ইনসাইড থট

হাওয়া বদলের পর…

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/11/2017


Thumbnail

জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে। এ উপলক্ষে শনিবার সরকারি উদ্যোগে আনন্দ মিছিল এবং সমাবেশ আয়োজন করা হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে র‌্যালি শোভাযাত্রা ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করেছেন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। উত্তম কথা। কিন্তু তাঁদের এই আয়োজন দেখে, জাতির পিতারই একটি উক্তি মনে পড়ল ‘লোক দেখানো কোনো কিছু করে লাভ নেই। হৃদয় থেকে যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সেটাই আসল।’

আমাদের সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের এই আনন্দ মিছিল কতটা চাটুকারিতা আর কতটা হৃদয় নিংড়ানো-সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে খানিকটা স্মৃতি তাড়ানিয়া হয়ে গেলাম।

২০০৫ সাল। গ্রেনেড হামলার রক্ত তখনো শুকায়নি। এমন সময়ে একটি স্বনামধন্য বেসরকারি টেলিভিশনে হাজির হলেন তারেক জিয়া। ‘হাজির’ শব্দটা সম্ভবত সঠিক হলো না। তাঁকে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে এসে চ্যানেলটি ধন্য হলো। তারেক জিয়ার একটি একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো। সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করলেন একটি ট্যাবলয়েড দৈনিকের প্রধান সম্পাদক। যেকোনো টেলিভিশন চ্যানেল, যেকোনো রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকার নিতেই পারে। এটা তাদের পেশাগত অধিকার। কিন্তু সাক্ষাৎকারের নামে চাটুকারিতা এবং প্রাপ্তির ফন্দিফিকির নি:সন্দেহে গর্হিত কাজ। তারেক জিয়া যখন ওই টেলিভিশন চ্যানেলে গেলেন তখন চ্যানেলটির দুজন মালিক কেবল তাঁর জুতা পরিষ্কারটাই বাকি রাখলেন। একজন মালিক অবশ্য আগে থেকেই ‘জিয়া সৈনিক’ ছিলেন। এজন্য তাঁকে অকারণে একুশে পদও দেওয়া হয়েছিল। অন্যজন আওয়ামী লীগের জন্য ফিট হয়ে যেতেন। সফেদ সাদা পাঞ্জাবির ওপর কেবল মুজিব কোট পরাটাই বাকি ছিল। এখনো স্মৃতিতে ভাসে, ওই সাক্ষাৎকারে তারেক জিয়াকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণাও করা হলো।

হাওয়া বদলের পর, ওই দুই মালিক এখন ‘বঙ্গবন্ধু গবেষক’। ওই একই টেলিভিশন চ্যানেল বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করে কেঁদে কেটে একাকার করেছে। ওই চ্যানেল এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া কিছুই বোঝে না। চ্যানেলটির পেশা হলো মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি।

উদাহরণটি দিলাম এজন্যই যে হাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী সৈনিকরা কীভাবে জিয়া সৈনিকে পরিণত হয়, কিংবা উল্টো হয়-তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ এটি। শুধু এই টেলিভিশন চ্যানেল নয়, এখন যারা সচিব, আধা সচিব হয়ে তাঁদের মোবাইলের রিংটোনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাজান, তাদের অনেকেই বিএনপি জামাত শাসনামলে হাওয়া ভবনের দারোয়ানকেও সালাম দিতেন। এদের কেউ কেউ তারেক জিয়ার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে, তিনদিন হাত ধুতেও কুণ্ঠাবোধ করেছেন। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপির তাণ্ডবে ধর্ষিতা হয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের পূর্ণিমা। ওই সময় সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক বলেছিলেন,’কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি, এটা আওয়ামী লীগের অপপ্রচার’। সময়ের আবর্তে জেলা প্রশাসক থেকে তিনি সচিব। হন না ওএসডি, সচিব তো। তাঁকেও দেখলাম র‌্যালিতে। আহারে বাংলাদেশ ! একজন ড. ইয়াজউদ্দিনের নির্বাচন সফলভাবে করার জন্য ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার হয়েছিলেন। হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন,’আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী কায়দায় নির্বাচন বানচাল করতে চায়’। তাঁকেও দেখলাম বেশ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে র‌্যালিতে। একজন মান্নান ভূঁইয়ার আদরে নরসিংদীতে ডিসিগিরি করেছেন। হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন,’একটাও আওয়ামী লীগ রাখব না’। তিনিও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক সেজেছেন। এ যেন স্কুলের যেমন খুশি সাজো অনুষ্ঠান। হিসেব কষলে দেখা যায়, ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। তখন এদের আবেগ কেমন ছিল? তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত তাঁর জেলখানার চিঠি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর।’ মানুষ ভুলে যায়। বাঙালি আরও দ্রুত ভুলে যায়। নিরোদ সি চৌধুরি তাই উপহাস করে বলেছিলেন, ‘বাঙালির হলো গোল্ড ফিস মেমোরি।’ সত্যি তো, সেজন্যই তো এই সব রংবদল দেখে আমরা হতাশ হই না, ঘৃণা জানাই না। আমরা যেমন ভুলে গেছি ২০০১ এর অক্টোবরে বিএনপির সন্ত্রাস, তান্ডব। যেমন ভুলে গেছি হাওয়া ভবনের দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন, তেমনি ভুলে গেছি তারেক জিয়া আর বিএনপির সঙ্গী আমলাদের পরিচয়। বিএনপির রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের একান্ত সচিব এখন প্রশাসনের প্রধান কর্তা। ভাবা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই, বাংলার বাণী প্রত্রিকায় পত্রিকার সম্পাদক শহীদ শেখ মনি লিখেছিলেন, ‘মোনেম খানের প্রশাসন দিয়ে মুজিবের সরকার চলবে না।’ আজও মাথায় এই প্রশ্নই আসে, বিএনপি জামাতের আমলারা কি শেখ হাসিনার প্রশাসন চালাচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ বলবেন, আমাদের প্রশাসনতো আর মার্কিন প্রশাসনের মতো নয়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে তখন তাঁর জন্য কাজ করাই হলো প্রশাসনের ধর্ম। সত্যি কথা। তাহলে কেন এই চাটুকারিতা, তাহলে কেন ভাঁড়ামী।

এই উদ্যোগের আয়োজক যারাই হোক না কেন, তাঁদের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন হাওয়া বদলের পর কী হবে? তখন কি বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি নিয়ে উৎসব করবেন, নাকি বলবেন জোর করে আমাদের দিয়ে এসব করানো হয়েছিল। 

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭