ইনসাইড টক

‘নারীদের প্রতিকূল অবস্থা দূর করতে নারীবান্ধব হওয়া প্রয়োজন’


প্রকাশ: 18/12/2021


Thumbnail

সামাজিক কর্মী, নারীবাদী, এবং পরিবেশবাদী খুশি কবির বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের এলমা চৌধুরী মেঘলা নামে মেয়েটি নির্যাতনের মুখে মৃত্যুবরণ করার ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। ৭১ এ যে স্বপ্ন নিয়ে সকল মানুষ তার নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা নিজের জীবনের কথা চিন্তা করেনি। তাদের ঘরবাড়িতে কি হবে না হবে চিন্তা না করে দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল। এ যুদ্ধে আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষ শহিদ হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে আমরা যদি দেখি যে, এত শহিদ এত সংঘর্ষের পরও নিরাপত্তার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধটি হয়েছে। ওই নয় মাস নারী পুরুষ নির্বিশেষে কোনো আদিবাসী বাঙালি, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, যাই হোক, সবাই একসাথে যুদ্ধ করেছে। তখন কিন্তু কোনো ভেদাভেদ ছিল না। নারীর ওপর স্বামীসহ শশুর বাড়ির নির্যাতন এই স্বাধীনতা যুদ্ধ, ত্যাগ এ সব সবকিছুর পরিপন্থী।   
 
বিয়ের পর স্বামীর ঘরে তরুণীদের নির্যাতন, পুরুষতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খুশি কবির বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। পাঠকদের জন্য খুশি কবির এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডার এর নিজস্ব প্রতিবেদক অলিউল ইসলাম।

খুশি কবির বলেন, নারীদের সারাটা জীবনই অনিশ্চয়তায় কাটে। নিজের বাড়িতে অনিশ্চয়তা। বিয়ের জন্য ওঠেপড়ে লাগা। মনে করে যে, মেয়ের একমাত্র গন্তব্যস্থল হলো তার শশুরবাড়ি। বিয়ের পর সেখানে গিয়ে তো আরও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বারবার। এটা আমাদের জন্য খুবই দু:খজনক ব্যাপার। 

তিনি বলেন, আমাদের একটি স্বপ্ন ছিল। এ স্বপ্ন ছিল দেশের ৫০ ভাগ নারীদের নিয়ে। আমরা তো ৫০ ভাগ। নারীরা যে এত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে এটা কল্পনাও করিনি। আমি ৭২ সালে গ্রামে-গঞ্জে মানুষের সাথে কাজ শুরু করেছিলাম। তার আগে তো আমি ঢাকা শহরে ছিলাম। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি সাধারণ মানুষ, গ্রামের মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। তখন রাস্তাঘাট ভাঙা ছিল। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল। মানুষের নিজের জীবনধারণ করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। তখন কিন্তু আমি একা। একদম একা একা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতাম। তখনকার বাসগুলো এখনকার বাসগুলোর মতো এত চকচকে-ঝকঝকে ছিল না। ভাঙাচোরা ছোট ছোট বাস। একটা বাস থেকে নেমে আরেকটা বাস, তারপর ওইটা থেকে নেমে আরেকটা। এভাবে ভেঙে ভেঙে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের কাছে যেতে হতো আমাদের। কিছু ট্রেন, কিছু বাস, কিছু লঞ্চের মাধ্যমে আসা যাওয়া করতে হতো। তখন কিন্তু আমি কোনোদিন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি। তখনকার বাংলাদেশে চেতনার এমন অবস্থা ছিল যে, আমি একা অবিবাহিত ২৩-২৪ বছরের তরুণী সাংঘাতিক নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে পুরো বাংলাদেশ ঘুরেছি। এখন কি এটা সম্ভব? একটা অবিবাহিত তরুণী কি একা একা সারাদেশ ঘুরতে পারবে? 

তিনি আরও বলেন, এখন তো আমার বয়স ৭৫-৭৬। তখন যেভাবে নিরাপত্তার সহিত ঘুরতে পারতাম, এখন কি পারবো? এখন তো এই নিরাপত্তাটা নাই। আমাদের তো অবনতি ঘটছে। তখন বিয়ের পর স্বামীর ঘরে নারীদের নির্যাতন করা হতো। কিন্তু এখন তো নির্যাতনও হচ্ছে। হত্যাও হচ্ছে। ধর্ষণও হচ্ছে। এক্কেবারে নিরাপত্তাহীনতার চরম পর্যায়। এইগুলো তো আমি দেখছি এইভাবে যে, নারীর অনেকদিকে যোগ্যতা বেড়েছে। চাকরি করছে। আয় করছে। গড় আয়ু বেড়েছে। স্বাস্থ্যের দিকেও উন্নতি হয়েছে। আমাদের জনসংখ্যা কম হচ্ছে। নারী একের অধিক সন্তান নেওয়া না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। কিন্তু সার্বিকভাবে নারীর নিরাপত্তা যেখানে রাষ্ট্রের দেখার কথা, সেখানে আমি বলবো বছরের পর বছর ধরে আমাদের অবনতি ঘটেছে। আমাদের মানুষিক চেতনার অবনতি ঘটেছে। পুরুষ-ছেলে-যুবকদেরও নারীর প্রতি সম্মান একদম চলে গেছে। বিয়ের পর স্ত্রীকে সঙ্গী না ভেবে পণ্যের পর্যায়ে নিয়ে গেছে স্বামীরা। আমরা পুরুষদের সবসময়ই বলে আসছি নারীবান্ধব হতে। নারীদের যেসব প্রতিকূল অবস্থা আছে, সেগুলো দূর করার জন্য নারীবান্ধব হওয়াটা প্রয়োজন।

ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে খুশি কবির বলেন, এবারের দুর্গাপূজা-ই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা কোথায় চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন যে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ কিন্তু এবার দুর্গাপূজার সময়, যে পূজায় শুধু হিন্দুরা নয়, সবাই অংশগ্রহণ করে, সেখানে সংঘাত ঘটেছে। দুর্গাপূজা আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। যেমন করে ঈদের সময় অনেক হিন্দু বাচ্চাকে তার বাবা মা নতুন কাপড় পরায়, ভালো-মন্দ খেতে দেয়, নিজেরা খায়, তেমনি দুর্গাপূজাও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। দুর্গাপূজা উৎসবে সবাই যাচ্ছে, উৎসব করছে। আমরা অন্যদের বলতাম যে, আমরা সব ধর্মকে সম্মান করতে জানি। বাংলাদেশ এবং বাঙালি কোনোদিন উগ্র সাম্প্রদায়িক হবে না। আমরা ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু এবারের পূজা উৎসবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে তাণ্ডব ঘটলো, সেখানে দেখা যাচ্ছে মোটেই আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ নই। বরঞ্চ আমরা উগ্র সাম্প্রদায়িকতার দিকে যাচ্ছি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭