ইনসাইড পলিটিক্স

দল-জনতার বিশ্বস্ত কর্মীরা কি রাজনীতিতে আসছেন?


প্রকাশ: 01/11/2021


Thumbnail

বলা হয়ে থাকে যে, সাধারণভাবে খুব পড়ুয়া একজন মানুষ মিডিয়াম সাইজের ছয় হাজার বই পড়তে পারে এক জীবনে, ব্যতিক্রম মাও সে তুং। তিনি ১১ হাজার বই পড়েছিলেন। শুধুমাত্র পশ্চাৎপদ সমাজে বিপ্লব করার জন্যই নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রসরতার জন্য এখনো অনেকের কাছে প্রাসঙ্গিক তিনি। মাও সে তুং দেশ ও সমাজের সাথে দলের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তার দেহরক্ষী চেন চ্যাং ফেং (Chen Chang-Feng) কে বলেছিলেন, ‘তোমার বোঝা উচিত আমাদের সমস্ত রকম কাজ করার জন্য কর্মী চাই। এমন কর্মী যিনি পার্টি ও জনতার কাছে বিশ্বস্ত।’ 

বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ৫০ বছর পার করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো ধরণের অভাব থাকুক আর নাই বা থাকুক, রাজনৈতিক দলের অভাব নেই। আর এসব দলের বিরুদ্ধে জনমনে জন্মাচ্ছে বিরোপ ধারণা। বিশেষ করে  ৭৫ পরবর্তী ‘দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি’ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে মানুষের বিস্তর অভিযোগ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে মূল ধারার রাজনীতি লুটপাটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। আর এর প্রভাব এসে পড়েছে হাল আমলের রাজনীতিতে। 

বর্তমানে মূল ধারার প্রচলিত দলগুলোতে নেতার অভাব না হলেও বিশ্বস্ত কর্মীর খরা চলছে। আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থী, ছাত্রলীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, বিএনপির জনসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হওয়া, ছাত্রদল আন্দোলনে রাজপথে না থাকলেও কমিটি দেওয়ার সময় গোটা নয়া পল্টন এলাকা অবরুদ্ধ করে ফেলাসহ অসংখ্য নিদর্শন বিশ্বস্ত কর্মীর অভাবেই হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করা মুগ্ধ সাহা হৃদয় চলমান রাজনৈতিক দলগুলোতে নিজের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে রাখঢাক না রেখে বাংলা ইনসাইডারকে সরাসরি বলেন, দেশে রাজনীতির নামে যা চলছে তা আমি বুঝি না। নেতারা জনগণের জন্য কাজ করতে রাজনীতি করছেন বলেন। কিন্তু ভোটের সময় ছাড়া তাদের এলাকায় দেখা যায় না। নিজ দলের কর্মীদের মধ্যেও গ্রুপিং করেন। নিজের পছন্দের লোককে কমিটির ভালো ভালো পদ যেমন, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বানান। যারা প্রশ্ন করে, জবাবদিহিতা চায়, তাদের পছন্দ করেন না। দূরে দূরে রাখেন। যারা তেলবাজি করেন, সহমত টাইপ ভাইদের জন্য বর্তমানের রাজনীতি। আপনার পেছনে যদি সাপোর্টিং পিলার না থাকে, তাহলে রাজনীতিতে আপনি ভালো কিছু করতে পারবেন না। এমপি-মন্ত্রী হতে পারবেন না, দলের প্রধান হওয়া তো অনেক দূরে। ফলে কিসের স্বপ্নে রাজনৈতিক দলগুলোতে নাম লিখাবো, প্রশ্ন করেন তিনি।

মুগ্ধ সাহার মতো অধিকাংশ শিক্ষিত, মেধাবী তরুণরা এখন আর রাজনীতিতে আসতে চাইছেন না। একে তো পরিবারগুলো রাজনীতি করতে দিতে চায় না। তারা মনে করে, রাজনীতি করলে পড়ালেখা গোল্লায় যায়। পাশাপাশি রাজনীতির পরিবেশটাও এখন সহায়ক নয়। ফলে শিক্ষিত, স্মার্ট তরুণরা ইয়ার্কি-ফাজলামি থেকে শুরু করে ফান, যৌন রসাত্মক গল্প বিনিময়, একে অপরের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করা, দুষ্টুমি করে পরস্পরকে গালি দেওয়া, খেলা থাকলে সে খেলা দেখা এবং সে সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত বিনিময় করে। কিন্তু কখনোই তাদের আলোচনায় দেশজ সমস্যার কথা থাকে না। বিদেশি রাজনীতি নিয়ে তরুণদের কেউ কেউ দু-একবার আলোচনা করলেও স্বদেশি রাজনীতিতে মারাত্মক অ্যালার্জি। শিক্ষিত গোষ্ঠীর  রাজনীতিতে অনীহার কারণেই সুস্থ ধারার রাজনীতির স্থলে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির জয়জয়কার বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

রাজনৈতিক ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণদের বুঝতে হবে যে, সব রাজনৈতিক দল, নেতা বা কর্মীরা দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত নন। ভালো মানুষও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত আছেন। শিক্ষিত তরুণরা যদি রাজনীতিতে না আসে তাহলে তাদের জায়গায় খারাপ লোকেরা ঢুকে পড়বে। ঢুকে পড়ছেও। প্রকৃতি কখনোই শূন্যতা পছন্দ করে না। তারা আসছেন না বলেই মূলধারার দলগুলোর এই দৈন্য দশা। কোনো কর্মী নেই। সবাই নেতা হয়ে গেছে। এসব নেতাদের দাপটে, সন্ত্রাসে, অর্থ-বিত্তের ক্ষমতায় ও আত্মীয়তার জোরে দলের নীতিবান, সৎ, সজ্জন ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মীরা প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। যেখানে রাজনীতিবীদদের জনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা, সে জায়গায় উল্টো তাদের দেখলে জনতা পাশ কাটিয়ে চলে। মন খুলে কথা বলতে চান না। ওয়ান ইলেভেনের সময় দেখা গেছে যে, মূল ধারার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, দুই দলেই বিশ্বস্ত কর্মীর না থাকার ফলে মাইনাস টু ফর্মুলার মতো নিকৃষ্ট বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা হয়েছিল। দলের বড় বড় হেভি ওয়েট নেতাদের দল, মানুষ, সর্বোপরি দেশের প্রতি কমিটমেন্ট না থাকার ফলেই এমনটা হয়েছে। তবে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেও বিপথগামী আছে। ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা লোক আছে। ফলে তাদেরকেও আমাদের বেছে চলতে হবে। কারণ তাদের অনেকেই ব্যক্তিত্বহীন, নিজের বিবেক বা বিবেচনাবোধ নেই, দলকানা ও দলদাস। তবে পুরো শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর তুলনায় এদের সংখ্যা খুবই কম। তাই শিক্ষিত তরুণদেরই পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের হাতেই জাতির ভবিষ্যৎ। রাজনীতিতে যদি সৎ ও বিশ্বস্ত কর্মীর রিক্রুটমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়, তার পরিণতি ভয়াবহ হবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭