ইনসাইড পলিটিক্স

ছাত্রলীগ কি আওয়ামী লীগের বোঝা?


প্রকাশ: 27/11/2021


Thumbnail

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসে ১১ দফা দাবি। দাবির ১ (ঢ) দফায় ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যাপারটি কখনো কোনো সরকার আইনে পরিণত করেনি। মৌখিকভাবে কিছু কিছু পরিবহন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিলেও এ নিয়ে লিখিত কোনো চুক্তি বা প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।

এখন আবার বাসের ভাড়া অর্ধেকের দাবিতে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিনই রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স বাদে সব ধরনের পরিবহন আটকে হাফ পাস চালুর বিষয়ে প্রজ্ঞাপনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলার অভিযোগ উঠে। শিক্ষার্থীদের দাবি, হামলাকারীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। যে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহনে হাফ ভাড়াসহ ১১ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই ছাত্রলীগ হাফ ভাড়ার দাবিতে রাস্তায় নামা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে! 

একদিকে ছাত্রলীগের একাংশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বাসে হাফ ভাড়ার দাবি মেনে নিতে পরিবহন মালিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। ছাত্রলীগের এ দ্বৈতচারণ ও ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে গণমানুষের মনে জন্মাচ্ছে নানা প্রশ্ন। ছাত্রলীগসহ অন্যান্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর এ ধরনের অপকর্মের কারণে মূল দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ব্যাপক আকারে ক্ষুণ্ণ হয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ কত তা সরকারও জানে। কিছুদিন আগে, গত ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইলের সন্তোষে মওলানা ভাসানীর মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছিলেন গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া এবং সংগঠনটির সদস্য সচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। গুনে গুনে এ পর্যন্ত কুড়িবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হলেন নুর। এমনকি গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে ময়মনসিংহে গণঅধিকার পরিষদের আনন্দ র‌্যালিতে নেতাকর্মীদের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেছে সংগঠনটি। যদিও সন্তোষের ঘটনার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ড. রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক দলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আমি আইজিপিকে বলেছি যারা নতুন পার্টি করতে চাচ্ছে, তাদের পার্টি করতে দেওয়া উচিত এবং তারা দল করুক, তারা কাজ করুক। এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। কাজেই এখানে যেন কোনো রকম বাধা দেওয়া না হয়। মিছিল করতে চাচ্ছে মিছিল করুক। মিছিলে আমরা বাধা দেব কেন?’

আওয়ামী লীগ সভাপতির এ বক্তব্যের পরও এ নিয়ে দু’দফা ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হলো ‘গণঅধিকার পরিষদ’। গত মঙ্গলবার শিক্ষার্থীদের ওপর শুধু চড়াও-ই নয়, কিছুক্ষণ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলার পর সেখানে মিছিল থেকে আইডিয়াল কলেজের এক ছাত্রকে তুলে নেয়ার অভিযোগ মিলেছে। এর প্রায় ৫ ঘণ্টা পর ওই ছাত্র ছাড়া পায় বলে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফলে ছাত্রদের আন্দোলনের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের বদলে তা দমনে ছাত্রলীগকে কেন নামতে হলো এটা একটি বড় প্রশ্ন। 

এমনকি এ ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ গত সোমবার বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ছাত্রলীগের এক সময়ের জাদরেল নেতা, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের এ দাবি সমর্থন করি। এরপর তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও সমর্থন করেছেন এ দাবি। তারপর গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগ সভাপতিও শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করেন। তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়, ইতোমধ্যে ছাত্রলীগেরই একটি অংশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে বসে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি নেতিবাচক কাণ্ড ঘটিয়ে একের পর এক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগ। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মাহাদী জে আকিব নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীর লাইফ সাপোর্টে যেতে হয়। করোনার দীর্ঘ বিরতির পর খুলে আবার মেডিকেল কলেজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি রংপুর জেলার পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সংখ্যালঘুদের পল্লীতে আগুন দেয়ার ঘটনার মূল হোতা হিসেবে সৈকত মণ্ডল নামে এক ছাত্রলীগ নেতার নাম এসেছে। এর আগেও সিলেটের এমসি কলেজে ধর্ষণসহ হরেক রকমের খারাপ কাজে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার কথা গণমাধ্যমে আসে।

প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনগুলোর অনুপস্থিতিতে ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগের কোন্দল, সহিংসতা এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। গত ১২ বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের জন্য সংঘর্ষ, গোলাগুলি, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, হলের সিট নিয়ন্ত্রণসহ নানা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে ছাত্রলীগের প্রায় ১৩০জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক দৃশ্য দেশের মানুষ দেখেছে। বরিশালে কলেজের অধ্যক্ষকে চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দেয়া, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়ে এসিড নিক্ষেপ, সিলেটের এমসি কলেজের হোস্টেলে অগ্নিসংযোগ, শরিয়তপুরসহ সম্প্রতি কয়েকটি এলাকায় ছাত্রলীগের নেতার নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করে ভিডিও প্রচার কাহিনীসহ অসংখ্য ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম জড়িয়েছে। বছর দুয়েক আগে, ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগে দলটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫০ ও ৬০ এর দশকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের থেকেও রাজপথে বেশি ভাইব্রেন্ট থাকা সংগঠন ছাত্রলীগ অনেক আগেই তার অবস্থান থেকে দূরে সরে গেছে। সরে যাওয়ার কারণেই তারা শিক্ষার্থীদের দাবি সমর্থনের বদলে উল্টো তাদের উপরে হামলা চালালো। আন্দোলনকারীরা যদি কোনো ষড়যন্ত্রকারী কিংবা দেশকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা করে, সেটি দেখার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গোয়েন্দারা আছেন। এ জন্য তো তাদের শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ করার দরকার নেই। আগেকার ছাত্রলীগের অনেক অর্জন থাকলেও সেই সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে বর্তমান ছাত্রলীগের নেতারা। এছাড়া ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষেরও বিপুল অভিযোগ। সুনাম কম, অভিযোগ বেশি। এখন ছাত্রলীগের কারো কোনো দায়িত্ব নেই। বর্তমানে দেশে চলমান সব বিনষ্টিগুলোতেই এ দলটির নেতাকর্মীদের নাম আসে। ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, প্রশ্নফাঁস, দখলবজি, নারী কেলেঙ্কারি, ধর্ষণ সব জায়গায় তাদের পাওয়া যায়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭