ইনসাইড টক

‘‘নূর হোসেনদের আত্মত্যাগ কি বৃথা যাবে?’’


প্রকাশ: 10/11/2021


Thumbnail

কবি, সাহিত্যিক ও ৯০ দশকের তুখোড়, সাহসী ছাত্রনেতা মোহন রায়হান। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সংগ্রাম ও তৎপরবর্তী সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়ের গর্ভ থেকে অভ্যুদয় তার। সমাজ-পরিবর্তনেও অঙ্গীকারবদ্ধ তিনি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করা মাত্র মধুর ক্যান্টিন থেকে প্রথম প্রতিবাদী মিছিল বের হয় মোহন রায়হানের নেতৃত্বে। ১৯৮৩-এর ১১ জানুয়ারি সামরিক স্বৈরশাহীর বিরুদ্ধে প্রথম ছাত্রবিদ্রোহের নেতৃত্বও দেন তিনি। ৯০ দশকের তুখোড়, সাহসী এই ছাত্রনেতার সঙ্গে সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হয় বাংলা ইনসাইডারের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মো. অলিউল ইসলাম

বাংলা ইনসাইডার: শহীদ নূর হোসেনের জীবন উৎসর্গের তাৎপর্য জানতে চাই? এটি কি সত্যি নয় যে, তার আত্মদানের মধ্য দিয়েই নয় বছরব্যাপী এরশাদ সামরিক স্বৈরাচারের পতন অবিশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল?

মোহন রায়হান: আজ ১০ নভেম্বর। শহীদ নূর হোসেন দিবস। দিবসটিকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। নূর হোসেন দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বস্তুত নূর হোসেনের জীবন দানের মধ্য দিয়েই নয় বছরব্যাপী এরশাদ সামরিক স্বৈরাচারের পতন অবিশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।

বাংলা ইনসাইডার: একজন অটোরিক্সা চালকের গণতন্ত্রের প্রতি এমন তীব্র আকাঙ্খার নেপথ্যে কী ছিল বলে মনে করেন?

মোহন রায়হান: নূর হোসেন ব্যক্তিজীবনে একজন অটোরিক্সা চালক ছিলেন। সে বুকের সামনে ‘স্বেরাচার নিপাত যাক’ ও পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষের  গণতান্ত্রিক চেতনা ও আকাঙ্খা কত তীব্র। আমাদের দেশের সকল সামরিক, বেসামরিক, স্বৈরতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অনিবার্য এবং সাধারণ শ্রমিক, কৃষক, রিক্সাওয়ালা, মুটে-মজুরদের অংশগ্রহণের কারণেই আমাদের ৫২- এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ সামরিক স্বৈরাচারসহ সমস্ত সামরিক, বেসামরিক  স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনগুলো সফলতা পেয়েছে। তেমনি শহীদ নূর হোসেনসহ অসংখ্য শহীদের রক্ত আর আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে সামরিক স্বৈরশাহী এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতি লাভ করেছিল। 

বাংলা ইনসাইডার: এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শুরুটা আপনাদের নেতৃত্বেই হয়েছিল। এ সম্পর্কে একটু বলবেন?

মোহন রায়হান: ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে। তার পরের দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিন থেকে আমার নেতৃত্বে ১৫-২০জনের একটি মিছিল বেরিয়েছিল। পাশাপাশি তৎকালীন ছাত্র মৈত্রীর নেতা, বর্তমানে ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের সম্পাদক নূরুল কবীরের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল বেরিয়েছিল।  ‘সামরিক শাসন মানি না, মানবো না’ স্লোগান দিয়ে। সেই মিছিল শেষে আমরা যখন মধুর কেন্টিনে ফিরে এসেছিলাম, সমস্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর শীর্ষ  নেতারা আমাদেরকে হঠকারী বলে তিরস্কার করে এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে  দ্রুত মধুর কেন্টিন ছেড়ে পালিয়ে যায়। এমনকি আমি যে ছাত্র সংগঠন করতাম, জাসদ ছাত্রলীগ, আমার নেতারাও বলেছিলেন, দেশে  সামরিক শাসন জারি হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিলাম না, কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়া তুমি আগেই মিছিল বের করে ফেললে?" আমি বলেছিলাম, রাজনীতি করে এটাই শিখেছি, দেশে মার্শাল ল জারি হয়েছে এর প্রতিবাদ করতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে। সে জন্য কারো পারমিশনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। যাক এভাবেই আন্দোলন শুরু হয়। 

বাংলা ইনসাইডার: মজিদ খানের শিক্ষানীতি বিরুদ্ধেও আপনারা প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন, যা সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। এ সম্পর্কে একটু বলবেন?

মোহন রায়হান: এরশাদ শুধু অবৈধভাবে ক্ষমতাই দখল করেনি, একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতিও ঘোষণা করে যা দেশব্যাপী মজিদ খানের শিক্ষানীতি বলে পরিচিত। সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আমরা ছাত্ররা প্রতিবাদ করি এবং এই শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি  সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনও গড়ে তোলার চেষ্টা করি। আমরা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন মিছিল করি। সে সময়  আমরা কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে একটি মৌন মিছিল করি। এর মধ্য দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেই। 

বাংলা ইনসাইডার: `ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ`কীভাবে গঠিত হয়েছিল? 

মোহন রায়হান: ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান দিবসে শুক্রবার হওয়ায় ৮ নভেম্বর জাসদ ছাত্রলীগ একটি মিছিল বের করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ঢুকে পড়ে এবং ব্যাপক নিপীড়ন চালায়। ছাত্র, ছাত্রী এমনকি শিক্ষকও রেহায় পায়নি সেই নির্যাতন থেকে। ক্লাসে ক্লাসে ঢুকে বেধড়ক পিটায়। সেই সময় নূরুল আলম ব্যাপারী নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে প্রচণ্ড প্রহার করা হয়। জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা শরীফ খানসহ আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা ১৪টি ছাত্র সংগঠন একত্রিত হয়ে `ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ` গঠন করি এবং ১১ জানুয়ারি রাস্তায় প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক শাসন ভাঙ্গার দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করি। 

বাংলা ইনসাইডার: `ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ`র ব্যানারে কার্যক্রম চালাতে গিয়ে আপনাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি’র মতো প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোরও মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। এর কারণ কী ছিল?

মোহন রায়হান: আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে একটি গণসাক্ষর কর্মসূচি গ্রহণ করি। এক মাসে লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর সাক্ষর করে। ১১ জানুয়ারি ছাত্র-বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজপথে প্রথম সামরিক শাসন ভঙ্গ করে ১০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মিছিল নিয়ে শিক্ষাভবন ঘেরাও করি। এর আগের দিন সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, যদি ছাত্ররা রাস্তায় নামে, মিছিল বের করে, তাহলে মিছিলে গুলি চলবে। এবং এই প্রাণহানির জন্য জান্তা সরকার দায়ী থাকবে না। তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নিয়ে মিটিং বসে। তাদেরকে বিশ্ববিদ্যায় কর্তৃপক্ষ সামরিক জান্তার হুমকি সম্পর্কে হুশিয়ার করে। রাজনৈতিক দলগুলো, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও অন্যান্য দলের নেতারা ছাত্রনেতাদের ডেকে বলেন যে, আমরা প্রস্তুত নই। তোমরা কর্মসূচি পিছিয়ে দাও। সিদ্ধান্ত হয় ১১ই জানুয়ারি বটতলা থেকে মিছিল যাবে শহীদ মিনার পর্যন্ত, শিক্ষা ভবনে যাবে না। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা এই ঘোষণা মেনে নেয় না।  ১৯৮২ সালের ১১ই জানুয়ারি ১৪টি ছাত্র সংগঠনের মাত্র ২৮জন নেতার মিছিল শহীদ মিনারে যায় আর সব সংগঠনের সব নেতা কর্মীরা সবাই আমার নেতৃত্বে শিক্ষা ভবন ঘেরাও করে। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক শাসন ভঙ্গ করি। এখন সবাই বিকৃত ইতিহাস লেখে, সেদিন আমরা সবাই আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক শাসন ভেঙ্গে শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। সামরিক জান্তার সকল প্রস্ততি থাকা সত্বেও ব্যাপক ছাত্রছাত্রীর সমাবেশ দেখে গুলি চালানোর সাহস পায় না। তার দুদিন পর ১৩ জানুয়ারি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী ইস্কাটন থেকে আমাকে চোখ হাত বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। ২১ দিন আমাকে ক্যান্টনমেন্টে গুম করে রেখে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়ে। আমার মুক্তির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে আমাকে মুক্তি দেয়া হয়। সেদিন সাধারণ ছাত্ররা ডাকসু ভবন ভাংচুর করে,  কারণ সকল সংগ্রামের পাদপীঠ ডাকসু কেনো আপোসকামী হলো? পরবর্তীতে আমরা সব ছাত্র সংগঠন মিলে বসে সব কিছু মিটমাট করে নতুন করে আন্দোলনের নতুন পরিকল্পনা করি।

বাংলা ইনসাইডার: ১৪ই ফেব্রুয়ারির ঘটনা আন্দোলনে কেমন প্রভাব রেখেছিল? 

মোহন রায়হান: ১১ই জানুয়ারি কর্মসূচি এক মাস পিছিয়ে ১৪ই ফেব্রুয়ারি করা হয়েছিল। সেই হিসেবে আমরা আবার নতুন করে ১৪ই ফেব্রুয়ারির জন্য প্রস্তুতি নেই এবং সারা দেশে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারির ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শিক্ষা ভবন ঘেরাও কর্মসূচি উপলক্ষে  আমরা মিছিল নিয়ে শিক্ষা ভবনের দিকে যেতে শিশু একাডেমির সামনে মিছিল যেতেই বর্বর এরশাদের নির্দেশে  সেই মিছিলে গুলি চলে, গুলিতে মারা যায় জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল দীপালিসহ অনেক ছাত্রছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে জয়নালের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়, অনেক ছাত্র ছাত্রীদের গ্রেফতার করা হয়, নির্যাতন চালানো হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আমরা আবার নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময় হরতাল ডাকা হয়,  বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করি, সারা বাংলাদেশের সকল স্কুল-কলেজগুলোতে আমরা ব্যাপক প্রচারপ্রচারনা চালাই। শ্রমিক কর্মচারীদের হরতালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের  ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজকে গুলি করে হত্যা করা হয়, হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা তাজুল ইসলাম, ময়েজউদ্দিনকে। পরবর্তীতে গুলি করে হত্যা করা হয় জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা রাউফুন বসুনিয়াকে, ট্রাকচাপা দিয়ে মারা হয় ছাত্রলীগ নেতা সেলিম-দেলওয়ারকে। এরকম অনেক ছাত্র ছাত্রীর রক্তের স্রোতে ভেসে ভেসে আন্দোলনটা এগুচ্ছিলো। আন্দোলনে লেখক, কবি, সাহিত্যক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের একত্রিত করতে  আমরা `জাতীয় কবিতা পরিষদ` এবং `সম্মিলিত সাংস্কৃতিক` জোট গঠন করি। সাংস্কৃতিক কর্মীরা, শ্রমিকরা, ছাত্ররা, সাধারণ জনগণ আস্তে আস্তে আন্দোলনের সাথে জড়ো হয়। 

বাংলা ইনসাইডার: এরশাদীয় স্বৈরশাসনের শেষটা কীভাবে হয়েছিল?

মোহন রায়হান: আন্দোলন যত বেগবান হয় স্বৈরাচারী নিপীড়ন আরও নিষ্ঠুর ও নির্মানবিক হয়ে ওঠে। ১৯৮৭ সালে ১০ই নভেম্বর মিছিলে নূর হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়, এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো ১১ ও ১২ নভেম্বর দেশব্যাপী সকাল সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়। আন্দোলন আরও তীব্র গতি লাভ করে তারই ধারাবাহিকতায় ২৭ নভেম্বর ডা. মিলনের হত্যা, জেহাদের খুন জনতার প্রচণ্ড ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ার মাধ্যমে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি ও গণ অভ্যুত্থানের মুখে ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হয়। পতন হয় পৃথিবীর অন্যতম ঘৃণ্য এরশাদীয় স্বৈরশাসনের প্রায় এক দশক। 

বাংলা ইনসাইডার: এতো জীবনদানের প্রতিদান কি আমরা দিতে পারছি?

মোহন রায়হান: এই যে এতো রক্ত, এতো জীবনদান এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা- একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ, আজকে কি আমরা সেখানে পৌঁছাতে পেরেছি? আমরা পৌঁছাতে পারি নাই। আমাদের শহীদদের যে স্বপ্ন ছিল, আমরা যারা আন্দোলনটা রচনা করেছিলাম, ত্যাগ তিতীক্ষা করেছিলাম, গ্রেফতার হয়েছিলাম, নিপীড়ন সহ্য করেছিলাম। সেসময় সাংবাদিকদের একটা ভূমিকা ছিল, সাংবাদিক সৈয়দ বোরহান কবীরকে লেখার জন্য এরশাদ গ্রেফতার করেছিল। আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বোরহান কবীরের মুক্তির দাবিতে পোস্টার বের করে ঢাকা শহরে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। আরও অন্যান্য সাংবাদিকদের ওপরও নির্যাতন ছিল, হুলিয়া ছিল, হুমকি ছিল। এই যে এতো মানুষের জীবনদান, এতো মানুষের রক্তপাত, এর মধ্যে দিয়ে আমাদের যে স্বপ্নের গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্রকে আমরা কি অর্জন করতে পেরেছি?  

বাংলা ইনসাইডার: সার্বিকভাবে আপনার দৃষ্টিতে  আমাদের গণতন্ত্রের অবস্থা এখন কেমন? 

মোহন রায়হান: আজকে কি দেশে কারো কথা বলার অধিকার আছে? আজকে কি ভোটের নিরাপত্তা আছ? আজকে সারা দেশ লুটপাট, দুর্নীতির মহাস্বর্গে পরিণত হয়েছে। আজকে আমাদের পার্লামেন্টে প্রায় ৭০ ভাগ হচ্ছে ব্যবসায়ী তাদের অনেকেই লুটেরা, কালো টাকার মালিক। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মৌলবাদী, স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে গোপন আঁতাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ  আজ কোথায়?  

বাংলা ইনসাইডার: নূর হোসেনদের আত্মত্যাগ কি তাহলে বৃথা যাবে?

মোহন রায়হান: স্বাভাবিকভাবে আজ প্রশ্ন আসে নূর হোসেনদের আত্মত্যাগ কি বৃথা যাবে? এ প্রশ্ন আজকে আমাদের বিবেকের কাছে আমাদের প্রত্যেকের করতে হবে। আজকে আমাদের দলকানা হয়ে থাকলে চলবে না। আজকে আমাদের অন্ধ হয়ে থাকলে চলবে না। আমি বুঝি না যে শেখ হাসিনাকে কারা ঘিরে আছে? দেশে এই যে লুটপাট চলছে, এই যে দুর্নীতি চলছে, এই যে একটা ভয়ের ও আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে এটা কি উনি জানেন না? উনি শোনেন না? 

বাংলা ইনসাইডার: বর্তমানের প্রচলিত রাজনীতিতে আপনাকে দেখা যায় না কেন?

মোহন রায়হান: আমি এখন রাজনীতি থেকে দূরে আছি। কারণ আমাদের সময় রাজনীতির যে আদর্শ, নীতি, চরিত্র ছিল তা এখন নেই। আজকে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। আজকে সাংবাদিকতা সাংবাদিকদের হাতে নেই। আজকে মিডিয়া মাফিয়ারা কিনে নিয়েছে। আজকে রেডিও, সংবাদপত্র, টেলিভিশন এগুলোর মালিক আজ মাফিয়ারা। সাংবাদিক হিসেবে যাদের শ্রদ্ধা করতাম, ভালবাসতাম, স্নেহ করতাম আজকে আর সেই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা নেই। দুঃখ হয়, কষ্ট হয়। আজকে ১০ ই নভেম্বর নুর হোসেন দিবস। নুর হোসেন একজন অটো রিকশাচালক। আজকের দিনে সে জীবন দিয়েছিলেন । তার জীবনে কি চাওয়া পাওয়া ছিল? আজকে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। আজকে আমাদের আবার প্রত্যকেকই কথা বলতে হবে। যারা স্বাধীনতার পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, একাত্তরের চেতনা ধারণ করেন তাদের প্রত্যেকের সোচ্চার হওয়ার দরকার। আজকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, স্বাধীনতার যে ডিক্লারেশন- সমতা, সামাজিক ন্যায় বিচার, মর্যাদাবোধ  সেই চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ই নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে আমাদের নতুন করে শপথ নেয়া দরকার। আমাদেরকে নতুন করে নতুন চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। 

বাংলা ইনসাইডার: বর্তমান তরুণ সমাজের কাছে আপনার কোনো বার্তা দেওয়ার আছে?

মোহন রায়হান: আজকে সারা বিশ্বে যে পুঁজিবাদ, সাম্রজ্যবাদ, স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে তার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের প্রতিবাদী তরুণ সমাজকে গর্জে উঠতে হবে। অর্থ-বিত্ত সম্পদের ভোগবাদী সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্বব্যাপী তরুণ সমাজকে আজ ভোগবাদে লালায়িত করে তাদের চেতনাকে ভোতা করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে পড়তে এসে ভাবতাম, আমরাই শিক্ষিত,আমাদেরই কথা বলতে হবে। আর এখন ছেলে মেয়েরা কী করে অর্থ-বিত্তের মালিক হবে, বড় চাকরি পাবে, অনেক টাকার মালিক হবে, কীভাবে বাড়ি গাড়ির মালিক হবে, কী করে বিদেশে পাড়ি জমাবে এই স্বপ্নে তারা বিভোর! আর এটা পরিকল্পিত ভাবেই করা হচ্ছে। এটা পুঁজিবাদী সমাজের ক্যারেক্টার। সমস্ত মানুষকে ভোগবাদী করা। আজ ছাত্রদেরকে অন্যদিকে ধাবিত করা হয়েছে। এটা জাতির জন্য খুব ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার। এ দেশের সামরিক-বেসামরিক সকল স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলন সূচনা করেছে ছাত্ররা। অথচ সেই ছাত্র সমাজ আজ নীরব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেলে মেয়েরা ভাবা যায় না, তারা এভাবে সবকিছুতে চুপ আছে। এটা সমগ্রটাই একটা ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আজকে যুব সমাজকে, ছাত্র সমাজকে তার চেতনাশূণ্য করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭