ইনসাইড আর্টিকেল

বেগম রোকেয়াই নারী মুক্তির দিশারি


প্রকাশ: 09/12/2021


Thumbnail

আধুনিক যুগে বাঙালির ইতিহাসে যে নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় তিনি হলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (বেগম রোকেয়া)। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার মাধ্যমে নারীর সচেতনতা আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করে নারীর সামাজিক অবস্থান দৃঢ় করা সম্ভব। একই সঙ্গে শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিষয়টিকেও তিনি প্রাধান্য দিতেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একদিন নারীরা সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। রাষ্ট্রের কর্ণধার হবে। বিচারকের আসনে বসবে। বেগম রোকেয়ার লালিত সে স্বপ্ন শতভাগ পূরণ হওয়ার পথে। আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা নারী। মাঠের বিরোধী দলের নেতাও নারী। এমকি সংসদের স্পিকারও একজন নারী। 

নারীরা নিজ নিজ যোগ্যতা, মেধা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এখন সবখানেই নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন। আমাদের দেশের নারীদের সরব অবস্থান এখন কেবল পরিবারেই সীমাবদ্ধ নেই, সমাজের বিভিন্ন স্তরে যেমন- প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার ভিডিপি, বিজিবি, বিমান পরিচালনা, ট্রেন পরিচালনা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, শিক্ষকতা, নার্সিং, রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতি- সর্বত্রই এখন নারীর বিচরণ ও অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দীর্ঘতম নারী শাসক। বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে নারী রয়েছে, সচিবও রয়েছে বেশ কজন। নারী উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিদের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে নারী রয়েছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নারী বিচারপতি নিয়োগ প্রদানের মধ্যে নারী ক্ষমতায়নের নতুন মাইলফলক যুক্ত হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি পদে রয়েছে বেশ কজন নারী, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনে নারী সদস্য কাজ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নারী। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতকরা ৬০ ভাগ নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী। এ নারী ঘর সামলায়, সন্তানের জন্ম দেয় এবং তাদের লালন-পালন করে, বাইরে কাজ করে পুরুষের পাশাপাশি।

বাংলার নারী সমাজের মুক্তির অগ্রদূত ও জ্ঞানের আলো সঞ্চারিণী এই মহীয়সী নারী ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত ‘পায়রাবন্দে’ বিখ্যাত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পরিবারে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার প্রচলন ছিল। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহার ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। পাশাপাশি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তার পরিবার ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। সেসময় তাদের পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোন চল ছিল না। আর তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভেরও কোন সুযোগ ছিল না। তবে যারা রাস্তা তৈরি করে মুক্তির পথ দেখায়, তারা কি আর প্রথার ধার ধারে? 

পারিবারিক প্রথা ভেঙ্গে প্রথমে বেগম রোকেয়ার দুই সহোদর ভাই ইব্রাহিম সাবের ও খলিলুর রহমান সাবের সর্বপ্রথম ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তার দুই ভাই কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে শিক্ষালাভ করেছিলেন। বেগম রোকেয়াও প্রথম জীবনে দুই দাদার কাছে গোপনে একটু আধটু উর্দু ও বাংলা পড়তে শেখেন। পাশাপাশি তার বড় বোন করিমুন্নেসাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। শিক্ষালাভ ও মূল্যবোধ গঠনে বড় দুভাই ও বোন রোকেয়ার জীবনকে প্রভাবিত করলেও বিয়ের পর স্বামীর সাহচর্যে তার আসল লেখাপড়া শুরু হয়েছিল।

১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভাগলপুর নিবাসী খান বাহাদুর সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন সে আমলে প্রথমসারির উল্লেখযোগ্য মুসলিম গ্র্যাজুয়েট (১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে মোহসেনের হুগলী কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন)। কর্মজীবনের শুরুতে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।তার স্বামী ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর মাত্র ২ বছর পরেই ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে স্বামীর সঞ্চিত দশ হাজার টাকা নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ কলকাতার তালতলা অঞ্চলে ১৩নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের ভাড়া বাড়িতে মাত্র দুটো ক্লাসরুম, দুইখানা বেঞ্চ আর ৮ জন ছাত্রী নিয়ে স্কুলের যাত্রা শুরু করেছিলেন। স্বামীর নামানুসারে স্কুলের নাম দিয়েছিলেন ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’।

বেগম রোকেয়ার সাহিত্যচর্চ্চার সূত্রপাতও হয়েছিল স্বামীর অনুপ্রেরণায়।  ১৯০২ সালে 'পিপাসা' নামে একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্যে দিয়ে তার সাহিত্যজীবন শুরু হয়। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ছিল প্রবন্ধ সংকলন 'মতিচুর' এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি 'সুলতানার স্বপ্ন', পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুবেহ সাদেক, অর্ধাঙ্গী, জাগো হে ভগিনী, স্ত্রী জাতির অবনতি, গৃহ ইত্যাদি। তার 'সুলতানার স্বপ্নকে' বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসাবে ধরা হয়।

ধর্ম এবং সমাজের অনেক রীতিনীতি বেগম রোকেয়া মেনে নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু একটা রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়ে ওঠার পরেও তিনি সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে এগোতে পেরেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নারী সমাজকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি কখনই সম্ভবপর নয়। সারা জীবন তিনি পিছিয়ে থাকা নারী সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে অধিকার সচেতন করে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধিসহ পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন এবং নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করলে দেশ এগিয়ে যাবে, নারীর পূর্ণ জাগরণ ঘটবে। ঘটবে স্বাধীনসত্তার বিকাশ। বেগম রোকেয়া এমনই স্বপ্ন দেখতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তার স্বপ্ন সফল হোক। আজ স্বপ্নীল এই মনীষীর জন্মবার্ষিকী, একই সঙ্গে মৃত্যুবার্ষিকীও। রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিনে তাকে সশ্রদ্ধ স্মরণ করছি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭