ইনসাইড পলিটিক্স

ইউপি নির্বাচন: কর্মীর রক্তে রঞ্জিত আওয়ামী লীগ!


প্রকাশ: 05/12/2021


Thumbnail

সারাদেশে বিভিন্ন ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন চলছে। আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের দ্বন্ধে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাড়ছে প্রাণহানি, সেখানে অনেক জায়গায় যুক্ত হচ্ছে স্বতন্ত্র রুপে লুকিয়ে থাকা নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপি। জামায়াতও পেছন থেকে সহিংসতায় ইন্ধন দিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর ফলে উৎসবের নয়, বরং বিচ্ছেদে রুপ নিচ্ছে ইউপি নির্বাচনগুলো। স্বজন হারানো বাড়িতে কান্না ও প্রাণফাটা আহাজারি মানুষের মনে সৃষ্টি করেছে নিদারুণ কষ্ট। তৃণমূল যেন এক মৃত্যু উপত্যকা। এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ইউপি নির্বাচনী সহিংসতায় কমপক্ষে ৮৬ জনের প্রাণহাণির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আর গত এক মাসের নির্বাচনি সহিংসতায় ৪৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফোরাম (এমএসএফ)। আসক সূত্রে জানা যায়, নিহতদের বেশিরভাগই তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। সারাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিসহ দেশ ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি যখন সংকট তৈরিতে মুখিয়ে আছে, তখন কোন্দল-কাঁটায় বিদ্ধ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তৃণমূলে একের পর এক ঝরছে তাজা প্রাণ।

আসক এর তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৬৮৮টি নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন আট হাজার ৫৯৪ জন এবং নিহত হয়েছেন ১২৯ জন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগেরই ৫৭ জন। শুধুমাত্র ইউপি নির্বাচনেই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪৪২টি। এসব সহিংসতায় আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ২৩৪ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৬ জন। আসক ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জেলার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের অধিকাংশই আওয়ামী ঘরানার। 

তৃতীয় ধাপের সহিংসতা

সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর ছিল তৃতীয় ধাপের নির্বাচন। ভোট হয়েছে ৯৮৬ ইউপিতে। গত ২৫ থেকে ২৮ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভোলা ও টাঙ্গাইল জেলায় আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে অন্তত তিনজন নিহত হন। ভোটের দিন টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, খুলনা, যশোর, ঠাকুরগাঁও ও মুন্সীগঞ্জে সংঘাতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। তৃতীয় ধাপের এ নির্বাচন চলাকালে এবং এর আগে ও পরের সংঘাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ ঝরেছে কমপক্ষে ১৫ জনের, আহত হয়েছেন শতাধিক। ভোটের দিন সংঘর্ষে মৃত্যু হয় আটজনের।

ভোলা: গত ২৬ নভেম্বর ভোলা জেলার সদর উপজেলায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে মো. খোরশেদ আলম টিটু (৩২) নামে এক যুবলীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। নিহত খোরশেদ উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইনগর গ্রামের তছির আহম্মেদের ছেলে ও ওই ইউনিয়নের যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

পিরোজপুর: ১৬ই নভেম্বর নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে পিরোজপুরের যুবলীগের নেতা ফয়সাল মাহবুবের। ৭ই নভেম্বর পিরোজপুরের শংকরপাশা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন হাসপাতালে। ফয়সাল জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) ছিলেন।

লক্ষ্মীপুর: জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সজিব হোসেন নিহত হয়েছেন। ভোটকেন্দ্র এলাকায় সহিংসতায় প্রথমে আহত ও পরে ঢাকায় নেওয়ার পথে চাঁদপুরে অ্যাম্বুলেন্সে মারা যান তিনি। নিহত ছাত্রলীগ নেতা সজিব হোসেন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহেনাজ আক্তারের সমর্থক ছিলেন।

টাঙ্গাইল: তৃতীয় ধাপের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে হামলা, সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় তোতা শেখ (৪০) নামে এক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলের মৃত্যু হয়। নিহত তোতা শেখ উপজেলার দপ্তিয়র ইউনিয়নের রেহাই পাইকাইল গ্রামের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আক্কেল মেম্বারের ছেলে বলে জানা গেছে। 

শরীয়তপুর: ২৬ নভেম্বর নির্বাচনের আগেই শরীয়তপুর সদর উপজেলার আঙ্গারিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের (নৌকা) চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক আব্দুর রাজ্জাক মোল্লাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা।

খুলনা: তৃতীয় ধাপের সহিংসতায় খুলনার তেরখাদা উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নে বাবুল শিকদার (৩৮) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. মহসিনের সমর্থক ছিলেন। ভোটের প্রচার চালানোর সময় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকরা তাকে হাতুড়িপেটা ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। 
 
কক্সবাজার: জেলার চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের নতুন চেয়ারম্যান নুরে হোছাইন আরিফের ভাগনে গিয়াস উদ্দিন মিন্টুকে (৫০) পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ফল ঘোষণার পর। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আরিফ জয়ী হন। ফল ঘোষণার পর বিজয় মিছিলে চশমা প্রতীকের বিদ্রোহী প্রার্থী হেফাজ সিকদারের লোকজনের হামলায় মারা যান তিনি।

যশোর: ভোটের আগের রাতে ২৭ নভেম্বর যশোরের শার্শার কয়রা ইউনিয়নে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কুতুব উদ্দিন (৩০) নামে একজন নিহত হন। নিহত কুতুব উদ্দিন রুদ্রপুর গ্রামের মহিউদ্দিনের ছেলে ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী চেয়ারম্যান প্রার্থী আলতাফ হোসেনের সমর্থক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: জেলার নবীনগরে নির্বাচনী বিরোধকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম মোস্তফা মারুফের সমর্থক মাসুদ মিয়াকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় নেয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। নিহত মাসুদের বাড়ি উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নে খাগাতুয়া গ্রামে।
 
নরসিংদী: গত ২৪ নভেম্বর নরসিংদীর রায়পুরার চান্দেরকান্দি ইউনিয়নে ব্যালটবাক্স ছিনতাই চেষ্টাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে আরিফ মিয়া (২৪) ও শরিফ নামে দু’জন নিহত হন। চান্দেরকান্দি ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন খোরশেদ আলম। আনারস প্রতীকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন মেছবাহ উদ্দিন খন্দকার মিতুল। এ দুপক্ষের সংঘর্ষে এদের মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে। একই উপজেলার উত্তর বাখরনগর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ফরিদ মিয়া (৩২) নামে একজন নিহত হন। এরা সকলেই আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে জানা গেছে।

কুড়িগ্রাম: গত ২৪ নভেম্বর কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় ভাঙামোড় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় বাবুল মিয়া (৪০) নামে একজন নিহত হয়েছেন। 

মুন্সীগঞ্জ: মুন্সীগঞ্জে সদর উপজেলায় ইউপি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর পৃথক সহিংসতায়  রিয়াজুল শেখ (৭০) ওশাকিল (১৭) নামের দু’জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।  রিয়াজুল মুক্তারপুর গোসাইবাগ এলাকার বাসিন্দা। নিহতের ভাই মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী পঞ্চসার ইউনিয়ন পরিষদের টেলিফোন প্রতীকে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।  নিহত শাকিল শরীয়তপুরের মোহাম্মদ হারুন মোল্লার ছেলে। শাকিল ওই ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য রাবেয়া বেগমের ভাগনে ছিলেন। 

কিশোরগঞ্জ: গত ২৮ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া আবদুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ এনামুল হক ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাইফুল ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে দেলোয়ার হোসেন (৩৮) নামে একজন মারা যান। দেলোয়ার বিদ্রোহী প্রার্থী সাইফুল ইসলামের সমর্থক হিসেবে পরিচিত।

এছাড়া সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় নির্বাচনী সহিংসতায় আহত স্কুলছাত্র দেলোয়ার হোসেন সাগর (১৬) নামে একজন মারা গেছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত চারজন হলেন- ঘিডোব গ্রামের অবিনাশ রায়ের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী আদিত্য কুমার রায় (২৩), আবদুল বারীর স্ত্রী রহিমা বেগম (৬৪), হাবিবপুর গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে মো. সাহাবুলি (৩৬) ও ছিট ঘিডোব গ্রামের মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে মোজাহারুল ইসলাম (৩৭)।

দ্বিতীয় ধাপের সহিংসতা

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১১ নভেম্বর। দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ১১ জনের৷ এর মধ্যে ভোটের দিনই প্রাণ হারান সাত জন। এদের মধ্যে নরসিংদীতে সাত জন, কুমিল্লায় দুইজন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে একজন করে মারা গেছেন৷  নির্বাচনের পরদিন ধামরাই ও রাজবাড়ীতে সহিংসতায় আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে ধামরাইয়ে দুইজন ও রাজবাড়ীতে ১ জন।  

নরসসিংদী: দ্বিতীয় ধাপে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে নরসিংদীতে। সদর ও রায়পুরা উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সহিংসতায় ৯ জন নিহত হন। এর মধ্যে নির্বাচনের আগে ৬ জন এবং নির্বাচনের দিন সহিংসতায় নিহত হন আরও ৩ জন। এদের সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গত ৪ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নরসিংদীর সদর উপজেলার আলোকবালী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন নিহত ও আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। নিহতরা হলেন, নেকজানপুর গ্রামের কটুমিয়ার ছেলে আমির হোসেন (৪৫), একই গ্রামের আবদুল জলিলের ছেলে আশরাফুল (২২), আব্দুল মনু মিয়ার মেয়ে খুশি বেগম (৫০) ও অজ্ঞাতনামা আরও একজন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত তিনজনই আলোকবালী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের কর্মী-সমর্থক। বর্তমান চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন সরকারের সঙ্গে প্রতিপক্ষ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহর দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। কিছুদিন পরপরই দুই পক্ষের সমর্থকেরা টেঁটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। 

এর আগে ২৮ অক্টোবর নরসিংদীর রায়পুরায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক প্রার্থী আশরাফুল হক সরকারের সমর্থকদের সাথে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিন জন মারা গেছেন৷ নিহতরা হলেন, বাঁশগাড়ি এলাকার দুলাল মিয়া (৪৫), সালাউদ্দিন (৪১) ও জাহাঙ্গীর মিয়া (২৬)৷ এরা সকলেই আওয়ামী লীগের কর্মী। একই দিনে কাচারিকান্দি গ্রামে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন সাদির মিয়া ও হিরণ নামের দুই ব্যক্তি। 

মেহেরপুর: গত ৮ নভেম্বর মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর ধলাগ্রামে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে দুই ভাই জাহারুল ইসলাম (৫৪) ও সাহাদুল ইসলাম (৫১) নিহত হন। নিহত দু'জনই আওয়ামী লীগের সমর্থক ও ইউপি সদস্য প্রার্থী আযমাইন হোসেন টুটুলের চাচাতো ভাই ছিলেন।
 
ভোলা: ভোলা জেলার সদর উপজেলায় শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে মো. খোরশেদ আলম টিটু (৩২) নামে এক যুবলীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। নিহত খোরশেদ উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইনগর গ্রামের তছির আহম্মেদের ছেলে ও ওই ইউনিয়নের যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
 
রাজবাড়ী: গত ১১ নভেম্বর রাজবাড়ী সদর উপজেলায় নিজ বাড়ির সামনে আওয়ামী লীগের এক নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

কক্সবাজার: গত ৫ নভেম্বর শুক্রবার রাতে কক্সবাজারের ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সদস্যপ্রার্থী কুদরত উল্লাহ সিকদার ও তার ভাই জহিরুল ইসলাম সিকদারকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। গুলিবিদ্ধ জহিরুল ইসলাম দুই দিন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি ছিলেন।

পাবনা: গত ০৯ নভেম্বর পাবনার সুজানগর উপজেলার ভায়না ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিপক্ষের হামলায় সবুজ হোসেন (২৮) নামে একজন মারা গেছেন।  সুজানগরের চলনা গ্রামের হাচেন আলীর ছেলে সবুজ ভায়না ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুকের সমর্থক বলে জানা গেছে। সোমবার রাতে ভায়না ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আমিন উদ্দিন আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ওমর ফারুকের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে সবুজ প্রথমে আহত ও পরে নিহত হন।
 
যশোর: ২৩ অক্টোবর যশোরের শার্শার গোঁগাতে ইউপি নির্বাচন নিয়ে দলীয় কোন্দলে সহিংসতায় আহত ও পরে মারা যান আওয়ামী লীগ নেতা আলী হোসেন। ১৮ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। নিহত আওয়ামী লীগ নেতা আলী হোসেন শার্শার গোঁগা ইউনিয়নের পাঁচভুলোট  ২ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের গ্রাম কমিটির সভাপতি এবং  স্বতন্ত্র ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী তবিবরের সমর্থক  ছিলেন।

সিলেট: দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ২৩ অক্টোবর সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক আলাউদ্দিন ওরফে আলাল (৪৫) নামে একজনকে দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একদল লোক অতর্কিত হামলা করে। তাঁর ঘাড়ে ও মাথায় এলোপাতাড়ি দা দিয়ে কুপিয়ে মাটিতে ফেলে চলে যায় হামলাকারীরা। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। নিহত আলাল আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ওবায়েদ উল্লাহ ইসহাকের একজন সমর্থক বলে জানা গেছে। 
   
কুমিল্লা: দ্বিতীয় ধাপে কুমিল্লায় নির্বাচনের 'ঝগড়াঝাঁটি'তে মেঘনা উপজেলার বাহুরখলা ইউনিয়নের হিরারচর গ্রামের মৃত মুদাফর আলীর ছেলে সানাউল্লাহ ডালি (৬০) ও মানিকচর ইউনিয়নের বল্লবেরকান্দি গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে শাওন আহমেদ (২৫) মারা গেছেন৷ মানিকরচর ইউনিয়নের আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাহুরখলা ইউনিয়নের খিলারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জাকির হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হারুন অর রশিদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তাদের মৃত্যু হয়৷ স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তারা হারুন অর রশিদের সমর্থক।
 
চট্টগ্রাম: কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকূল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷ সাধারণ সদস্য প্রার্থী আনোয়ারা বেগম ও আবু বক্কর সিদ্দীকের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে আক্তারুজ্জামান পুতু (৩২) মারা যান৷ দুই প্রার্থীই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে৷ পাশাপাশি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতেও মাহবুব ও ফোরকান নামের দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মোহাম্মদ শফি (৫৫) নামে একজন নিহত হয়েছেন৷ দুই সদস্য প্রার্থীই আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা৷

ফরিদপুর: ২৩ অক্টোবর ফরিদপুরের সালথার যদুনন্দী ইউনিয়নের খারদিয়া গ্রামে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে মারিজ সিকদার (৩০) নামের একজন নিহত হন। মারিজ সিকদার গ্রাম্য মাতবর ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো: রফিক মোল্যার সমর্থক ছিলেন। পরের দিন ২৪ অক্টোবর সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক আলাউদ্দিন ওরফে আলাল (৪৫) প্রতিপক্ষের আঘাতে নিহত হন। 

কাপ্তাই: গত ১৭ অক্টোবর রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার সদর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নেথোয়াই মারমাকে নিজ বাসায় গুলি করে হত্যা করে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত।
 
মাগুরা: গত ১৫ অক্টোবর মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য প্রার্থী নজরুল ইসলাম ও সৈয়দ হাসান আলীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। তারা হলেন- সৈয়দ হাসান আলীর পক্ষের সবুর মোল্লা, তার আপন ভাই কবির মোল্লা ও চাচাতো ভাই রহমান মোল্লা এবং অপর পক্ষের ইমরান হোসেন নামের এক যুবক। নিহতরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তারা দলের কোনো পদে ছিল না বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

প্রথম ধাপের সহিংসতা

প্রথম ধাপে ২০৪টি ইউপির নির্বাচন হয়েছে ২১ জুন আর ১৬০টি ইউপির নির্বাচন হয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর। প্রথম ধাপেও নির্বাচন কমিশন সহিংসতা এড়াতে পারেনি। এ নির্বাচনে তিনজন নিহত ও অনেকে আহত হওয়ার খবর মিলেছে। 

কুতুবদিয়া: প্রথম ধাপের ভোটে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় নির্বাচনী সহিংসতায় ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে আবদুল হালিম (৩৫) নামে আওয়ামী লীগের এক নেতা নিহত হয়েছেন। তিনি বড়ঘোপ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বড়ঘোপ ইউনিয়নের পিলটকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট চলাকালে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় তার মৃত্যু ঘটে। 
 
মহেশখালী: গত ২০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের একটি ভোট কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শেখ কামাল ও বিদ্রোহী প্রার্থী মোশাররফ হোসেন খোকনের সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় আবুল কালাম নামে একজন মারা গেছেন। তিনি নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী শেখ কামালের সমর্থক ছিলেন। এর আগে গত ২৩ জুন মাদারীপুরের শিবচরে ভোট চাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে শ্রমিক লীগ নেতা আবু বক্কর নিহত হন।

একই দিনে ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায় ইউপি নির্বাচনে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এক কলেজছাত্র নিহত হন এবং আহত হন অন্তত ১৫ জন। মাস ছয়েক আগে নরসিংদীর রায়পুরার পাড়াতলী ইউনিয়নের নির্বাচনী সহিংসতায় ইয়াসিন ও শাহিন নিহত হন।

বরিশাল: গৌরনদীতে নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হন দুজন। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নসহ কয়েকটি স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচজন আহত হন। তারা স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মোল্লা মাবুবুর রহমানের সমর্থক। নৌকার প্রার্থী কুদ্দুসের ভাই শেখ হায়দার আলীর নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ উপজেলায় মাগুরখালী ইউনিয়নের গজালিয়া গ্রামে নৌকার প্রার্থীর এক কর্মীকে মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের বিরুদ্ধে।

মাদারীপুর: গত ২২ জুন মাদারীপুরের শিবচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনের আগের রাতে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে প্রথমে আহত ও পরে নিহত হন শ্রমিক লীগ নেতা আবু বকর ফকির (৪৬)। নির্বাচনে বিজয়ী আজিজুল সরদারের সমর্থক ছিলেন তিনি।

বরিশাল: বছরের শুরুতে ১৮ জানুয়ারি  বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে নির্বাচনী সহিংসতায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আফসার সিকদার নিহত হন। নিহত আফসার সিকদার পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনি পেশায় মোটরসাইকেল গ্যারেজের মালিক।

এছাড়া ফরিদপুর ও সিলেট একজন করে নিহত হয়েছেন। আরও কয়েকটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং বিভিন্ন স্থানে এসব সংঘর্ষে কয়েকশ’ মানুষ আহত হয়েছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, এই সংঘাত ও সহিংসতা ঠেকাতে না পারার জন্য প্রধানত নির্বাচন কমিশনই দায়ী। আর এমন পরিস্থিতি দেখে নির্বাচন কমিশন আছে কী নাই সেই প্রশ্ন উঠছে। তারা বিব্রত হলে নাগরিকেরা কি করবেন? আমি তো শুনেছি নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন তাদের দায় নেই। সহিংসতা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সময় তা ঠেকাতে পারছে না। ফলে বলতেই হয় তারা দায়িত্ব পালন করছেন না। দায়িত্ব পালন করলে আমরা ব্যবস্থা নিতে দেখতাম। যেখানে কারচুপি, সহিংসতা হয়েছে সেখানে নির্বাচন স্থগিত করতে দেখতাম, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখতাম। তা তো দেখি না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়ী হয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে। তা নিচ্ছে না বলেও জানান তিনি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭