ইনসাইড টক

’দেশের বাইরে টেকনিক্যাল কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 27/10/2021


Thumbnail

করোনাকালীন সাম্প্রতিক সময়ে রেমিটেন্সের নিম্নমুখী প্রবাহ ও কারণ এবং উত্তরণ নিয়ে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, করোনার সময়ে দেশে যে ইকোনোমিক ডাউনটার্ন তৈরী হয়েছিল সেসময় প্রবাসী কর্মীরা পরিবারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য বেশী রেমিটেন্স পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরছে তারা ঠিকভাবে ফিরে যেতে পারছে না, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, পিসিআর টেস্টের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি কারণে বর্তমানে রেমিটেন্স কম আসছে। তাছাড়া, দেশের বাইরে বর্তমানে টেকনিক্যাল কর্মীদের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ কম বা যুগের প্রয়োজনে পর্যাপ্ত সাপোর্ট দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এসকল কারণে রেমিটেন্সের উপরে ঋনাত্মক প্রভাব পরেছে। এজন্য কিভাবে আস্তে আস্তে এটি পজিটিভ পর্যায়ে পৌঁছানো যায় সে বিষয়গুলো চিন্তা করতে হবে। আমাদের চেয়ে কম কর্মী পাঠিয়েও ফিলিপাইনের মতো দেশ আমাদের চেয়ে বেশী আয় করে। সৌদি আরব বা দুবাইয়ে আমাদের কর্মীরা যেখানে পরিচ্ছনতার কাজ করছে, সেখানে এসব দেশে রেস্টুরেন্টের শেফ কিংবা স্টোরগুলোতে সেলসম্যানের কাজগুলো ভারত কিংবা ফিলিপাইনের লোকেরা করছে। সুতরাং আমাদের ধীরে ধীরে কমন কাজগুলো থেকে স্কিলড মাইগ্রেশনের দিকে যেতে হবে এবং এটি করতে পারলেই আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে। এজন্য দেশের মধ্যে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার সে প্রস্তুতিও আমাদের গ্রহণ করতে হবে। একটা সময় প্রচুর লোক বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে আমরা বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছি, কিন্তু এখন আমাদের দক্ষ ও টেকনোলজি বেইজড কর্মীকে বাইরে পাঠাতে হবে। এটা দেশে থেকেই তৈরী করতে হবে। এমনকি বাইরে থেকে যারা আসছে তাদেরকে এসমস্ত ওরিয়েন্টেশন দিয়ে আবার বাইরে পাঠাতে হবে। তাহলেই আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে।

করোনা ও প্রবাসীদের রেমিটেন্সের বিষয়ে বাংলা ইনসাইডারের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ড. জাফর আহমেদ খান।

প্রবাসী কর্মীদের দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, কর্মীদের স্কিলড করার ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে আরো এগ্রেসিভলি বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। আগের চেয়ে আমোদের অবস্থা এখন ভালো হয়েছে। তবে অন্যান্য লেবার সেন্ডিং দেশগুলো আরও দ্রুত এ কাজগুলো করছে। তাই সরকারকে এ বিষয়গুলো চিন্তা করতে হবে। যদিও সরকার এখন প্রত্যেক জেলায় জেলায় টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার করেছে, বিভিন্ন উপজেলাতে করছে। কিন্তু সেখানে ট্রেনিংয়ের মান বাড়াতে হবে। সত্যিকারভাবে যেসব কর্মীরা বাইরে যেতে ইচ্ছূক রিয়েল সেন্সে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাইরে পাঠানো উচিত। আমাদের দেশে যেহেতু প্রচুর জনসংখ্যা, তাই স্কিলড ম্যানপাওয়ার বিদেশে পাঠাতে পারলে আমাদের রেমিটেন্সও বাড়বে এবং দেশের সুনাম আরও বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রবাসীদের কল্যাণে কাজে লাগতে পারে বলে ড. জাফর আহমেদ খান জানান, বাইরের দেশগুলোতে কন্টিনিউয়িং এডুকেশন সিস্টেম আছে। যারা আগেই চাকরীতে ঢুকে যায় তারাও পরবর্তীতে একটা একাডেমিক ডিগ্রি অর্জন করতে পারে। বাংলাদেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে তারাও এ বিষয়টি চিন্তা করতে পারে। যাদের স্কিল আছে, ভালো কাজ করতে পারে কিন্তু কোন সার্টিফিকেট নাই। এ সার্টিফিকেটের জন্য তারা বাইরে ভালো চাকরি পাচ্ছে না, দেশেও ভালো কিছু করতে পারছে না। তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের সাথে কিভাবে ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় করে একটা স্কিলড সার্টিফিকেট প্রদান করা যায় সে ব্যাপারেও চিন্তা করা যেতে পারে।

প্রবাসীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের উপর জোর দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমাদের প্রবাসী কর্মীদের অ্যাডাপ্টিবিলিটি বা মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা অনেক বেশী। তারা বিদেশ যাওয়ার পর খুব দ্রুতই ভাষা শিখে নেয় ও বাইরের কালচারের সাথে তারা মানিয়ে নেয়। কিন্তু যাওয়ার সময় তারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থাকে না। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রবাসী কর্মীদের ভাষা কিংবা কালচার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় কিন্তু এক আরো পর্যাপ্ত করা দরকার। যেমন- যে সব কর্মীরা বাইরে যাবে তারা কোন পরিবেশে কাজ করবে, কোন ভাষা ব্যবহার করতে হবে এসব বিষয়গুলো প্রশিক্ষণের ভিতরে আরও বেশি অন্তর্ভূক্ত করা দরকার। সরকার স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য আলাদা একটা সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে তৈরী করেছে যেটা আগে ছিল না। একটা বিষয় চিন্তা করা দরকার, যারা দেশের বাইরে যাচ্ছে সরকার তাদের পেছনে তেমন কোন ইনভেস্ট করছে না। কিছু ক্ষেত্রে ইনভেস্ট করলেও তা খুবই স্বল্প। যে ছেলেটা দেশে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, ডাক্তার হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে তাদের পেছনে সরকারের একটা বিশাল ইনভেস্টমেন্ট আছে। প্রবাসী কর্মীদেরও যদি সরকার দক্ষ প্রশিক্ষকের দ্বারা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তাদের যদি বাহিরে পাঠানো যায় তবে তারা এক একটা সোনার টুকরা হয়ে উঠতে পারে। তাহলে তারা শুধু বিদেশেই না, দেশে এসেও তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে বিএমইটির অফিস আছে, বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার তৈরী হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি জেলায় না, বরং উপজেলা পর্যায়েও এসব দরকার। যাতে মানুষ বাইরে যাবার জন্য কি করা দরকার সেখান থেকেই জানতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের সরকারি সাপোর্ট অফিস নাই দেখেই এসব প্রান্তিক পর্যায় থেকে কর্মীরা দালালদের মাধ্যমে বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের আরও ফ্রেন্ডলি হতে হবে, তাদের কাছে যেতে আরও ইজি এক্সেস থাকতে হবে। এছাড়া প্রত্যেকটা রিক্রুটিং এজেন্সিকেও জবাবদিহিতার মধ্যে আনা দরকার। কোন রিক্রুটিং এজেন্সিকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বৈধ অফিস না থাকলে লাইসেন্স দেয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারগুলো আরও স্পষ্ট ও বাইরে যাবার চ্যানেলগুলো আরও স্বচ্ছ করা দরকার।

তিনি আরও জানান, প্রবাসী শ্রমিকরা নির্দিষ্টি সময় বিদেশে থাকার পর যখন দেশে ফিরে তখন তারা শুধু টাকা নিয়ে আসে না, তারা দক্ষতাও নিয়ে আসে। তারা দেশে ফেরার পর তাদের অর্জিত দক্ষতাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় এ বিষয়ে চিন্তা করা যায়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও বিএমইটির মতো প্রয়োজনে আলাদা অর্গানাইজেশন তৈরী করা যেতে পারে। এখন প্রতি বছর আমাদের অনেক কর্মী বাইরে যাচ্ছে এব্ং বাইরে আমাদের এক কোটির বেশী লোক আছে। এই এক কোটি লোকের জন্য তো সরকার তেমন কিছুই করছে না। তারা আমাদের দেশের অক্সিজেন, খাবার, আমাদের ক্ষেতের ফসল কিছুই নিচ্ছে না। বরং প্রতি বছর তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। তাই তাদের তাদের কিভাবে বেনেফিট দেয়া যায়, তাদের টাকা দেশে কিভাবে নিরাপদে বিনিয়োগ করা যায় এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার সাম্প্রতিক সময়ে পার্লামেন্টে ককাস, একটি প্রেশার গ্রুপ, তৈরী করেছে। এসব বিষয়গুলোকে কিভাবে আরও সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা যায় এবং আইন-কানুন গুলোকে আরও প্রবাসী ফ্রেন্ডলি করা যায় এ ব্যাপারে ককাস বায়রার সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বৈঠক করেছে। এসব প্রবাসী কর্মীদের নিয়ে যেসব সিভিল সোসাইটি কাজ করে তাদের সাথে বৈঠক করে পলিসি, গাইডলাইন তৈরী ও আইনকানুন পরিবর্তন করা নিয়ে আলোচনা করেছে।

ড. জাফর আহমেদ খান প্রবাসীদের কল্যানে বর্তমান সরকারের কিছু কর্মকান্ড উল্লেখ করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটা ম্যান্ডেট ছিল প্রবাসী কল্যান ব্যাংক করা, সেটা আমরা করেছি। আমরা বিএমইটিকে আরও আধুনিকায়ন করেছি। সেখানে যেসমস্ত কর্মীরা বাইরে যাবে তাদের স্মার্টকার্ড প্রদান করেছি যাতে তাদের একটা ইলেক্ট্রনিক প্রোফাইল থাকে। আমরা কল্যাণ বোর্ড করেছি। আমরা আগের চেয়ে বেশী লেবার উইয়ং তৈরী করেছিলাম। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক করেছি। এমনকি ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেন্ট ডে ১৮ ডিসেম্বর, আমরা খুব বড়ভাবে  উৎযাপন করতাম যাতে মানুষের মধ্যে একটা সজাগ দৃষ্টি তৈরী হয় এবং সেকারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় রাষ্ট্রপতি আসতেন, বিভিন্ন দেশের মাইগ্রেন্ট কর্মীদের সাথে কথা বলতেন। এসমস্ত কাজগুলো করার প্রেক্ষিতে তখন মনে হয়েছিল বাংলাদেশ মাইগ্রেশনের ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে উন্নিত হয়েছিল। সেই বিষয়গুলোকে আরও দ্রুত কিভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে নেয়া যায় এ বিষয়ে আমাদেন চিন্তা করা দরকার।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা আছে। এই জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলতে পারলে আমাদের দেশের কাজে যেমন লাগবে, পাশাপাশি আমরা এদের বাইরে পাঠিয়ে অন্যান্য যেসব দেশের স্কিলড কর্মী দরকার তাদের উন্নয়নেও আমরা বিরাট একটা ভূমিকা রাখতে পারি। এতে সেসব দেশের সাথে আমাদের সম্পর্কও গভীর হবে এবং আমরা শুধু বাংলাদেশের উন্নয়ন না, পৃথিবীর উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারি। আর অবৈধ পন্থায় দেশের বাইরে যাওয়া বন্ধ করা দরকার। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যারা আছে তাদের এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ পন্থায় বাইরে যাওয়া যত দ্রুত বন্ধ হবে ততই আমাদের জন্য এটা মঙ্গলজনক।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭