ইনসাইড পলিটিক্স

আইন না সার্চ কমিটি: কোন পথে নির্বাচনের রাজনীতি?


প্রকাশ: 27/11/2021


Thumbnail

রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধানে গত দুইবার সার্চ কমিটির ব্যবস্থা হলেও এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ব্যক্ত করছে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো। সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে সরকার, বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজের মধ্যে তৈরি হয়েছে একটি ত্রিমুখী সংকট। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। অপরদিকে বিএনপি বলছে যে, নির্বাচন কমিশন নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। অন্যদিকে আরেক পক্ষ সুশীল সমাজ দাবি করছে যে, আইনের মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠন করা হোক। তবে নেতাদের চলমান বক্তব্যে সার্চ কমিটি অথবা আইন প্রণয়ন নিয়ে কোনো ধরনের নমনীয়তার আভাস দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের এখনো দেড় বছরের মতো সময় বাকি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। এ কমিশন থাকতে থাকতেই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বে থাকবে নতুন কমিশন। আর এ কারণেই সার্চ কমিটি গঠিত হলে এটি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক হবে এবং রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো এ নির্বাচন কমিশন নিয়ে ইতোমধ্যে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। অন্যদিকে এর নেপথ্যে থেকে সুশীল সমাজ কলকাঠি নাড়াচ্ছে। তারা বলছে যে, এরকম সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে, এটি হবে অনুগত কমিশন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সার্চ কমিটির পক্ষেই আছেন। রাজনীতিবিদদের অমিলের কারণে এ ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে ইতোমধ্যে চলছে নানা ধরনের আলোচনা, হিসেব-নিকেশ।

সুশীল সমাজ থেকে আইনের কথা বলা হলেও সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, এবারও ইসি গঠনে আইন করার সম্ভাবনা নেই। রাষ্ট্রপতির গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমেই পরবর্তী নির্বাচন কমিশন হতে যাচ্ছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দেওয়া আছে। সেই ক্ষমতার বলেই তিনি সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করেন। সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে  গঠন করা হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশন। এটিই স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। পরবর্তী ইসিও সেভাবেই গঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে প্রকাশ্যে মতামত জানিয়েছেন। গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।’ নতুন ইসি গঠন নিয়ে দেশে চলমান আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রীর কথাই আওয়ামী লীগের কথা। ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সার্চ কমিটির পক্ষেই থাকছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তার মিত্রদের সুর সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা সার্চ কমিটি নিয়ে কিছু ভাবছে না। তারা বলছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হলে তার অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, কিসের সার্চ কমিটি? আপনারা যাকে চাইবেন, সে-ই হবে। যদি আগের পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়, আমাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের যে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে, সেই অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এক. এটি একেবারেই সরকারের নিজস্ব লোকজনকে দিয়ে, প্রাধান্য দিয়ে গঠন করা হয়। দুই. এটা ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু নয়। দলটির স্থায়ী কমিটির একটি ঘনিষ্ঠসূত্রের ভাষ্য, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ন্যূনতম সমঝোতা হলে নির্বাচন কমিশন গঠনে সর্বদলীয় সংলাপের আয়োজন করতে পারে বিএনপি। আর এই সংলাপের মধ্য দিয়ে ইসি গঠনে ঐক্যপ্রক্রিয়া কার্যকর করার পরিকল্পনা করছেন দলটির শীর্ষনেতৃত্ব।

অন্যদিকে সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে ধোঁয়া তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে সুশীল সমাজ। নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে ইতোমধ্যে ৫৩ জন গণমাধ্যমে বিবৃতিও দিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা দাবি করেছেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। তাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ এখনই শুরু করতে হবে। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে একটি আইন প্রণয়ন করা। আমরা আশা করি, সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সরকারের নির্দেশক্রমে আইন মন্ত্রণালয় একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করবে। নাগরিক হিসেবে মতামত প্রদানের মাধ্যমে আমরা এ ব্যাপার প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে পারি।

এদিকে নির্বাচন কমিশন গঠনে সুশীল সমাজের দাবি করা আইন তৈরির প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এই যে সার্চ কমিটির কথা যা বলা হয়েছে, সেটা গঠন করা হয়েছিল সব রাজনৈতিক দলের অভিমত নিয়েই এবং সব রাজনৈতিক দল রাজি হওয়ার পরই গেজেট করা হয়। যদিও সার্চ কমিটির গেজেটটা আইন নয়, কিন্তু এটা যেহেতু সবার কনসেন্টের মাধ্যমে হয়েছিল তাই মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেটা গেজেট করেছিলেন। তাই এটি আইনের কাছাকাছি। আমি এমন কথা বলছি না যে নির্বাচন কমিশন গঠনে যে আইনের কথা সংবিধানে বলা হয়েছে তা করা হবে না, কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি এবং সব কিছু মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে হতে হবে। তাই এখন এ আইন করাটা সম্ভব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন সার্চ কমিটির মাধ্যমে করা হবে। তবে রাজনীতির মাঠে এই তর্কযুদ্ধ পাশ কাটিয়ে এই মুহূর্তে প্রথমে একটি নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে মনোনিবেশের কথা বলছেন নির্বাচন বিশ্লেষকেরা।

আইন তৈরি ও আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, আইনমন্ত্রী বলছেন সময় নেই। এতে নাকি সংসদকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। সংসদকে যুক্ত করার এখন নাকি আর সময় নেই। কিন্তু সংসদকে সংশ্লিষ্ট না করেই তারা অনুসন্ধান কমিটি করে নিয়োগ দিয়ে ফেলবেন! এটা তো কোনোভাবেই হয় না, এ দুটো তো একত্রে যায় না। আমরা বলছি, এখনো অনেক সময় আছে। এটি একটি সংক্ষিপ্ত ও সহজ আইন। আমরা একটি খসড়াও করেছি। এটি অতি সহজেই অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করে অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করতে পারেন। তারপর সংসদে এর অনুমোদন হবে।’ 


রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি যদি সার্চ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে সেই কমিটির সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা। যেহেতু সিইসিসহ নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রথম ধাপ সার্চ কমিটি, তাই এ কমিটিকে কেন্দ্র করে কোনো বিতর্ক যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। তারপর সেই কমিটির কাজ হবে এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা, যাদের গ্রহণযোগ্যতা হবে সর্বজনীন। এ সার্চ কমিটির দায়িত্ব যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন করা, সেহেতু সকল পক্ষের মতামত নিয়ে যদি সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনের নাম প্রস্তাব করে, সেটিই সবার জন্য ভালো হবে। একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের কোনো বিকল্প নেই এমন বাস্তবতা মেনে নিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। বর্তমান নির্বাচন আইনে, নির্বাচন কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। চলতি আইনে নির্বাচন কমিশন চাইলে নির্বাচন বাতিলও করতে পারে, যা ভারতের নির্বাচন কমিশনও চাইলে পারে না। আমাদের শুধু কিছু ভালো, সৎ,নির্ভীক, সাহসী, মেরুদণ্ডী মানুষকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

যেভাবে গঠিত হয় সার্চ কমিটি

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেন এবং তারা সংবিধান ও আইনের অধীনে স্বাধীনভাবে কাজ করার বিধান। ইসি নিয়োগে আইন না হওয়ায় গত কয়েকটি মেয়াদে রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে আসছেন। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। বিগত সার্চ কমিটি গঠনের পরপরই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচটি নাম পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সব মন্ত্রীপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের নামের তালিকাও মন্ত্রীপরিষদ সচিবের কাছে চেয়েছিল গতবারের সার্চ কমিটি। একইভাবে সুপ্রিম কোর্টের নিবন্ধককে অবসরপ্রাপ্ত জেলা বিচারকদের নামের তালিকা কমিটিতে পাঠানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল।

এ ছাড়া সার্চ কমিটির সদস্যরা নিজ বিবেচনায় যোগ্য ব্যক্তিদের নাম সংগ্রহ করেন। সব নাম নিয়ে বৈঠকে বসে সার্চ কমিটি। তারপর তারা সুপারিশের তালিকা চূড়ান্ত করে। এ রকম আলোচনায় বিএনপিসহ ছোট-বড় সকল দলই অংশ নিয়েছিল। এবারও সে রকমই হবে বলে মনে করছেন অনেকে। বস্তুত নির্বাচন কমিশন গঠনের সম্পূর্ণ এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। ভালো এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে যদি একটি সার্চ কমিটি হয়, তাহলে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রথম ধাপ তৈরি হয় বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকেরা



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭