প্রকাশ: 28/11/2021
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ভোট ছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ার ভৌতিক ক্যারিশমা কোনোভাবেই থামছে না। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে জনগণের ভোট ছাড়াই এক দৈব কারণে জিতে যাচ্ছেন প্রার্থী। চলমান ইউপি নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মতো তৃতীয় ধাপেও ৫৬৯ জন জনপ্রতিনিধি বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে সব মিলিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন ১০৪৩ জন জনপ্রতিনিধি। স্থানীয় কিংবা জাতীয়, নির্বাচনের নামে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘অটো পাস’ করার অসুস্থ এ প্রক্রিয়াটিকে ভোটার-জনসাধারণের সঙ্গে একটি প্রতারণামূলক রাজনৈতিক প্রহসন হিসেবে দেখছেন ভোটাররা।
আজ রোববার তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ইউপিতে ভোট চলছে। তবে অনেক ইউপিতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের সংখ্যা বাড়ে। তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না এবং তারা বলছে যে, এ নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে কোনো উপ-নির্বাচনে যাবে না। ফলে অনেক ভোটার এমনিতেই ভোট দিতে যাবেন না, এটা ধরেই নেয়া যায় এবং বিএনপির অনুপস্থিতে নির্বাচনের জৌলুস যে হারাচ্ছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপিই একমাত্র দল না। ফলে বিএনপির ভোট বর্জনের সঙ্গে বিনা ভোটের নির্বাচন বিষয়টিও ঠিক মিলছে না অনেকের কাছে। কেননা ১৭টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অধীনে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অনেক এলাকায়। তবে তিন ধাপ মিলে ২ হাজার ১৯৮টি ইউপির মধ্যে ১ হাজার ৪৩ জন জনপ্রতিনিধি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, বিষয়টি ভোটারের কাছে বিভিষিকাময় একটি ব্যাপার। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ২৫২ জন, সাধারণ সদস্য পদে ৫৭৯ জন এবং সংরক্ষিত সদস্য পদে ২১২ জন নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম ধাপে ১৩৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬৯, সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ছয়জন ও ৬৩ জন সাধারণ সদস্য পদে রয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে ৩৬০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৮১, সংরক্ষিত মহিলা পদে ৭৬ ও সাধারণ সদস্য পদে ২০৩ জন রয়েছেন। তৃতীয় ধাপে ৫৬৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১০০, সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ১৩২ এবং সাধারণ সদস্য পদে ৩৩৭ জন রয়েছেন।
নাগরিক সুবিধা নয়, নির্বাচনে ভোট দেওয়া নাগরিক অধিকার। যেকোনো নির্বাচনে দুই বা তার অধিক প্রার্থী থাকবে, জয়ী হবে একজন। উৎসুক ভোটার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিবেন। দেশে এটিই ছিল নির্বাচন ও ভোটের পাটিগণিতিক হিসাব। তবে ইতিহাস যেমন পাটিগণিতের নিয়ম মেনে অগ্রসর হয় না, তেমনিভাবে নির্বাচন ও ভোটারের হিসাবও আগের মতো নেই। একাদশ জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ এর পর বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ আতঙ্ক ভয়াবহ মাত্রায় তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। দেশে একটা সময় ভোটকে বড় বড় উৎসবগুলোর একটি ধরা হতো। বর্তমানে সেই উৎসবটা নেই। এখন ভোট আসে, ভোট যায় অনেক মানুষ জানেও না। জেনেও কি করবে। ভোট দিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত করারও উপায় নেই আর। এখন মিছিল হয় না, রাতভর নির্বাচনী আড্ডার আমেজও উধাও। এখন কয়েকজন প্রার্থী থাকবে। তারপর একজন বাদে বাকি সবাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবে। আর বেচারা জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য হা হুতাশ করবে। আগের সামাজিক সম্প্রীতি আর চোখে পড়ে না বলেই মনে করছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মতে, নির্বাচন না করেই চেয়ারম্যান পদে এত বেশি প্রার্থীর অভিষিক্ত হওয়া এই নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে। নির্বাচন যেহেতু অনেকের মধ্যে বাছাই, সেহেতু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে ‘নির্বাচিত’ হওয়া বলা যায় কি?
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় ভিত্তিক মনোনয়ন হচ্ছে। যারাই ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন তাদের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত এবং এর প্রতিফলন হচ্ছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া কিন্তু নির্বাচন নয়। এটা হচ্ছে নির্বাচন-নির্বাচন খেলা। নির্বাচন হলো বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকা। কিন্তু আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন। এই যে সহিংসতা দেখছি, মনোনয়ন বাণিজ্য দেখছি, এগুলো হলো রোগের উপসর্গ, রোগ নয়। এগুলোর কারণ হচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে সুবিধাবাদ। রাজনীতি হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণের জন্য, জনস্বার্থে। কিন্তু রাজনীতিটা হয়ে গিয়েছে ব্যক্তির স্বার্থে, গোষ্ঠীর স্বার্থে, অনেক সময় দলের স্বার্থে। অর্থাৎ রাজনীতিতে মানুষ এখন যুক্ত হয় কিছু পাওয়ার জন্য। তাই রাজনৈতিক দলের পদ-পদবী পেলে তারা রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হয়। বিভিন্ন রকম অন্যায় করে পার পাওয়ার সুযোগ পায়।
একাধিক নির্বাচন বিশ্লেষক বলছেন, বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে কারণ অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের
মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীই নির্বাচনে জিতবে ধরে নিয়ে অংশগ্রহণে উৎসাহ পাচ্ছে না।
পাশাপাশি এর সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাতের বিষয়টিও আছে। এর সঙ্গে আছে তৃণমূলের রাজনীতি ও
এমপির সমর্থন। ফলে রাজনীতি এখন একটি লাভজনক ব্যবসা, আর এ কারণে কথিত
নির্বাচনে মানুষের ভোটের কোনো স্থান নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭