ইনসাইড থট

নব্য পাকিস্তান প্রেম এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 18/11/2021


Thumbnail

পাকিস্তান ক্রিকেট দল মিরপুরে ওদের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে অনুশীলন করেছে। মিরপুর! এমন ঘটনায় যতখানি গর্জে ওঠা দরকার ছিল,তা না উঠে ঐ বধ্যভূমিতে শায়িত শহীদদের উপযুক্ত প্রতিদানই দিচ্ছি আমরা। এভাবে প্রকাশ্যে মধ্যাঙ্গুলি দেখানোর পরেও আমাদের তেমন কিচ্ছু বলার নেই এই "দ্বীনি ভাই"-দের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, এই মাত্র সেদিন, মানে ৯ নভেম্বর, ২০২১ -এ, "পাক-বাংলা ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্স" নামে একটি অল-পার্টি অনুষ্ঠান হয়েছে পাকিস্তানের লাহোরে। এতে করাচীতে বাসরত বাংলাভাষীদের কারও-কারও অংশগ্রহণ ছিল, সাথে বাংলাদেশ থেকেও কিছু মানুষ গিয়েছিল। আরও ছিল ওদের রাজনীতিবিদ,মূল ধারার সাংবাদিক, ইউটিউবার, শিক্ষার্থীর মত নানা মহলের কিছু ব্যক্তিবর্গ। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ থেকে যারা গিয়েছিল তারা কারা? এদের জন্ম-পরিচয় কি? এদের আনুগত্য যদি বাংলাদেশের প্রতি না থাকে, তাহলে নাগরিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার এদের আদৌ আছে কিনা? এসব প্রশ্ন আসছে কারণ ইকবাল আর রবীন্দ্রনাথের তুলনামূলক আলোচনার মত প্রহসনের আড়ালে ভয়ংকর আগ্রাসী এক উদ্যোগের ঘোষণা এসেছে ওখান থেকে। ওরা এটুক বুঝেছে যে বাঙ্গালির কাছাকাছি যেতে হলে বাংলাকেই মাধ্যম করতে হবে, তাই এবার থেকে পাকিস্তানী ওয়েব সিরিজ-গান-নাটক-সিনেমাকে বাংলা করে বাংলাদেশে প্রচার করবার জোর তদবির নাকি শুরু হবে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী টিভি চ্যানেল তো এমনিতেই চলছে, সেই দেখে-দেখে বাঙালি পুনরায় বিয়ে বাদ দিয়ে "নিকাহ" করা শিখেছে, ওড়না`র বদলে "দোপাট্টা" নেওয়াটাও। উর্দু কবি-লেখকদের বইয়ের বাংলা তর্জমা এরই মধ্যে দেশের মাদ্রাসাগুলোতে নিয়মিতভাবে হচ্ছে এবং সেখান থেকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটাও ঠিকঠাক হচ্ছে। অনুষ্ঠানে এমন মত এসেছে যে পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঐচ্ছিক হিসাবে বাংলা পড়ানো হোক, এ থেকে অনুমেয় যে কোন একটা সময় তারা চাইবে তাদের বাংলাদেশের বন্ধুরা বলুক যে আমরা উর্দুকে ঐচ্ছিক হিসাবে চাই! অবশ্য, আলাদা করে চাওয়ার আছেটা কি? অবিশ্বাস্য আর অগ্রহণযোগ্য হলেও এটাই সত্য যে এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গা থেকে আমরা উর্দু শিক্ষার সুযোগ তুলে দেইনি! যা হোক, এসব ছাড়াও তারা "হইচই" এর মত প্ল্যাটফর্ম খুলে শিল্পীদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করতে চায়, তবে সবার উপরে যা চায় তা হল এভাবে কাছাকাছি আসতে-আসতে একদিন বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হোক। ওরা বলছে এখনকার মত তরুণরা যদি সেদিন থাকতো তাহলে বাংলাদেশ কিছুতেই আলাদা হত না, তাই এবার দুই দেশের মধ্যে এক রকমের যৌথ সাংস্কৃতিক আন্দোলন জাগাতে তারা স্থিরপ্রতিজ্ঞ। এখানে উল্লেখ্য যে কনফারেন্সের উদ্যোক্তা ব্যক্তিটি কিছুদিন আগে আমাদের পতাকার লাল গোলকের ঠিক মাঝখানে একটি জ্বলজ্বলে চাঁদ-তারা বসানোর মত ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে, তবু তেমন কোন প্রতিবাদী স্বর কোন দিক থেকে শুনতে পাইনি।

পাকিস্তানে আগামী ১৯ নভেম্বর "খেল খেল মে" নামক একটি সিনেমা মুক্তি পেতে চলেছে যেখানে তাদের ভাষ্যমতে তারা নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সামনে এগোনোর বার্তা দিয়েছে। কৌতূহলী হয়ে ট্রেইলার এবং গান দেখলাম। দেখি, বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে কাব্য করে বলা হয়েছে, "চল, দুজন মিলে ক্ষমা চাই"। প্রশ্ন হল, এই দু`জন মিলে ক্ষমা চাওয়ার কথাটা আসছে কেন? মূলত এই চাওয়ার পেছনে উপলক্ষ হয়েছে দেশে আটকে পড়া বিহারীরা। ইদানীং যতবার আমরা বলি ওরা সেদিন গণহত্যা করেছিল,ততবার ওরা বলে,  তোমাদের মুক্তিবাহিনীও তাঁদের মিত্রবাহিনীকে সাথে করে বিহারীদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল। আজ সম্পর্ক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা যখন আরও একবার আলোচনায় উঠতে শুরু করেছে, তখন এ রকম প্রজেক্টের উদ্দেশ্য একটাই- আত্মপলব্ধির পথে না হেঁটে, বরং তরুণদের মধ্যে বিভ্রম ছড়ানো, যাতে করে নিজেদের মধ্যেই বিরোধ আর অবিশ্বাসের শিকার হয়ে আমাদের দাবীটি দুর্বল হয়ে পড়ে আর তাতে করে কালো বাঙ্গালিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে একা পাঞ্জাবি মাথা নত না হয়, বরং নত হলে দু`জনেরই হোক! বিভ্রান্তি জাগাতে তারা অনেকটা সফল যে হয়েছে তা ভিডিওগুলোর নিচে বাংলাদেশীদের মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট। ঝাঁকে-ঝাঁকে মতামত আসছে যে তারা নাকি "সত্য" কিম্বা "সম্পূর্ণ" ইতিহাস কোনদিন জানতে পারেনি, এতদিন কেবল একপেশে কথাই শুনে এসেছে, তাই এই চলচ্চিত্রটির জন্য এখন খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায়! এমন অমেরুদণ্ডী প্রজন্মও দেখতে হবে সেটা কখনও ভাবিনি, তবে ভাবনার বাইরেই তো বেশীটা হচ্ছে, তাই অবাক হচ্ছি সে কথা বলতে পারি না। কেবল এটুক ভাবতে বাধ্য হই যে, এতকাল শুনে এসেছি আমরা দেখতে যেমন-তেমন হইও যদি, মেধা ও মননে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। তো এই কোটি-কোটি প্রজ্ঞাবানদের মাঝ থেকে কারও কি একবার বোধ হচ্ছে না যে সময়টা এখন-ই কেন? কেন পাকিস্তান আবারও ওদের ঘেরাটোপে আমাদের টেনে নিতে এত তীব্রভাবে আগ্রহী? ১৫ বছর আগেও যাদের আমাদের দিকে ফিরে তাকানোর রুচি হত না, কেন আজ তারাই তোঁতাপাখির মত ঐ দেশ গড়ার আন্দোলনে বাঙ্গালি মুসলমানের অবদানের কথা কপচাচ্ছে? আজ জিডিপি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে, আর ওদের পায়ের তলায় সামান্য মাটিটুকুও নেই। এ অচলাবস্থা কাটাতে শর্ট-কাট খুঁজবে আর খুঁজতে গিয়ে চুপসানো স্বপ্নের গোঁড়ায় আবারও পানি ঢালতে শুরু করবে, ওদের জন্য এটাই হয়ত স্বাভাবিক। ফলে সোশ্যাল মিডিয়া হোক বা মূল, সবখানে ওরা খোলামেলা আলাপ করছে একটা ফেডারেশানের সম্ভাবনার, দুই দেশের কারেন্সি এক করবার, এমনকি আমাদের রিজার্ভ থেকে ওদের সমস্যা দূর করবার। এসব বাস্তবায়ন করতে হলে দু`দেশের মানুষের অবশিষ্ট মানসিক দূরত্ব ঘোচানোর দরকারটাও ওরা বুঝেছে, আর তাই সর্বশক্তি দিয়ে বাঙ্গালিয়ানা ভুলিয়ে দিয়ে,কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে নির্লজ্জ অর্থনৈতিক সুবিধা তুলে নিতে ওদের এই জোর উদ্যোগ চলছে। আর খোলা চোখে সবটা দেখেও এই যে আমাদের মুখ ফিরিয়ে থাকা, এর ফলাফলটাও এরই মধ্যে সামনে আসতে শুরু করেছে।

ইউটিউবে অন্তত ৮-১০ টি পাকিস্তানি "রিএকশান" চ্যানেল আছে যেগুলো কিনা লাগাতার ভারত এবং হিন্দু বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ করছে। এর মধ্যে কম পক্ষে একটির পেছনে আইএসআই এর সরাসরি হাত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এসব চ্যানেলের কোন-কোনটিতে লক্ষাধিক বাংলাদেশী সাবস্ক্রাইবার আছে যা হাল্কাভাবে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ, বাংলাদেশের যে কোন ঘটনা, তা সে বায়তুল মোকাররামে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার প্রতি হুংকাররত মোল্লাদের কিম্বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নানা ভিডিওচিত্র হোক, কিম্বা সাম্প্রতিক পাক-ইন্ডিয়া ম্যাচের পর "পাকিস্তান জিন্দাবাদ" বলে নাচানাচির দৃশ্য হোক, সবই মুহূর্তের মধ্যে এসব চ্যানেলে থেকে আরও বেশী করে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন ভাবে ছড়ায় বাংলাদেশী মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের গাওয়া উর্দু গজল, মামুনুল হক ও আজহারিদের বিষাক্ত ওয়াজের মত আরও অনেক কিছু। শুধু এই নয়, ও তরফ থেকে কখনও ধুয়ো তোলা হয় যে ভারত, বাংলাদেশকে দু`টুকরো করতে চায়, আবার কখনও বলে বাংলাদেশ-ই "সেভেন সিস্টার স্টেটস"-গুলো ভেঙ্গে নিতে ভারতে সন্ত্রাসী ঢোকাচ্ছে! আরেকটি প্রচারণাও পাখা মেলেছে, তা হল পাক-বাংলাদেশ "দোস্তি" কেবল উভয়ের অর্থনীতির জন্যই নয়, ইসলামের হাত মজবুত করতেও জরুরী। বিস্তর হিন্দু বিদ্বেষী কথার পাশাপাশি বলা হচ্ছে যে পাকিস্তানের আসল মালিক হল বাংলাদেশের মুসলিমরাই। এছাড়াও বস্তাপচা কিছু রূপকথাও উঠে আসছে যেমন, নিরানব্বই হাজার পাকিস্তান সেনা সেদিন হারেনি, কিম্বা বঙ্গবন্ধু আসলে স্বাধীনতা চাননি, চেয়েছিলেন স্বনির্ভরতা, ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে ভাবনার খুব কিছু ছিল না যদি না একটা বড় সংখ্যক মানুষকে দেখতাম সহমত হতে। বাংলাদেশকে সাথে করে পাকিস্তানীরা প্রকাশ্যেই একদিকে কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানের স্বপ্ন দেখছে, আবার গাজা-এ-হিন্দেও বাতাস দিচ্ছে। কথা হল, এই লাখো সাবস্ক্রাইবাদের একটা ভাল অংশ আমাদের মফস্বল এলাকাগুলোর নানা কোণায় ছড়িয়ে আছে। এমন লাগাতার মগজ ধোলাইয়ের পর এদের মধ্যে যে কেউ সেদিন প্রতিমা ভাংতে বা মন্দির লুট করতে যায়নি, তার কোন নিশ্চয়তা দিতে পারবে কি কেউ? সর্বস্বান্ত পাকিস্তান বলছে বাংলাদেশ যদি শ্রীলঙ্কার মত অমুসলিম দেশকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে পারে, তবে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে কেন নয়? বরং, এক সময়ের শাসককে সাহায্য করতে পেরে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানোর সুযোগ কোনভাবে হাত ছাড়া করা উচিৎ হবে না। প্রশ্ন হল, আমরা কি তাইই করতে চলেছি?

একটা সময় ছিল যখন ওরা কেবল আমাদের জমিটুকুই চাইতো, মানুষগুলোকে না। আজ ওরা জমি আর মানুষ দুটোই চায়। মানুষ না পেলে ওদের অশুভ লড়াইয়ে ওদের সাথে মিলে লড়বে কারা? আমাদের পিঠে দাঁড়িয়ে ওদের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সতেজ করবার যে স্বপ্ন, তা শুধু তখনই সম্ভব যদি দ্বীনি কর্তব্য ভেবে ওদের জন্য আমরা নীরবে পিঠ পেতে দেই। কাজেই, মানুষগুলোকে আজ বড় দরকার, তারও বেশী দরকার ওদের সকল আগ্রাসনের মুখে আমাদের নীরবতা। আর তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে বিগত ২০ বছরে ব্যাঙের ছাতার মত জেগে ওঠা অগুন্তি টিভি চ্যানেল আর পত্র-পত্রিকা। ঘরে-ঘরে ঢোকার সুযোগে প্রতিদিন চ্যানেলগুলোতে গোঁড়ামোর আসর বসে। একটা সময় ছিল যখন দেশ এতখানি শুদ্ধবাদীতার পথে হাঁটছিল না, তবু মানুষগুলো ধার্মিক হবার পাশাপাশি মানবিকও ছিল। আজ আশেপাশে তাকালে কি দেখি? আরে ভাই, ধর্ম তো মানুষের জন্য, যে মানবিক-ই নয়, সে ধার্মিক হয় কিভাবে? যত বেশী  বজ্রগেঁরোতে সবাইকে একই ছাঁচে ঢালার চেষ্টা চলছে, ততই যেন সমাজে অস্থিরতা, অবিশ্বাস, অসহনশীলতা বেড়ে চলেছে। অন্যান্য যে দেশগুলো এই পথে হেঁটেছে, তারাও কি কোন সুস্থ সমাজ উপহার দিতে পেরেছে? পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালে রোজ দেখি "নূরানি আমল লাভের ৫টি সহজ উপায়"। অথচ আজ অবধি দেখলাম না কেউ লিখেছে যে পাকিস্তানে জামায়াত-ই-ইসলামের আমির তার ফেসবুক থেকে লাইভ করে বলেছে বাংলাদেশে আজও দ্বি-জাতি মতবাদ বেঁচে আছে। পাকিস্তানের প্রধান একটি টিভি চ্যানেলে বসে যখন ওরা আমাদের ইকোনোমি নিয়ে কিছু বলে, তখন আমরা বগল বাজিয়ে ফোসকা তুলে ফেলি। অথচ ওরা যখন বলে "আজকের বাংলাদেশ, আগামীর পাকিস্তান"-তখন সেই ঔদ্ধত্যের কথা কোন শিরোনামে আসে না! ইউটিউবের বাইরেও বিভিন্ন গেমিং প্ল্যাটফর্মে এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ওরা সমমনা বাংলাদেশীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশ, ইউকে, মালয়েশিয়া থেকে স্কাইপ করে এদের কারও-কারও কে বাংলা শিখতে, ভিডিওর ডেস্ক্রিপশান লিখতে সাহায্য করা হয়। এত কিছুর পরেও কারও টনক নড়ছে কি?

ইমরান খানের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণ করা খুব জরুরী। ওরা জানে "শুভেচ্ছা, স্বাগতম" বলে আপ্লুত হবার লোকের অভাব এদেশে হবে না। এতে ভারতকে শক্ত বার্তা দেওয়াই হবে না, নিজের দেশে বিরোধীদেরকেও বলা হবে যে কাশ্মীরের বেলা কিছু না পারলেও, পাকিস্তান-বাংলাদেশ, এই দু-দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সে যা করতে পেরেছে,তা আর কেউ পারেনি। আফগানিস্তের ইস্যু একটি সিকিউরিটি ইস্যু, পৃথিবী শুধু ঐ এক প্রিজমের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানকে দেখে। পশ্চিমাদেশগুলো যেটুকু সহ্য করে, তা স্রেফ এ কারণেই করে। জিও-পলিটিক্সে ওদের পারমানবিক শক্তি একটা ডিটারেন্স হয়ে ক্ষেত্র বিশেষে কাজ করলেও, জিও-ইকোনোমিতে প্রবল কোন বারগেইনিং ক্ষমতা এ কারণে পাকিস্তান ভোগ করে না। ইমরান আহমেদ খান নিয়াজী যে এই অঞ্চলে বা এর বাইরেও, জিও-ইকোনোমিক্যালি সে রকমভাবে পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেনি, সে কথা ওদের আর্মি বুঝে গেছে। তাই এ মুহূর্তের গরম খবর হল ইমরানের যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেছে, তবে তার পরিবর্তে কে আসবে এবং কি ভাবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। এর মধ্যে ইভিএম বিল পাশ করানোর মত দু-চারটে স্টান্টবাজী করে দেখালেও শেষতক এই যথেষ্ট নাও হতে পারে। এই টানাপোড়েনের মাঝে ইমরান চায়না আর টার্কিকে দিয়ে চাপ প্রয়োগ করিয়ে হলেও যদি বাংলাদেশে আসতে পারে, তবে তেহরিক-এ-ইনসাফের জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগ দিয়ে এটা অনেক বড় শো-ডাউন হবে। সবই হল, কথা রয়ে যায়, আমরা কি পাচ্ছি? ভারতের প্রতি ক্ষোভ মানেই কি পাকিস্তানের বাহু বন্ধনে গিয়ে ধরা দেওয়া? ভারত আমাদের অনেক বড় বাস্তবতা, আজ থেকে ১০ বা ২০ বছর পর যে উচ্চতা ওরা ছোঁবে, তাতে ভারতের সাথে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে চলাতেই আমাদের লাভ। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সাথে এ প্রেমে আমরা কি পাবো? আমাদের কতটুকু পণ্য ওরা নিচ্ছে বা নিতে আগ্রহী? ওরা চাইছে যে কোন মূল্যে বাংলাদেশে ওদের জন্য অবারিত সুযোগ তৈরি হোক, এতটুকুই। কিন্তু ওদের সাথে এই ঘেঁষাঘেঁষিতে আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের সার্বিক অবস্থানটাই বা কোথায় গিয়ে ঠেকবে?

শেষ করতে চাই ঈশপের গল্প দিয়ে। যতটুকু মনে পড়ে, একটি গাছে কোন একটি রসালো ফল ঠোঁটে করে এক পাখি বসে ছিল। নিচ থেকে যাচ্ছিলো এক ক্ষুধার্ত শেয়াল। ফলের দিকে চোখ যেতেই ধূর্ত শেয়াল ফন্দি খুঁজতে লাগে যে কোন ভাবে ওটা হাপিস করার। বুদ্ধিও খেলে যায়! পাখিটিকে উদ্দেশ্য করে শেয়াল নানান প্রশংসা করতে লাগে। বেশ খানিকক্ষণ পর পাখিটি যখন ভীষণ খুশি হয়ে পালটা কিছু বলতে মুখ খুলেছে, ওমনি টুপ করে ফল মাটিতে! শেয়াল কি আর বসে থাকার বান্দা? ফলটি পলকে মুখে তুলে তখন সে ভোঁ করে গভীর বনে গেলো পালিয়ে। এখানেই গল্প শেষ। এরপর পাখি সে ফল আর খুঁজে পেল কি-না, কিম্বা শেয়ালের থেকে আরও কোন ধূর্ত প্রাণী ফলটি জিতে গিয়েছিল কি-না, তা গল্পে বলা নেই। সেটা বিষয়ও না। গল্পটা মিথ্যা স্তবে তুষ্ট হয়ে রসালো ফলটি হারিয়ে ফেলার। আরও ভেঙ্গে বলি, এই সামান্যকাল আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা মর্যাদার লড়াই লড়েছিলেন। তাঁদের পেটে অন্ন, গায়ে ঠিক মত বস্ত্র ছিল না। চাকরী হোক কিম্বা খেলাধুলা, মিলিটারি হোক বা ব্যবসা -কোথাও সমান সুযোগ ছিল না,এমন কি নিজ ভাষাতে পড়াশোনার সম্ভাবনাটুকও যেতে বসেছিল। তবু, হারাবার মত অনেক কিছু সেদিনও ছিল। এরপর এক জাদুকরের সম্মোহনী ডাকে সাড়া দিয়ে সব হারাবার ভয় বুকে পুষেও অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে ছিলেন ওঁরা । সেদিন পেছনে কেউ ভাতের থালা ফেলে গিয়েছিল, কেউ প্রসূতি স্ত্রী কিম্বা প্রিয় স্বামী, বৃদ্ধ মাতা-পিতা, কোলের শিশু, ছোট্ট ভাই-বোন, স্বজন, আরও কি না? নিশ্চয়ই জানতেন ফেলে যাওয়া জায়গায় কেউ দ্বিতীয়বার ফিরতে পারে না। ফিরে এসে কাকে-কাকে আর পাওয়া হবে না, সেই ভয় কি দোলা দেয়নি? মনে কি হয়নি যে নিজেও ফিরতে না পারি? তবু, যেতে-যেতে ভেবেছিলেন ওঁদের এই যাওয়াটাকে ফেলে আসা মানুষগুলো নিশ্চয়ই সার্থক করে তুলবে। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে কি শুধু আরেকবার নতুন ভোর দেখতে ইচ্ছা করেনি? যখন পাষণ্ড হানাদার বাহিনী সিলিং থেকে ঝুলে থাকা তরুণীর স্তন কেটে নিচ্ছিলো, তখন সেই তীব্র যন্ত্রণায় তাঁর কি শুধু আরেকটাবার মায়ের স্পর্শ পেতে ইচ্ছা হয়নি? প্লায়ারস দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে ওরা যখন কোন যুবকের নখ উপড়ে ফেলছিল, তখন কি তাঁর হঠাত ফেলে আসা ছোট্ট শিশুর তুলতুলে আদরে কিম্বা ভাই-বোনের খুনসুটির কাছে ফিরতে মন চায়নি? হয়েছে সবই, তবু তাঁরা দিকভ্রষ্ট হননি। ভেবেছিলেন, না হয় আমাদের বিনিময়ে হলেও ওরা বাঁচুক মাথা তুলে, স্বাধীন দেশের, মুক্ত মানুষ হয়ে। আজ আমাদের অনেক আছে। দু`পকেটে চারটে করে আই ফোন, ব্যাংকে অগাধ অবৈধ টাকা, ঘরে স্ত্রী বা স্বামী আর বাইরে মনের মানুষ- সব। যা নেই তা হল মর্যাদাবোধ। রসালো এই ফল আমরা স্বেচ্ছায় আজ মাটিতে ফেলতে রাজী।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭