ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

সু’চি এবং কারাগার: এক লাটাই সুতোর গল্প


প্রকাশ: 06/12/2021


Thumbnail

সালটা ১৯৮৮। অসুস্থ মৃতপ্রায় মায়ের সেবার জন্য ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড থেকে দেশে ফিরে আসেন অং সান সু চি। মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক ও তুমুল জনপ্রিয় নেতা অং সানের কন্যা তিনি। তুমুল জনপ্রিয় এই সামরিক নেতা দেশকে ব্রিটিশ বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার পথ তৈরি করে গিয়ে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজে সেই স্বাদ গ্রহণ করতে পারেননি। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সদ্য জন্ম নেওয়া দেশটি বেশিদিন গণতন্ত্রর স্বাদ উপভোগ করতে পারেনি, তার আগেই ১৯৬২ সালের ২ মার্চ দেশটিতে প্রথম সামরিক শাসনের শুরু হয়। সেই থেকেই অপার সম্ভাবনার দেশটি জ্বলছে বিদ্রোহের আগুনে। সেই আগুনে যেনো এক চামচ ঘি নয়, বরং আস্ত আগ্নেয়গিরি মতো বিস্ফোরণ ঘটান অং সান সু’চি দেশে ফিরে এসে। অসুস্থ মায়ের সেবা করতে এসে এক ছাত্র বিক্ষোভে অংশ নিলে সেখানে তার বাবার প্রতি মানুষের অপার ভালবাসা তাকে বিমোহিত করে। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নিজ দেশের গণতন্ত্র উদ্ধারে বিদেশের সুখের জীবন, স্বামী, দুই সন্তান ছেড়ে মিয়ানমারেই অবস্থান করবেন। 

১৯৮৮ সালের সেই ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পর পরই তিনি সামরিক জান্তার রোষানলে পড়ে যান। ১৯৮৯ সালে প্রথম তাকে বন্দি করে সামরিক সরকার। তার দেশের মানুষের প্রতি নিষ্ঠা আর একাগ্রতা তাকে বিশ্ব দরবারেও তুমুল জনপ্রিয় করে তুলে। গৃহবন্দী থাকা অবস্থাতেই ১৯৯১ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। তাকে অনেকেই এশিয়ার নেলসন মেন্ডেলার সাথে তুলনা করতে শুরু করে। মিয়ানমারে প্রবেশে পর তিনি বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় ২১ বছর গৃহবন্দী হিসেবে থেকে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সর্বশেষ তিনি ২০১০ সালে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হন। এর পর তিনি তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে সচেষ্ট হন এবং ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয় লাভ করে মিয়ানমারের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে সক্ষম হন।  

তবে তার সকল সংগ্রাম যেনো তিনি নিজ হাতে বাতাসে উড়িয়ে দেন, যখন ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির আরাকান অঞ্চলে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর বর্বর গণহত্যা পরিচালনা করে। সেই সময় তিনি অনেককে অবাক করে দিয়ে একেবারে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেন এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই অন্যায়কে সমর্থন যোগান। তার এই মনোভাবের আরো প্রকোপ বোঝা যায়, যখন তিনি রোহিঙ্গা হত্যা নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে ২০১৯ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে দাড়িয়ে যুক্তি প্রদর্শন করেন এবং কোন প্রকার গণহত্যা আরাকানে যে সংগঠিত হয়নি, তার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তার এমন আচরণে বিশ্ববাসী বেশ বিস্ময় প্রকাশ করে কিন্তু তিনি তার মতের পক্ষে নিরবিচ্ছিন্নভাবে যুক্তি প্রদর্শন করে যান। আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর এমন নির্যাতনে সেনাবাহিনীর পক্ষে কথা বলায় তিনি নিজ দেশের মানুষের কাছেই বেশ সমালোচিত হন। বিশ্ববাসীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকে। 

২০২০ সালের নভেম্বর মাস। সাধারণ নির্বাচনে ৭৯ শতাংশ ভোট পেয়ে তার দলে তখন সাজ সাজ রব। আবারও সরকার গঠনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। ঠিক এমন সময় দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষার মতো করেই যেন আচমকা বিপর্যয় নেমে এলো সুচির জীবনে। যে সেনাবাহিনীকে বাঁচাবার জন্য সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে নিজের অধ্যায়কে তিনি করেছিলেন প্রশ্নবিদ্ধ ও কালিমাময়, ঠিক এই সেনাবাহিনীই তাকে ক্ষমতা গ্রহণের ঠিক আগমুহূর্তে গ্রেপ্তার করে। সু’চিকে বন্দী করার পিছনে সেনাবাহিনীর যুক্তি ছিলো ২০২০ সালের নির্বাচনে তার দল ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। এজন্য তারা সে নির্বাচনের ফলকে অবৈধ বলে সারা দেশব্যাপী সু’চির দলের লোকদের ধরপাকড় শুরু করেন। এসময় সু’চির বিরুদ্ধে ১১ মামলা দায়ের করে সেনাবাহিনী। এই সবগুলো মামলার শুনানি চলছে সামরিক আদালতে। 

সু’চির বিরুদ্ধে আনিত মামলাগুলোর মাঝে আছে নির্বাচনে কারচুপি, জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়া, কোভিড নিয়ম ভঙ্গ করা, দুর্নীতি, গোপনীয়তা লঙ্ঘন সহ আরো অনেক।

আজ (৬ ডিসেম্বর) সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উস্কে দেওয়া এবং কোভিড নিয়ম ভঙ্গ করার অভিযোগে তাকে চার বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে সামরিক আদালত। সু’চির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সবগুলো প্রমাণিত হলে তার কমপক্ষে যাবত জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। 

একপলকে দেখে নেয়া যাক সু’চির জেল জীবন: 

২০ জুলাই, ১৯৮৯: বিরোধী এনএলডির সাধারণ সম্পাদক অং সান সু চিকে রাজ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে আটক করা হয় এবং রেঙ্গুনের ৫৪ ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউতে তার মায়ের বাড়িতে গৃহবন্দী করা হয়।

২৭ মে, ১৯৯০: গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় এনএলডি নব্বইয়ের সাধারণ নির্বাচনে ৮২ শতাংশের মত আসনে জয় লাভ করে। তবে নির্বাচনের সে ফলাফল সামরিক বাহিনী অস্বীকৃতি জানায়। 

১০ জুলাই, ১৯৯৫: ছয় বছর গৃহবন্দী থাকার পর ৯৫ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। 

৯ নভেম্বর, ১৯৯৬: রেঙ্গুনে অং সান সু চি এবং এনএলডি নেতা ইউ টিন উর সাথে একটি এনএলডি মোটর শোভাযাত্রায় প্রায় ২০০ জন লোকের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন। বিশ্বাস করা হয় আক্রমণকারীরা সামরিক বাহিনীর সমর্থক ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএসডিএ) সদস্য। এই গোষ্ঠীটি সু’চির গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে। সামনে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা থাকার পরও তারা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে কোন প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। 

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০০০: অং সান সু চিকে আবারো গৃহবন্দী করা হয়। যদিও তার কার্যক্রম ১৯৯৭ সালের শুরু থেকে কঠোরভাবে সীমিত করে দেওয়া হয়। 

৬ মে, ২০০২: সু’চিকে আবারো গৃহবন্দিত্ব থেকে পুনরায় মুক্তি প্রদান করে সামরিক জান্তা বাহিনী। এদিন তার বাড়ির সামনে হাজারো মানুষ ভিড় জমায় সমর্থন জানানোর জন্য। 

৩০ মে, ২০০৩: সরকার সমর্থিত একটি গোষ্ঠী আবারো সুচির উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে চারজন এনএলডি সমর্থক বডিগার্ড নিহত হন। এরপর পরই সেনাবাহিনী তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে ইনসেইন কারাগারে বন্দী করা হয়। আক্রমণের তিন মাস পর তাকে তার বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানেই তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। 

২৫ মে, ২০০৭: সামরিক জান্তা অং সান সু’চির গৃহবন্দিত্বের মেয়াদ আরও এক বছরের জন্য বাড়ায়।

২৮ মে, ২০০৮: ১৯৭৫ সালের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আইন মোতাবেক, "তার মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আদেশ" এর অধীনে অং সান সু চি'র আটকের আদেশ ২৭ মে, ২০০৯ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। 

১০ আগস্ট, ২০০৯: সামরিক জান্তার প্রধান, প্রেসিডেন্ট সিনিয়র জেনারেল থান শোয়ে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে একটি নির্দেশনা জারি করেন যে আদালতের রায় যাই হোক না কেন, সু চির সাজা অর্ধেক হবে এবং তাকে গৃহবন্দী অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

৪ ডিসেম্বর ২০০৯: সুপ্রিম কোর্ট অং সান সু চির গৃহবন্দি আদেশের আপিল বিবেচনা করতে সম্মত হয়।

১৮ জানুয়ারি, ২০১০: সুপ্রিম কোর্ট সু চির আইনজীবীদের বর্ধিত গৃহবন্দিত্বের আপিলের চূড়ান্ত যুক্তি বিবেচনা করে। আদালত ঘোষণা করে এটির বিষয়ে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত রায় প্রদান করবে।

১৩ নভেম্বর, ২০১০: গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান অং সান সু’চি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭