ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

কেনো থামছে না ইয়েমেনের মৃত্যুযজ্ঞ?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/10/2021


Thumbnail

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে প্রায় ছয় বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। গৃহযুদ্ধে দেশটি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত দুদিনেই সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের একাধিক বিমান হামলায় ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতির অন্তত ৪০০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। এর আগে গত কয়েক বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কেন ইয়েমেনে দিনের পর দিন ধরে চলছে এই যুদ্ধ? আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোই বা কেন উচ্চবাচ্য করছে না? 

ইয়েমেনের লড়াইয়ের শুরুটা হয় আরব বসন্ত দিয়ে। ২০১১ সালে প্রবল বিক্ষোভের মুখে দেশটির দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহকে তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাদিকে অনেকগুলো সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। আগের প্রেসিডেন্টের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আনুগত্য ছিল বিব্রতকর। দুর্নীতি, খাদ্যাভাব ও বেকারত্বের উচ্চ হারের মতো বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে ইয়েমেন। 

এরই মধ্যে শিয়া ধর্মাবলম্বী হুতিরা নতুন করে বিদ্রোহ শুরু করে। নতুন প্রেসিডেন্ট হাদির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উত্তর ইয়েমেনের সাদা প্রদেশ এবং এর আশপাশের এলাকা দখল করে নেয় হুতিরা। এরপর তারা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। তাদের পেছনে ইরান সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে হাদি দেশের বাইরে পালিয়ে যান। কিন্তু হাদিকে ফের ক্ষমতায় আনতে সৌদি আরব আর অন্য আটটি সুন্নি দেশ একজোট হয়ে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে। এই জোটকে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ শুরু করে। আবদ রাব্বু মনসুর হাদির সমর্থনে এই বিমান হামলা শুরু হয়। নির্বাসনে থেকেই ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হাদি এই অভিযানে সমর্থন দেন। হুতি বিদ্রোহীদের ইরান সমর্থন দিচ্ছে বলে বিশ্বাস করে সৌদি আরব। কারণ ইরান ও হুতি বিদ্রোহী দুই পক্ষই শিয়া ধর্মাবলম্বী। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে সৌদিকে। কারণ ইরান, রাশিয়া ও চীনকে মধ্যপ্রাচ্যে ঠেকাতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র। মনে করা হয়, ইয়েমেনের যুদ্ধের আড়ালে আদতে লড়াই চলছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ওদিকে সৌদি আরব ও ইরানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা।

ইয়েমেনে চলা গৃহযুদ্ধ আরব বিশ্বে অস্থিরতার অন্যতম প্রধান কারণ। দেশটিতে চলা সংঘাত-সহিংসতার কারণে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এখান থেকেই পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালানোর নীল নকশা হচ্ছে। তাই ইয়েমেনের যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বের জন্যও হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

এছাড়াও দরিদ্র দেশ ইয়েমেনের সংকট নিয়ে হেভিওয়েট রাষ্ট্রগুলোর আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ হল এডেন উপসাগর। লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মাঝখানে দেশটির অবস্থান। এই নৌপথ দিয়েই বিশ্বের সিংহভাগ তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে। তাই ইয়েমেন যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তার পক্ষে তেলসম্পদের ওপর খবরদারি করাও সহজ হবে। ঠিক এই কৌশলগত কারণেই ইয়েমেন সবার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইয়েমেন সংকটের আরেকটি অলিখিত কারণ হলো ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের অংশগ্রহণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে। সৌদি আরব হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। তাছাড়া বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্যবাদ আবর্তিত হয় সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকও সৌদি আরব। ফলে, নিজেদের আধিপত্যবাদ বজায় রাখতেই ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

যেকোনো সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো। ইয়েমেনে চলা বর্তমান সংকটকে জাতিসংঘ আখ্যায়িত করেছে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট হিসেবে। হাজারো বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু, শিশুদের চরম অপুষ্টিতে ভোগা, আর জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর সংকটে ইয়েমেনিদের জন্য প্রয়োজন ছিল সংকট সমাধানে বৈশ্বিক উদ্যোগ। তবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ যতদিন সবগুলো পক্ষকে লাভবান করবে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ততদিন পর্যন্ত সংকট সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা কম।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭