ইনসাইড পলিটিক্স

কোন পথে ছাত্রলীগ?


প্রকাশ: 25/10/2021


Thumbnail

২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে ‘ভূমিধ্বস বিজয়ের’ মাধ্যমে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এক যুগ ধরে দলটি ক্ষমতাসীন। এর আগে কোনো দলই এত বছর টানা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বিপরীতে দলটির অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলো বিশেষ করে ছাত্রলীগ পুরনো জৌলুস হারিয়ে নিত্য নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করছে।

সম্প্রতি রংপুর জেলার পীরগঞ্জের সহিংসতা ও সংখ্যালঘুদের পল্লীতে আগুন দেয়ার ঘটনার মূল হোতা হিসেবে সৈকত মণ্ডল নামে এক ছাত্রলীগ নেতার নাম এসেছে। এর আগেও সিলেটের এমসি কলেজে ধর্ষণসহ হরেক রকমের খারাপ কাজে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার কথা গণমাধ্যমে আসে। অনেকেই সন্দেহ করছেন, ছাত্রলীগের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী অনেক বছর ধরেই ঢুকছে। বিএনপি-জামাতপন্থীরা পোশাক বদলে, স্লোগান পাল্টে ছাত্রলীগে ভিড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতে ছাত্রলীগকে নিবিড় মনিটরিং ও নার্সিং করার বিকল্প নেই বলে অনেকে মনে করছেন।

বলা হয়ে থাকে ৫০ ও ৬০ এর দশকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের থেকেও বেশি ভাইব্রেন্ট ছিল দলটির অঙ্গ সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সময়ের দাবিতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সময়ের প্রয়োজন মেটাতেই এগিয়ে চলেছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া এই সংগঠনটি সেই ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা থেকে শুরু করে তৎকালীন ডাকসু ভিপি ও ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এবং ৭১ এর মুক্তিসংগ্রামে রণাঙ্গণের প্রথম সারিতে থেকেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও দলটির অবদান অনীস্বীকার্য। ৯০ সালের গণ অভ্যুত্থানেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় ছাত্রলীগ। কবি সুকান্ত ভট্টচার্যের কবিতার একটি লাইন আছে যে, ‘সাবাস বাংলাদেশ...  এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,/ জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার,/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ এই পংক্তি হতে পারে ছাত্রলীগের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল কর্মকাণ্ডের যুতসই উদাহরণ। তবে এগুলো এখন সোনালী অতীত। পানি শুকিয়ে সেই খরস্রোতা নদী আজ মৃতপ্রায়। আগেকার ছাত্রলীগের অনেক অর্জন থাকলেও সেই সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে বর্তমান ছাত্রলীগের নেতারা। সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের ঘটনা দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রোধ তৈরি করেছে। এখন আবার দেখা যাচ্ছে, রংপুরের পীরগঞ্জের ঘটনার মূল `হোতা` ছাত্রলীগ নেতা। এগুলো ছাড়াও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিপুল অভিযোগ। বলতে গেলে সুনাম কম, অভিযোগই বেশি। এখন ছাত্রলীগের কেউ কোনো দায়িত্ব নেই। বর্তমানে দেশে চলমান সব বিনষ্টগুলোতেই এ দলটির নেতাকর্মীদের নাম আসে। ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, প্রশ্নফাঁস, দখলবজি, নারী কেলেঙ্কারি, ধর্ষণ সব জায়গায় তাদের পাওয়া যায়। 

প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের অনুপস্থিতিতে ছাত্রলীগ নিজেরাই কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। গত ১২ বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের জন্য সংঘর্ষ, গোলাগুলি, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, হলের সিট নিয়ন্ত্রণসহ নানা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে ছাত্রলীগের প্রায় একশ ৩০জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। পুরান ঢাকায় প্রকাশে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক দৃশ্য দেশের মানুষ দেখেছে। বরিশালে কলেজের অধ্যক্ষকে চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দেয়া, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়ে এসিড নিক্ষেপ, সিলেটের এমসি কলেজের হোস্টেলে অগ্নিসংযোগ, শরিয়তপুরসহ সম্প্রতি কয়েকটি এলাকায় ছাত্রলীগের নেতার নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করে ভিডিও প্রচার কাহিনীসহ অসংখ্য ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম জড়িয়েছে। বছর দুয়েক আগে, ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগে দলটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘শিক্ষা শান্তি প্রগতি’ সংগঠনটির মূলনীতি, অথচ বর্তমানে ছাত্রলীগ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে যেন এক আতঙ্কের নাম। প্রশ্ন ফাঁসের খবরগুলো শুনে যে কারোই মনে হবে যে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করাই যেন ছাত্রলীগের মূলনীতি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে ছাত্রলীগের নাম যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। এখনকার বেশির ভাগ নেতার বিরুদ্ধে বিবাহিত, খুনের আসামি, চাঁদাবাজি, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বিএনপি-জামায়াত পরিবার বা এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। সামনে ছাত্রলীগের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। একদিকে ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরুল হক নুর ও রেজা কিবরিয়ার সমন্বয়ে `গণপরিষদ` নামে নতুন দল আসছে। এছাড়া ছাত্রদলও বলছে, তারা যেকোনো মূল্যে মধুর কেন্টিন ছাড়বে না। এ ধরনের বিরূপ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা আছে কি না এটি একটি বড় প্রশ্ন। আমরা বিভিন্ন সময় দেখি যে, ছাত্রলীগের মধ্যে জামাত-বিএনপি ঘারানার লোকেরা বিভিন্ন পদ-পদবী নিয়ে বসে আছে। এসব অনুপ্রবেশকারীদের অত্যাচারে অনেক পোড় খাওয়া, দুঃসময়ে দলকে আঁকড়ে থাকা নেতারা আজ কোনঠাসা। ছাত্রলীগে যদি শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা না করা হয়, তাহলে ধীরে ধীরে মূলদল আওয়ামী লীগে তার প্রভাব পড়বে। কাজেই ছাত্রলীগের জন্য নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। এক সময় ছাত্রলীগের ভঙ্গুর পরিস্থিতি থেকে উৎরাতে `ওকে কমিশন` গঠন করা হয়েছিল। বর্তমান ছাত্রলীগে যদি শুদ্ধি অভিযানের মতো কোনো পদক্ষেপ নিয়ে শুদ্ধি না করা হয় তবে মূল দল আওয়ামী লীগকে এর ভোগান্তি আজীবন পোহাতে হবে। যদি ছাত্রলীগকে ঠিক করা না যায়, তাহলে আওয়ামী লীগকেও ঠিক করা যাবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭