ইনসাইড হেলথ

সারাদেশে ‘ভুয়া ডাক্তারি সনদ’ সন্দেহে ২২ মামলার তদন্তে পিবিআই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/11/2021


Thumbnail

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) চিকিৎসাসেবা দিতে সাময়িক নিবন্ধনের জন্য ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর আবেদন করেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার এক ব্যক্তি। তিনি দাবি করেন, তিনি এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক। আবেদনের সঙ্গে দেওয়া এমবিবিএস ডিগ্রির সনদ ও কাগজপত্রে চীনের ‘তাইসান মেডিকেল ইউনিভার্সিটি’র নাম। ফলে তা যাচাইয়ের জন্য ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর বেইজিংয়ের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে ইমেইলের মাধ্যমে সনদ যাচাইয়ের আবেদন করে বিএমডিসি। দুই সপ্তাহ পর সেই ইমেইলের জবাবে তারা জানায়, প্রেরিত নামের কোনো নিবন্ধিত ছাত্রের তথ্য তাদের কাছে নেই এবং ইমেইলে পাঠানো সনদটিও তাদের দেওয়া নয়। ফলে মিথ্যা প্রমাণিত হয় আফসারের এমবিবিএস ডিগ্রির প্রোভিশনাল সার্টিফিকেট। এতে জাল ও ভুয়া সনদ সন্দেহে আফসারের রেজিস্ট্রেশন আবেদনটি বাতিল করে বিএমডিসি।

এ তালিকায় রয়েছেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানার একজন, সাতক্ষীরার তালা থানার একজন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার একজন, ভোলার দৌলতখান থানার দৌলতখান পৌরসভার একজন, কুমিল্লার বরুড়া থানার দুইজন, চাঁদপুরের মতলব (উত্তর) থানার একজন, ঢাকার সাভারের একজন, বাগেরহাট সদরের দুজন, ফেনীর দাগনভুঁইয়ার একজনসহ আরও কিছু ব্যক্তি।

অনেকেরই এমবিবিএস ডিগ্রির সনদ ও কাগজপত্রে রয়েছে চীনের সেই তাইসান মেডিকেল ইউনিভার্সিটির নাম। এর আগে রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও এমন তিনটি ভুয়া এমবিবিএস সনদ ধরা পড়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু তারাই নন, এমন আরও ২২টি ভুয়া ও জাল সনদধারীর বিষয়ে আদালতে মামলা করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। এর মধ্যে গত মাসের শেষে মামলা হয়েছে ১০টি। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. মো. আরমান হোসেনের পক্ষে বাদী হয়ে এ মামলা করেন সিনিয়র কম্পিউটার অপারেটর এ কে এম আনোয়ার উল্যাহ। এরই মধ্যে কয়েকটি মামলার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ১৬টি মামলার তদন্ত চলমান।

এ বিষয়ে মামলার বাদী এ কে এম আনোয়ার উল্যাহ বলেন, ‘আগে বিদেশ থেকে যারা এমবিবিএস ডিগ্রি নিতেন তাদের বিএমডিসির নিবন্ধন পেতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সনদপত্র সত্যায়িত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিএমডিসিতে আবেদন করতে হতো। এরপর বিএমডিসি একটি পরীক্ষা নিতো। পরীক্ষায় পাস করলে প্রথমে ইন্টার্নশিপের জন্য সাময়িক ও ইন্টার্নশিপ শেষ হলে স্থায়ী নিবন্ধন দেওয়া হতো। দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভেরিফাই (যাচাই) করতো বলে নতুন করে যাচাই করা হতো না।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যাচাই প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড হওয়ায় পদ্ধতি উন্নত ও সহজ হয়েছে। এতে ভুয়া সনদ জমা দিলে তা যাচাই করতে গেলেই ধরা পড়ে। প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসে। যাদের সনদের সত্যতা মেলেনি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সেগুলো তদন্ত করতে দিয়েছেন। আশা করি, তদন্তে জালিয়াতির বিষয়টি উঠে আসবে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করবেন আদালত।’

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভুয়া সনদ ব্যবসায়ী চক্র ও এর সঙ্গে দূতাবাসের কেউ জড়িত না থাকলে সেটা সত্যায়ন করা যেমন সম্ভব নয়, আবার ভুয়া সনদধারীদের বিএমডিসির পরীক্ষায় কেউ জড়িত না থাকলে পাস করারও কথা নয়। এমন না হলে সনদ, দূতাবাসের সত্যায়নসহ সব কাজ করতে একটা সংঘবদ্ধ চক্র হয়তো থাকতে পারে।

বিএমডিসির তথ্য মতে, চলতি বছরের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সংস্থাটি থেকে এক লাখ ১৩ হাজার ৫১ জন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী নিবন্ধন নিয়েছেন। বিডিএস (ডেন্টাল) নিবন্ধন করেছেন ১১ হাজার ৫৩৮ জন।

এছাড়া ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গত এক দশকে এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রি নিতে বিদেশে পড়ার জন্য যারা নিবন্ধন করেছেন সেই সংখ্যা মোট দুই হাজার ৩৫৫ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে বিদেশে পড়তে গেছেন ৫৬ জন, ২০২০ সালে ৩৭ জন, ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৫ জনে।

সংস্থাটির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, যেসব শিক্ষার্থী এসএসসি ও এইচএসসিতে মোট জিপিএ ৯ (নয়) পায় তারা অনুমতি নিয়ে বিদেশে পড়তে যেতে পারে। যারা বিদেশে এমবিবিএস ও বিডিএস (ডেন্টাল) পড়তে যান তাদের মধ্যে দেশে ফিরে পরীক্ষা দিয়ে ইন্টার্নশিপ পাওয়া ও চূড়ান্ত নিবন্ধন নম্বর নেওয়ার সংখ্যাও কম। বিদেশে পড়তে যাওয়া দুই হাজার ৩৫৫ জনের মধ্যে শুধু গত বছর পরীক্ষা দিয়ে এমবিবিএস ও বিডিএসের (ডেন্টাল) চূড়ান্ত নিবন্ধন পেয়েছেন ১০০ জনের মতো। এর আগে এই সংখ্যা ছিল আরও কম। এছাড়া চূড়ান্ত নিবন্ধন পরীক্ষায় অনেকে পাসও করেন না।

জানা যায়, ২০১৯ ও ২০২০ সালে বিডিএস (ডেন্টাল) চূড়ান্ত নিবন্ধন পরীক্ষায় কেউ পাস করেননি। ২০২১ সালে পরীক্ষায় অংশ নেবেন মাত্র চারজন। প্রাথমিক নিবন্ধন নিয়ে যারা বিদেশে যান তাদের অনেকে চূড়ান্ত নিবন্ধন নেন না কিংবা নিতে পারেন না। ফলে চূড়ান্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন না করা পর্যন্ত তাদের ডিগ্রি ভুয়া কি না সে ব্যাপারে জানারও সুযোগ থাকে না। তবে এর একটি অংশ আবার মেডিকেল ডিগ্রি নিতে বিদেশ গেলেও ডিগ্রি নেন অন্য বিষয়ে বা অন্যকিছু করেন। কেউ কেউ আর দেশেও ফেরেন না।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য অনুমতি বাধ্যতামূলক। যারা বিএমডিসির নিবন্ধন নিয়েছেন, সেই তুলনায় উপজেলাসহ সারাদেশে হিসাব করলে নিবন্ধন ছাড়াও অনেক চিকিৎসক পাওয়া যাবে। উচ্চশিক্ষার নামে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিয়ে ভুয়া ডাক্তারি সনদ নিচ্ছে। এগুলোর জন্য প্রয়োজন সঠিক যাচাই প্রক্রিয়া। অন্যথায় এ অবস্থা থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, ভুয়া সনদ দিয়ে যারা চিকিৎসা করছেন তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। এজন্য বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম বাড়ানো যেতে পারে। আমরা চাই, নজরদারি কিংবা ভালোভাবে তদারকির মাধ্যমে যারা ভুয়া সনদ দিয়ে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা করছেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।

ভুয়া সনদ নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া সংক্রান্ত মামলার তদন্তের বিষয়ে পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অর্গানাইজেশন) আহসান হাবীব পলাশ বলেন, এ ধরনের মামলার তদন্ত আমরা আগেও করেছি। যারা বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসেন তাদের সব তথ্য ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) মাধ্যমে আমরা যাচাই করি। এর আগে এ ধরনের যেসব মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে সেসব ঘটনায় বাংলাদেশেও যারা জড়িত তাদেরও আমরা শনাক্ত করেছি। আশা করছি, বাকি মামলার তদন্তেও যারা এসব ভুয়া কাজ করেছেন তা বের হয়ে আসবে। এবারও জড়িতদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।

ভুয়া ও জাল সনদ দিয়ে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। উপজেলা পর্যায়ে সেটা দিন দিন বেড়েই চলছে বলে মনে করেন অনেকে। ফলে দেশজুড়ে প্রয়োজন সঠিক তদারকি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭