ইনসাইড পলিটিক্স

অস্তিত্বের সংকটে হেফাজত?


প্রকাশ: 04/12/2021


Thumbnail

হেফাজতে ইসলাম এখন অনেকটাই অভিভাবকশূণ্য, দিশাহীন। একদিকে সিনিয়র নেতাদের একের পর এক মৃত্যু। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর। এক বছর দুই মাসে একে একে চলে গেলেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আল্লামা শফীসহ চার শীর্ষ আলেম। অন্যদিকে উগ্রবাদী ও সামনের সারির হেফাজত নেতাকর্মীদের অধিকাংশই এখন বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার। বিশেষ করে মামুনুল হকসহ বেশ কয়েকজন হেফাজত নেতাকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলাম আদর্শ বিচ্যুত হয়েছে অভিযোগে সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের দলত্যাগ ও পদত্যাগেরও হিড়িক চলছে। সিনিয়র নেতাদের মৃত্যু, গ্রেফতার এবং জনপ্রিয় নেতাদের পদত্যাগের ফলে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে সংগঠনটি।

কদিন আগেও হেফাজতের ঘোষিত যেকোনো কর্মসূচিতে সারাদেশে কিছু সময়ের জন্য হলেও একটা সংকট তৈরি করতো। হেফাজতের তাণ্ডবে দেশে সাময়িক অচলাবস্থা সৃষ্টি হতো। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, মোদি বিরোধী আন্দোলন সহ বিভিন্ন দাবিতে হেফাজত সরকারের নতুন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে হেফাজতের আমির আহমেদ শফির মৃত্যুর পর প্রয়াত জুনায়েদ বাবুনগরী যখন আমির হয়েছিলেন তখন হেফাজত সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। বিশেষ করে ভাষ্কর্য ইস্যুতে হেফাজত নেতাদের বেশ সরব দেখা গিয়েছিল। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তাণ্ডব চালায় হেফাজত। এরপর হেফাজতের নেতারা যেরকম উষ্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে সরকারের উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু সেই হেফাজত এখন আর নেই। বর্তমান হেফাজত স্পষ্টতই মিনমিনিয়ে কথা বলছে এবং হেফাজতের কথাবার্তার মধ্যে আগের সেই হুংকার তো নেই-ই, বরং এক ধরনের নিস্তেজ ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। হেফাজতের সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হকের নারী কেলেংঙ্কারিতে সংগঠিনটির নেতাদের বিরুদ্ধে নীতি-নৈতিকতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠে। এছাড়া মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ছেলে বলাৎকারের অভিযোগও উঠে। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের আদর্শ বিচ্যুত হয়েছে, মওদুদীর সালাফিবাদের চর্চা করছে এবং দেশের শান্তি শৃঙ্খলা এবং স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে- এমন সব অভিযোগ তুলে হেফাজতের নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ হাসানসহ অনেকেই গণহারে পদত্যাগ করেছিলেন। জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের আমির থাকা অবস্থাতেই হেফাজতের বেশ কয়েকজন নেতা যারা সরাসরি যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। আর সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় মামুনুল হকসহ বেশ কয়েকজন হেফাজত নেতাকে। এরপরই অনেকখানি দমে যায় হেফাজত।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক বছর পর অর্থাৎ ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ হয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের। এর প্রতিষ্ঠাতা আমীর ছিলেন প্রবীণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শাহ আহমদ শফী এবং মহাসচিব ছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী। ২০১১ সালে সরকার ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষণা করলে হেফাজতে ইসলাম প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা শুরু করে। তবে ২০১৩ সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মঞ্চের সংগঠকদের নাস্তিক-ব্লগার আখ্যা দিয়ে এবং যুদ্ধাপরাধীদের নামে আলেম-ওলামাদের বিচার করা হচ্ছে বলে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকেন সংগঠনটির নেতারা। আকস্মিকভাবে দেশে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের দাবি তুলে ২০১৩ সালের ৫ মে সারাদেশ থেকে লংমার্চ নিয়ে ঢাকার শাপলা চত্বরে যায় সংগঠনটির কয়েক হাজার নেতাকর্মী, যার মধ্যে অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। তবে প্রবীণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শাহ আহমদ শফীর জীবদ্দশায় তার সঙ্গে একাধিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাবুনগরী। লংমার্চ কর্মসূচির বছরখানেক পর থেকেই হেফাজতে ইসলামের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয় ধীরে ধীরে সামনে আসতে থাকে। ততদিনে দৃশ্যপটে চলে আসেন শফীর ছেলে হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী শিক্ষা সচিব আনাস মাদানি। তার নেতৃত্বে হেফাজতের একটি অংশ সরকারের প্রতি ‘কিছুটা নমনীয়’এবং বাবুনগরীর নেতৃত্বে আরেকটি অংশ ‘তীব্র সরকার বিরোধী’ অবস্থান নেয়। এর মধ্যে কওমি মাদরাসার ডিগ্রির সরকারি স্বীকৃতিও আসে। এভাবে শফীর নেতৃত্বে হেফাজতের একটি অংশ সরকারের বিরোধিতা থেকে সরে আসে। মূলত তখনই হেফাজতে ইসলাম শফীপন্থী ও বাবুনগরীপন্থী- এই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রায় শতবর্ষী শাহ আহমদ শফী মারা যান। এরপর তার জায়গায় আসেন জুনায়েদ বাবুনগরী। এভাবে চলতে চলতে এ বছরের গত ১৯ আগস্ট গুরুতর অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে মারা যান জুনায়েদ বাবুনগরী। তারপর দলটির আমীর পদে নির্বাচিত হন জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। তার বয়স নব্বইয়ের বেশি। আমির হওয়ার পর ইতোমধ্যে দুইবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি। তবে বর্তমানে তিনি অনেকটা সুস্থ।

এরমধ্যে গত সোমবার রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদীর। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। বর্তমানে অনেকটাই অভিভাবকহীন হেফাজতে ইসলাম। তাদের কথা না সরকার, না জনগণ- কেউই শুনছে না আর। তাদের অধিকাংশ নেতা এখনো কারাগারে। নেতারা এ নিয়ে স্বররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেও কিছু করতে পারেনি। সরকারের কৌশলের কারণে দেশের আলেম সমাজও হেফাজতের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে আলেম সমাজ প্রকাশ্যে হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এটি হেফাজতের জন্য অস্বস্তিকর এবং একই সঙ্গে বিব্রতকরও বটে। অনেকেই বলছেন, হেফাজত যে প্রকৃত ইসলাম না, এটি প্রতিষ্ঠা করে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে সরকারের। আর এর কারণেই এখন হেফাজতের ব্যাপারে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের আর আবেগ অনুভূতি কাজ করছে না। আর এই সরকারের কৌশলের কারণেই সংগঠন হিসেবে হেফাজত লণ্ডভণ্ড এবং অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭