ইনসাইড পলিটিক্স

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন: হারিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনী আমেজ


প্রকাশ: 20/12/2021


Thumbnail

ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হওয়ার ভৌতিক ক্যারিশমা পঞ্চম ধাপেও অব্যাহত রয়েছে। কোনোভাবেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতের হিড়িক থামানো যাচ্ছে না। যার ফলে হারাতে বসেছে নির্বাচনী আমেজ। পঞ্চম ধাপেও অন্তত ২৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ভোট হচ্ছে না। এসব ইউনিয়নে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হতে যাওয়া সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলে জানা গেছে। এর আগে প্রথম ধাপে ১৪১ জন, দ্বিতীয় ধাপে দ্বিতীয় ধাপে ৩৫৭ জন, তৃতীয় ধাপে ৫৬৯ জন এবং চতুর্থ ধাপে ২৯৫ জন নির্বাচিত হন বিনাভোটে। স্থানীয় কিংবা জাতীয়, নির্বাচনের নামে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘অটো পাশ’ করার অসুস্থ এ প্রক্রিয়াটিকে ভোটার-জনসাধারণের সঙ্গে একটি প্রতারণামূলক রাজনৈতিক প্রহসন হিসেবে দেখছেন ভোট সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল রোববার (১৯ ডিসেম্বর) ছিল পঞ্চম ধাপের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। আগামী ৫ জানুয়ারি ৭০৭টি ইউনিয়নে হবে ভোটগ্রহণ। এ ধাপেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের সংখ্যা বাড়ে। বিজেতাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না এবং তারা বলছে যে, এ নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে কোনো উপ-নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপিই একমাত্র দল না। ফলে অনেকের কাছে বিএনপির ভোট বর্জনের সঙ্গে বিনা ভোটের নির্বাচন বিষয়টিও ঠিক মিলছে না। পাঁচ ধাপ মিলেয়ে প্রায় এক হাজার ৩০০ জন জনপ্রতিনিধি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, বিষয়টি ভোটারের কাছে বিভিষিকাময় একটি ব্যাপার। 

আমাদের সংবিধানে বলা আছে যে, নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু এখন তো ভোট-ই হচ্ছে না। ভোটের আগেই বিজয়ী হয়ে যাচ্ছে।  ভোটে যদি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে অথবা ভোটাররা যদি পছন্দের প্রার্থীকে ভোটই দিতে না পারেন তাহলে তো আর নির্বাচন হয় না। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন মূলত সিলেকশন। যদিও কোনো পদে একাধিক প্রার্থী না থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ঘোষণা অসাংবিধানিক বা বেআইনি নয়। ফলে এই যুক্তিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত কাউকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই এটা যেমন সত্য, তেমনি কেন একটি পদের বিপরীতে একাধিক প্রার্থী থাকেন না, এ প্রশ্ন তোলাও সংগত এবং ইদানিং কেন এই প্রবণতা বাড়ছে তারও নির্মোহ বিশ্লেষণ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ এর পর বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ আতঙ্ক ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। 

স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, একটা সময় ভোটকে বড় বড় উৎসবগুলোর একটি ধরা হতো। বর্তমানে সেই উৎসবটা নেই। এখন ভোট আসে,ভোট যায়, অনেক মানুষ জানেও না। জেনেও কি করবে। ভোট দিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত করারও উপায় নেই আর। এখন মিছিল হয় না, রাতভর নির্বাচনী আড্ডার আমেজ টাও উধাও। এখন কয়েকজন প্রার্থী থাকবে। তারপর একজন বাদে বাকি সবাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবে। আর বেচারা জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য হা হুতাশ করবে। আগের সামাজিক সম্প্রীতি আর চোখে পড়েনা বলেই মনে করছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।

বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় ভিত্তিক মনোনয়ন হচ্ছে। যারাই ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন তাদের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত এবং এর প্রতিফলন হচ্ছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া কিন্তু নির্বাচন নয়। এটা হচ্ছে নির্বাচন-নির্বাচন খেলা। নির্বাচন হলো বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকা। কিন্তু আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন। এই যে সহিংসতা দেখছি, মনোনয়ন বাণিজ্য দেখছি, এগুলো হলো রোগের উপসর্গ, রোগ নয়। এগুলোর কারণ হচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে সুবিধাবাদ। রাজনীতি হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণের জন্য, জনস্বার্থে। কিন্তু রাজনীতিটা হয়ে গিয়েছে ব্যক্তির স্বার্থে, গোষ্ঠীর স্বার্থে, অনেক সময় দলের স্বার্থে। অর্থাৎ রাজনীতিতে মানুষ এখন যুক্ত হয় কিছু পাওয়ার জন্য। তাই রাজনৈতিক দলের পদ-পদবী পেলে তারা রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হয়। বিভিন্ন রকম অন্যায় করে পার পাওয়ার সুযোগ পায়।

একাধিক নির্বাচন বিশ্লেষক বলছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে কারণ অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীই নির্বাচনে জিতবে ধরে নিয়ে অংশগ্রহণে উৎসাহ পাচ্ছে না। পাশাপাশি এর সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাতের বিষয়টিও আছে। এর সঙ্গে আছে তৃণমূলের রাজনীতি ও এমপির সমর্থন। ফলে রাজনীতি এখন একটি লাভজনক ব্যবসা, আর এ কারণে কথিত নির্বাচনে মানুষের ভোটের কোনো স্থান নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭