ইনসাইড এডুকেশন

‘ক্লাসে যা পড়ায় তাতে হয় না’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 27/11/2017


Thumbnail

রাবেয়া বসরি। তেঁজগাও সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলের শিক্ষকের কাছেই গণিত এবং ইংরেজি বিষয়ে কোচিং করে সে। ক্লাসের বাইরে তাকে কোচিং করতে হচ্ছে। বাধ্য করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে বসরি বলে, ‘ক্লাসে যা পড়ায় তাতে হয় না। কোচিং তো করতেই হয়’। তার কথায় স্পষ্ট, সে নিজেই কোচিংকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ক্লাস যেনো ঐচ্ছিক বিষয়। কোচিংই একমাত্র ভরসা। বসরির অভিভাবকের মুখেও একই কথা। অভিভাবক জানান, ‘ভাল রেজাল্টের জন্য কোচিং করতেই হবে। ক্লাসে যে পড়া হয় তাতে ভাল রেজাল্ট করা যায় না।’ কোচিংয়ের পক্ষে এভাবেই সাফাই গাইলেন অভিভাবক। কোচিংয়ের আর্কষণীয় ব্যানার, পোস্টারে মুখরোচক প্রচারণা অভিভাবকদের মনমস্তিষ্কে গেঁথে গেছে গভীরভাবে।

নিজ স্কুলের শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীদের কোচিং করা নিষেধ জানালে ওই অভিভাবক এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকার নিয়ম করতে পারবে। আমার সন্তানকে কি ভাল রেজাল্ট দিতে পারবে? ক্লাসে ছেলেমেয়েরা পড়া ভাল করে বোঝে না। তাই কোচিং করাতে হয়। এটা বন্ধ করলেও লাভ নেই। ছেলেমেয়ে আমাদের। চিন্তা আমাদের। সরকারের তো কোনো মাথাব্যথা নেই’।

শিক্ষকরাও কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন ওতোপ্রতোভাবে। তাদের ভাষ্য, তারা পড়াতে না চাইলেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চাপ দেন। তাই অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও পড়াতে বাধ্যই হন।

তেঁজগাও সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, ‘কোচিং নিয়ে সরকার যে নীতিমালা প্রকাশ করেছে, সেটা মানা কঠিন। নীতিমালায় বলা হয়েছে, নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ানো যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের না পড়িয়ে পারছি না। অনেক সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চাপে বাধ্য হতে হয়। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা পড়তে চায় না’।

তিনি আরো বলেন, এক সময় শিক্ষক আর অভিভাবকদের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব ছিল। দেখা-সাক্ষাৎ হতো না বললেই চলে। মাঝে-মধ্যে রাস্তাঘাটে দেখা হলে অভিভাবক বলতেন, আমার সন্তানের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। এখন সেটা হয় না। শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকরা স্কুলে আসেন। ফলে তাদের সঙ্গে পড়ার বিষয় নিয়ে শিক্ষকদের কথা হয়। আর এর মধ্যেই কোচিংয়ের সূচনা ঘটে। ক্লাসে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীটি কোন শিক্ষকের কাছে কোচিং বা প্রাইভেট পড়ে, তা তার সহপাঠীরা না জানলেও অভিভাবকরা ঠিকই জানেন।



স্কুল, কোচিং তো রয়েছেই, অনেকে বাসায়ও গৃহশিক্ষক রাখেন। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। সকালে কোচিং শেষে স্কুলে যাওয়া, ছুটির পর বাসায় ফিরে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে রাতে স্কুলের হোম ওয়ার্ক। বিশ্রাম বা খেলাধুলা, কোনটারই সময় নেই। কখনো-সখনো সময় মিললে তা তারা কাটায় মোবাইলে গেমস খেলে। সার্বিক পরিস্থিতি রাশ টেনে ধরছে শিশুদের মানসিক বিকাশে।

২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ওই বছরের ২৫ জুন নীতিমালায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে সব বিষয়ের জন্য স্কুলভিত্তিক কোচিং ফি সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

নীতিমালায় বলা আছে, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতিসাপেক্ষে অন্য স্কুল, কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে নিজ উদ্যোগে পড়াতে পারবেন। বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করা যাবে না।

এই নীতিমালা বাস্তবায়ন নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়নে যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, তা নিতে পারেনি প্রশাসন।

ফার্মগেট এলাকায় রয়েছে অনেক কোচিং সেন্টার। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি কোচিং সেন্টারে চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তারা নিচ্ছে ভর্তি ফি ৫০০, মাসিক ফি আড়াই হাজার, নোট ফি ২ হাজার টাকা বাবদ প্রথম কিস্তিতেই ৫ হাজার টাকা।

ইহক কোচিংয়ের পরিচালক মাজহারুল জানান, ‘আমরা জোর করে কাউকে নিয়ে আসছি না। শিক্ষার্থীরা নিজ থেকেই আমাদের কাছে আসছে’।

কোচিংয়ের কারণে অভিভাবকদের আর্থিক ব্যয় বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগে খোদ শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কোচিং খাতে বার্ষিক লেনদেন প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।

তবে বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে, লেনদেনের এ অংক ৫০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। বস্তুত গোটা কোচিং ব্যবস্থাটিই অনৈতিক। এটি মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রতিবন্ধী করে ফেলেছে।

‘এ ব্যাপারে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?’ প্রশ্ন তোলেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নীতিমালা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে পাঁচ ধরনের শাস্তির কথা বলা ছিলো। তবে নীতিমালায় বাণিজ্যিক কোচিং বন্ধের কোন উল্লেখ নেই। এর সুযোগ নিয়ে অবাধে চালানো হচ্ছে কোচিং বাণিজ্য।

শিক্ষাবিদরা বলেন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চিন্তাধারায় আনতে হবে পরিবর্তন। আর শিক্ষকদের হতে হবে দায়িত্বশীল। তাঁরা যদি শ্রেণিকক্ষে দায়িত্ব নিয়ে পড়ান, তাহলে শিক্ষার্থীদের আর কোচিংয়ের অপেক্ষায় থাকতে হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক আ.ক.ম রহুল আমিন বলেন, কোচিং বাণিজ্য রোধে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সব মহলকে সচেতন হতে হবে। আইন প্রণয়ন করে এটা রোধ করা সম্ভব নয়। কোচিংয়ের নেতিবাচক দিকগুলো জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। তাহলে অনেকেই সচেতন হবে বলে ধারণা তাঁর।


বাংলা ইনসাইডার/এসএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭