন আমাদের সব শেষ করে দিল। এখন আমরা কোথায় থাকব, কী করব, কী খাব?

তারা রাণীর সঙ্গে উপস্থিত থাকা ননী গোপাল জানান, তিনি ঘটনার সময় বাড়ি সংলগ্ন রাধা-গোবিন্দ মন্দিরে পূজা করছিলেন। হঠাৎ শত শত লোক দল বেঁধে বাড়িতে ও মন্দিরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করে নিয়ে যায় গরু ও স্বর্ণালংকার। পরনের কাপড় ছাড়া সব পুড়ে গেছে। থানায় ফোন করলেও পুলিশের সহযোগিতা পাননি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

গ্রামের বাসিন্দা ক্ষুব্ধ শিরীষ চন্দ্র রায় বলেন, পুলিশ এসেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সবকিছু শেষ হওয়ার অনেক পরে। এখন গ্রাম পুলিশে ঠাসা। লাভ কী!

ওই গ্রামের বাসিন্দা রাসেল মিয়া (৩৫) ঘটনার অভিন্ন বর্ণনা দিয়ে বলেন, হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও আগুন লাগানোর ঘটনা মর্মান্তিক। এমন নিষ্ঠুরতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

পূর্ণিমা রাণী নামে আক্রান্ত একজন জানান , হামলাকারীরা বাড়িতে ঢুকে তার দুই তরুণী মেয়ে কোথায়, জানতে চায়। ঘরে ঢুকে ভাঙচুর করে ৫০ হাজার টাকা ও একটি গরু নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। 

গ্রামের নিরঞ্জন রায় বলেন, ১৫টি পরিবারের ২১টি বসতঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। গ্রামের অন্তত ৫০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। হামলাকারীরা অন্তত ২৫টি গরু ও ১০টি ছাগল নিয়ে গেছে।

পাশের মাঝিপাড়া গ্রামের পরিতোষ রায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তালা ঝুলছে। পাশে বসে আছে অস্ত্রধারী পুলিশ সদস্যরা। এই গ্রামের পুলিন চন্দ্র বলেন, পরিতোষ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা গতকাল সন্ধ্যার পর বাড়িতে তালা লাগিয়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেছেন।

রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার আজ সকালে ঘটনাস্থলে যান। তিনি বলেন, হামলাকারীদের কোনো ছাড় নেই। তারা হানাদার বাহিনীর মতো বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭