ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

অপারেশন গুলমার্গ ও কাশ্মীরের ইতিহাসের একটি কালো দিন


প্রকাশ: 22/10/2021


Thumbnail

সময় ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর। স্বাধীন রাজ্য কাশ্মীরের দখল নেওয়ার জন্য মেজর জেনারেল আকবর খানের নেতৃত্বে ‘অপারেশন গুলমার্গ’ নামে নৃশংস অভিযান পরিচালনা করে পাকিস্তান। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে উপজাতীয় জঙ্গিদের সেই আগ্রাসনের সময় হানাদারদের কাশ্মীরের লাখ লাখ হিন্দু-মুসলিম-শিখ রুখে দাঁড়িয়েছিল। হত্যা-ধর্ষণ আর বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছিল। বিসর্জন দিয়েছিল জানমাল। জীবন দিয়ে যারা সেই আগ্রাসন ব্যর্থ করে দেয়, তাদের স্মরণে কালো দিবস পালিত হয় কাশ্মীরে।

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন কাশ্মীরের মহারাজা ছিলেন হরি সিং। তিনি কাশ্মীরকে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২০-২১ অক্টোবরে, প্রায় ২০,০০০ উপজাতি মুজফফরাবাদ এবং অ্যাবোটাবাদ (বর্তমান, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর) -কে সংযুক্ত করা হাজারা সড়কের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নীলম নদীর উপর থাকা সেতু দখল করে এবং ২১ অক্টোবরের মধ্যে মুজাফফরাবাদ প্রথম প্রধান শহর দখল করে নেয়। প্রথমে তারা মুজাফফরাবাদে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছিল, বাজারে আগুন ধরিয়েছিল এবং লুটপাট চালিয়েছিল।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে, একজন প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, সেই সময় যেন ধ্বংসযজ্ঞের ছবি এঁকেছিল তারা। রাস্তাঘাট ভাঙা, ভবন এবং আসবাবপত্র, পোড়া জিনিসপত্রের ছাই এবং মৃতদেহ দিয়ে ভরে গিয়েছিল। নদীতে শত শত "লাশ ভাসছিল।" হানাদাররা তারপর উরি এবং বারামুল্লায় নেমে যায় যেখানে মৃত্যু এবং ধ্বংসের আরেকটি পর্ব চালানো হয়। বারামুল্লায় এই ঘটনা অনেকেই মনে রেখেছেন। বারামুল্লায় হাসপাতাল ও চার্চকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাকিস্তানি বাহিনী। ৩৫০ জন স্থানীয় হিন্দুকে একটি ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। বারামুলা আক্রান্তের ২৪ ঘণ্টা পরই ভারতীয় সেনা পৌঁছায় শহরে। কিন্তু তার আগেই শহরটির ১৪ হাজারের জনবসতি কমে দাঁড়ায় ১ হাজারে। পাকিস্তানি হানাদাররা শহরটাকেই জনমানবশূন্য করে তোলে।

এপির ফটোগ্রাফার ম্যাক্স ডসপটের বর্ণনা অনুযায়ী, ২ নভেম্বর ২০টির বেশি গ্রাম তিনি জ্বলতে দেখেছেন। বারামুলা থেকে ২০ মাইল দূরে শ্রীনগরে বসেও সেই ভয়ঙ্কর আগুন দেখা গেছে। হানাদাররা ব্যাপক সন্ত্রাস ও ধ্বংসপ্রক্রিয়া চালাতে চালাতেই শ্রীনগরের উদ্দেশে অগ্রসর হতে থাকে। আক্রমণকারীদের হাতে প্রাণ হারানো শহরের মানুষ ছাড়াও ৪ জন ইউরোপীয় নাগরিকও মারা গিয়েছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ আর্মি অফিসার কর্নেল ডিক এবং তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকেও কাশ্মীর দখল করার জন্য উন্মাদ জঙ্গিদের হাতে হত্যা করা হয়েছিল। ইসলামাবাদের নির্দেশে হানাদাররা শ্রীনগরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তারা বিশাল সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকার সিডনি স্মিথ ক্রাশের পরে ১০ দিনের জন্য বারামুল্লা হাসপাতালে ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি আগ্রাসনকারীদের সম্পর্কে প্রতিবেদনে ধ্বংসের চিত্রও এঁকেছিলেন লিখেছিলেন, পাহাড়ের চূড়া থেকে গুলি চালানোর সাথে সাথে তারা সমতলের দিকে এগিয়ে এল।

পাকিস্তানি বর্বরতার কারণে হিন্দু ও শিখরা পালাতে বাধ্য হয়েছিল। তারপরে তাদের বাড়িঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় সকল মহিলা অপহরণ বা ধর্ষণ করা হয়। প্রথমে আক্রমণকারীরা মুসলমানদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করেছিল। তবে দু-একদিন পরেই মুসলমানদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অত্যাচার শুরু হয়েছিল। সমস্ত হিন্দু-মুসলিম-শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা উপজাতিদের দ্বারা আক্রমণ করা হয়েছিল। তাদের সামনে যারা এসেছিল তাদের তিনি হত্যা করলো। কোনও শিশু, বৃদ্ধ মানুষ বা মহিলাকে বাঁচানো হয়নি। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রত্যেক মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে বলা যেতে পারে। অভিযানকারীরা সোনা-রূপা থেকে শুরু করে কাপড় পর্যন্ত সব লুট করে নিয়ে যায়। বারমুলার উজির-ই-ওয়াজত চৌধুরী ফয়জুল্লাহর বক্তব্য অনুসারে হামলাকারীরা ৩০ থেকে ৪০ জনের দলে হামলা করত। পনেরো হাজার হানাদার একই সাথে ধ্বংস প্রক্রিয়াতে নিযুক্ত হয়েছিল।

ভারতীয় সেনাবাহিনী শ্রীনগরে অবতরণ করার আগে হানাদার বাহিনী ও উপজাতিদের আক্রমণে প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীসহ সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল। তবে, বারামুল্লায় তারা অমানবিকতার সমস্ত নীতি অতিক্রম করেছিল। বারামুল্লা চার দিন ধরে লুট করা হয়েছিল। সেদিন থেকেই মূলত প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল আকবর খান, যিনি এই হামলার পরিচালনা করেছিলেন, পরে করাচিতে প্রকাশিত `রেইডারস ইন কাশ্মীর` বইয়ে তার কৃতিত্বের বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

জেনারেল আকবর খান ছাড়াও ‘অপারেশন গুলমার্গের’ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘনিষ্ঠ সহযোগী শওকত হায়াত খান। রাষ্ট্রীয়ভাবে সে সময় আক্রমণের তারিখ হিসেবে ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবরকে বেছে নেয়। শওকত খান তার ‘দ্য নেশন দ্যাট লস্ট ইট সোল’ বইয়ে স্বীকার করেছেন যে তাকে কাশ্মীর অভিযানের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়েছিল।

হানাদাররা যখন মিরপুর, মুজাফফরাবাদ, উরি এবং বারামুল্লা দখল করে নেয় তখন শ্রীনগরের আসন্ন পতন অবশ্যম্ভাবী দেখাচ্ছিল। আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে ২৪ অক্টোবর, মহারাজা হরি সিং আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য ভারতের কাছে সামরিক সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। তিনি শ্রীনগর হারানোর ভয় পেয়েছিলেন। ২৫ অক্টোবর মাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বে ভারতের প্রতিরক্ষা কমিটির বৈঠকে তার অনুরোধ বিবেচনা করা হয়েছিল এবং এতে জওহরলাল নেহেরু, সর্দার প্যাটেল, বলদেব সিং, বিনা পোর্টফোলিও মন্ত্রী গোপালস্বামী আয়ঙ্গার এবং সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীর ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে.কে. নন্দার বই `ওয়ার উইথ নো লাভ`-এ এই বৈঠক নিয়ে সিদ্ধান্তের কথায় উল্লেখ আছে, “সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হল কাশ্মীর সরকারের অনুরোধ বিবেচনা করা এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ ও সেনা দিয়ে সহযোগিতার জন্য ছুটে যাওয়া। যা শ্রীনগরের স্থানীয় জনগণকে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম করবে।"

প্রতিরক্ষা কমিটি ভি.পি. মেনন, সেক্রেটারি, রাজ্য মন্ত্রণালয়কে শ্রীনগরে পাঠায় একই দিনে "অন-দ্য-স্পট স্টাডি" করার জন্য। তিনি পরের দিন নয়াদিল্লিতে ফিরে আসেন, এবং কাশ্মীরে সেনা পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, "কাশ্মীরকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয়তা" নির্দেশ করে।

অধিগ্রহণের পর, ভারত লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেওয়ান রঞ্জিত রাইয়ের নেতৃত্বে সৈন্য ও সরঞ্জাম শ্রীনগরে পাঠায়। যেখানে তারা কাশ্মীরি বাহিনীকে শক্তিশালী করেছিল, প্রতিরক্ষা পরিধি স্থাপন করেছিল এবং শহরের উপকণ্ঠে (শালতেং) আক্রমণকারীদের পরাজিত করেছিল। বিমানবন্দরের কাছাকাছি বুদগামেও যুদ্ধ হয়েছিল। ৮ই নভেম্বরের মধ্যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী শ্রীনগর, ৯ই নভেম্বর বারামুল্লা এবং ১৩ নভেম্বরের মধ্যে উরি দখল করে নেয়। কাশ্মীর অঞ্চলে সহিংসতার চক্র শুরু হয়েছিল মুসলিম, শিখ এবং হিন্দু সহ হাজার হাজার কাশ্মীরিকে হত্যা করে। হাজার হাজার হিন্দু, শিখ নারী এই হামলার পর এখনও নিখোঁজ। 

উপত্যকায় সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং এর ভূমিকার প্রতিবাদে ভারত প্রতি বছর ২২ অক্টোবরকে `কালো দিবস` হিসেবে পালন করে। ২২ অক্টোবর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লুণ্ঠন এবং হিংস্রতা ‘জে এন্ড কে’-র মানুষকে হতবাক করে দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধারে আসে এবং হানাদারদের পিছনে ঠেলে দেয়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭