ইনসাইড টক

‘আমরা ধর্মপরায়ণ হতে চাই, ধর্মান্ধ নয়’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/10/2021


Thumbnail

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, এটা অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই করা হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ হচ্ছে যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতিতে যারা ঈর্ষান্বিত, যারা এই সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বার বার বলে আসছে, তাদেরই কোনো পরিকল্পিত ঘটনা বলেই মনে হয়। না হলে, ঘটনা যেটা ঘটেছে, কুমিল্লার মন্দিরের ওখানে আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ কোনো দেবীর কাছে রাখা, কোনো পাগলও এটা করার কথা না। 

সম্প্রতি কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা, মন্দিরে হামলা ঘটনা নিয়ে বাংলা ইনসাইডারের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন মাহবুবউল আলম হানিফ। 

তিনি বলেন, এ দেশে সাধারণত দেখা যায়, যারা সংখ্যালঘু, বা সনাতন ধর্মের যে মানুষ আছে, তারা এমনিতেই ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। বেশ কয়েকটি ঘটনা যেটি আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রে ইতিপূর্বে বার বার এ ধরণের সহিংসতা ঘটেছে। সেই কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবসময়ই শঙ্কার মধ্যে থাকে, আতঙ্কের মধ্যে থাকে। তারা কোরআন শরীফ তাদের দেবীর পায়ের কাছে বা নিচে রেখে কেন এই বিপদ ডেকে আনবে? এটাতো আসলে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে যারা এই কাজটি করেছে তারা পরিকল্পিত ভাবেই দেশটাকে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করার জন্যই করেছে। 

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় প্রশাসনের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছুটা দুর্বলতা পরিলক্ষিত তো হচ্ছেই। বিশেষ করে রংপুরে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে যখন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, এবং এটা নাকি মাইকিং করে ওখানে জনসমাগম করা হয়। যখন মাইকিং করে জনসমাগম করা হয়, সেই সময় ওখানে শুধুমাত্র যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, তার বাড়িটাকেই নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের উচিত ছিল ওখানে এই জনসমাগমটা যাতে মুভ করতে না পারে সেজন্য আগে থেকেই ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া। সমাবেশে বাধা দেওয়া। কারণ একটা সমাবেশ হলে বা এই ধরণের একটা প্রতিবাদী মানুষের জমায়েত হলেই সেখানে দেখা যায় ওর ভেতর থেকে দুই একজন উশৃঙ্খল আচরণ করে। পরে দেখা যায়, সবাই ওই উশৃঙ্খলার মধ্যে গা ভাসায়। একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সেই সংঘাত থেকে প্রশাসনের উচিত ছিল এই ধরণের সমাবেশ করতে না দেওয়া, এই উত্তেজনামূহুর্ত সৃষ্টি করতে না দেওয়া। সেটা করে নাই। এটা আমি মনে করি যে, প্রশাসনের কিছুটা দুর্বলতা বলাই যেতে পারে। 

মাঠপ্রশাসনে বিএনপি-জামাতপন্থীদের সক্রিয়তা প্রশ্নে আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, এই মূহুর্তে এটা আসলে বলা মুশকিল। এই কারণে যে, যে সমস্ত এলাকাগুলোতে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেই ঘটনাগুলোর পরিপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ছাড়া এই ধরণের কথা বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য যে, আমাদের প্রশাসনের মধ্যে সব দলের আদর্শের অনুসারী কর্মকর্তারা আছে। তো আমাদের দুর্ভাগ্য এটা যে, সরকারে যখন একটা প্রশাসনের কর্মকর্তা, তারা যখন দায়িত্ব নেয়, সরকারি কর্মে যখন যোগদান করে, তখন তাদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে সকলের ঊর্ধ্বে, দল মতের ঊর্ধ্বে দেশের জন্য কাজ করা।  সেটা আমাদের এখানে খুব বেশি একটা পরিলক্ষিত হয় না। আমরা দেখি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে বিভিন্ন সরকারের সময় দলের প্রতি আনুগত্য যাদের আছে, তাদের আমরা বেশি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে দেখি। আর যারা দলের আনুগত্যের বাইরে বা যে দলকে সমর্থন করে না, সেই দল ক্ষমতায় থাকলে, সেই দল বা সরকারের কর্মকাণ্ডে ক্ষতি করা বা দুর্বল করে দেওয়া বা ধীর গতি করে দেওয়ার একটা মানসিকতা পরিলক্ষিত হয়। সেই ক্ষেত্রে আমাদের এখানে প্রশাসনের মধ্যে যে অন্য দলের আদর্শের অনুসারী যারা আছে, বিএনপি, জামাত বা অন্য দলগুলোর যারা আছেন, তাদের মধ্যে সবসময় তো একটা চিন্তা ধারা থাকেই যে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতা থেকে চলে গেলে তারা স্বস্তি বোধ করে। তারা আদর্শিকভাবে তারা তৃপ্তি বোধ করে। তো সেটার জন্য তাদের কিছু কর্মকাণ্ড এর সঙ্গে জড়িত থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান মোকাবেলার জন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা কি প্রশ্নে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ এই মূহুর্তে আসলে যেটা করছি যে, মাঠ পর্যায়ে আমাদের দলের নেতা-কর্মীদেরকে সাধারণ মানুষকে নিয়ে মাঠে থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সাম্প্রদায়িক ঘটনার প্রতিবাদ করা এবং এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার করার জন্য প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। পাশাপাশি আমাদের মাঠে যাতে এই ধরণের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়েই এই সমস্ত অপশক্তিদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে করি যে, এটাই সমস্যা সমাধানের মূল পথ নয়। আমাদের আরো গভীরে যেতে হবে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়েই এই দেশে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরে যে, আমাদের সংবিধান পরিবর্তন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ বপন করেছিল, সেই বীজ কিন্তু আস্তে আস্তে বীজ থেকে গাছ হয়ে সেটা এরশাদের সময়ে লালন-পালন এবং পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার আমলে সেই পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এই সাম্প্রদায়িকতার শেকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। এটাকে আমরা ওঠাতে পারি নাই। 

তিনি এ অঞ্চলের সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, আমাদের এই দেশের হাজার বছরের একটা সংস্কৃতি ছিল। যেটা আমাদের সামাজিক বন্ধনের একটা মূল ভিত্তি ছিল। সে সংস্কৃতি ছিল আমাদের জারি-সারি গান, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, পুথিঁগান, যাত্রা, নাটক। এই যে সমাজের মধ্যে সংস্কৃতিক মাধ্যমে একটি বন্ধনে আবদ্ধ রাখতো। কিন্তু সেটা আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায়। উল্টা আমাদের দেশে এই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে একেবারে মানুষদেরকে ধর্মপরায়ণ থেকে ধর্মান্ধের দিকে নিয়ে গেছে। আমরা প্রত্যেকেই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা ধর্মপরায়ণ হতে চাই, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ধর্মান্ধ কোনো জাতির জন্য কখনো ভালো নয়। আমরা দেখেছি ৭১ সালেও ধর্মের দোহাই দিয়ে কিন্তু ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে নিয়ে আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাদেরকে অবস্থান নেওয়া এবং গণহত্যা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন করতেও কুণ্ঠাবোধ করে নাই। এমনকি এই ধর্মান্ধগোষ্ঠী আমাদের মা-বোন, তাদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। তো ধর্মান্ধতা সব সময়ই ক্ষতিকারক। আমাদের আজকের যে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, এই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একটা শ্রেণী একেবারেই ধর্মান্ধ হয়ে বেড়ে ওঠছে। সেটা আমাদের সমাজ, দেশের জন্য একটা বড় ক্ষতির কারণ ও হুমকির কারণ। 

মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে হানিফ বলেন, আমি মনে করি যে, আমাদের এখন এর গোঁড়ায় হাত দেওয়া উচিত। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এটাকে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করার প্রয়োজন, যাতে এখান থেকে এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে একেবারে ধর্মান্ধ টাইপ মানুষের সৃষ্টি না হয়। আমরা চাই, ধর্মপরায়ণ মানুষ সৃষ্টি হোক। তাদেরকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখে সমাজে কাজ করার মতো কর্মসংস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করার মাধ্যমে তাদেরকে ধর্মান্ধ লাইন থেকে সরিয়ে আনতে পারি। সমাজে এই পরিবর্তনটা যতক্ষণ না আনা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা ধর্মকে ব্যবহার করে এই ধরণের সন্ত্রাসী বা সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড করতে সাহস পাবে এবং সুযোগ থাকবেই বলেও মনে করেন তিনি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭