সোশ্যাল থট

দশ ডিসেম্বর তত্ত্ব ও সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের ফোঁসফোঁস শব্দ


Thumbnail দশ ডিসেম্বর তত্ত্ব ও সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের ফোঁসফোঁস শব্দ

"সাম্রাজ্যবাদী- সরীসৃপের ফোঁসফোঁস শব্দ সমাজের আনাচে-কানাচে সর্বত্র শোনা যাইতেছে - সেই ফোঁসফোঁস শব্দ যেন এই যুগের সঙ্গীত। আমাদের কওমী প্রতিষ্ঠান আওয়ামী মুসলিম লীগ এই সরীসৃপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া তাহাদের বিষদাঁত উৎপাটন করিতে বদ্ধপরিকর।" ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো এই মেনিফেস্টোকে সামনে রেখে।   কালক্রমে মেনিফেস্টো থেকে কথাগুলো উধাও হয়েছে। কিন্তু  সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের সেই  ফোঁসফোঁস শব্দগুলো এখনও কি আওয়ামী লীগ শুনতে পায়না?

এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ার আগে একটি লোকের সাক্ষাতপূর্বক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছি। আচরণে ছটফটে, চোয়াল ও চিবুক থেকে একগুচ্ছ দাড়ি না ঝুললেও মাথার ওপর তেছড়া করে বসানো একটি মুখাবয়ব - এমন মূর্তিতে একটা লোককে  দ্রুতপদে হেঁটে চলে যেতে দেখেছিলাম, তখন তাঁর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল যে, চার্লি চ্যাপলিন ও ক্ষুদে পুরোহিত মিলিয়ে তৈরি একটি মূর্তি চলে যাচ্ছে। তার দু'চোখের দৃষ্টি সোনামুখি সূচের মুখের মতো তীক্ষ্ণ। যার দিকে তাকায় তার দেহে যেন সেই দৃষ্টি বিঁধতে থাকে। শত্রুমিত্র উভয়কেই সন্ত্রস্ত করে তোলার মতোই তাঁর চোখ। প্রতিহিংস কীটের প্রকৃতিতে একটা উদ্ভট কিছু রয়েছে।  মেজাজ চড়িয়ে যখনই কথা বলেন তখনই বোঝা যায়, আজগুবি ও অবাস্তব কতগুলো ধারণায় তার মন ভরে রয়েছে। সে নিতান্ত হুজুগবাজ। মানসিক ব্যাধির মতো একটা ক্ষমতাবোধের মোহ তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে ধারণা বাস্তবতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দলটি ছেড়ে চলে গেছেন অনেকেই যারা তার পিতার সাহচর্যে বেড়ে উঠেছিলেন। আর এখন যারা নেতা রয়েছেন, তারা কতগুলো খড়ের তৈরি দুর্বল মানুষ মাত্র।

লোকটির ত্রাস সঞ্চারকারী জিঘাংসা ও ক্রোধের জোর সফল হয়ে উঠতে পারেনি। ২৪টি লাশ অবশ্য ঝরেছে। ভয়ংকর ওই চোখ ফাঁকি দিয়ে মূল টার্গেট হওয়া ব্যক্তিটি প্রাণে বেঁচে যান,- যা ছিল নিতান্তই অলৌকিক এক ঘটনা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই  আগস্টকে ফের রক্তাক্ত করার ঘোষণা নতুন নয় বরং বারবার উচ্চারিত হয়েছে তার গুরুজনদের থেকে।  

আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে এই উক্তিটির কারণে কারো বুক ধরফর করে কিনা জানিনা - তবে আব্দুল জলিলের "ত্রিশ এপ্রিল" ফর্মুলার সঙ্গে এটাকে গুলিয়ে না ফেলাই ভালো।  আওয়ামী লীগের ভান্ডারে মুক্তিযুদ্ধসহ গণ-অভ্যুত্থানের নানা সাফল্য থাকলেও ওই "ত্রিশ এপ্রিল" ফর্মুলাকে মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। নিয়মাতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আব্দুল জলিল ওই ফর্মুলা দিয়ে বরং নেতাকর্মীদের বিপদে ঢেলে দিয়েছিলেন। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও ঘাবড়ে গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে "জনতার মঞ্চ" অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচির মুখে তাদের ক্ষমতাচ্যুতির অতীতটা এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল। 

আগামী দশ ডিসেম্বর তত্ত্ব প্রতিহিংসার পাল্টা একটা তত্ত্ব হলে ভালো। আর যদি পরিকল্পিত কোন ফর্মুলা হয়ে থাকে তাহলে তা প্রকৃতি কি হবে? কারারুদ্ধ বেগম জিয়াকে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে বের করে আনবেন তারা? মানে কি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে  শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো হবে। অবশ্য এ পরিকল্পনা একেবারে অগণতান্ত্রিক নয়, গণঅভ্যুত্থানের একাধিক ইতিহাস রয়েছে। যা আমাদের হৃদয়কে এখনও উদ্বেলিত করে। ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। তাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফ্লিড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটেছিল। তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চুলোয় দিয়ে মুক্তি দিতে হয়েছিল শেখ মুজিবকে। জনসমুদ্র শেখ মুজিবকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধি দেয় বটে কিন্তু তাঁর কথায় কিন্তু দেশ চলেনি। শাসনক্ষমতায় আইয়ুবের স্থলে আরেক জেনারেল ইয়াহিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল। এ সবই অর্জনের মূলে ছিল আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও দশ নেতার নেতৃত্বাধীন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা। বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে হুট করে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়নি। সত্তরের অবাধ নির্বাচনে জনগণের নিরঙ্কুশ রায় অর্জন করতে হয়েছে। একাত্তরের মার্চে  ন্যায়সঙ্গত ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র যখন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে - তখনই জনগন গর্জে উঠেছে। এরপর থেকেই কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ পরিচালিত হচ্ছিল। ২৫ মার্চ গণহত্যারর রাতে বঙ্গবন্ধুকে  গ্রেফতার করে নিয়ে গেলেও তাঁরই নির্দেশনায় মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। 

কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি গণসংগঠনের পক্ষে এ যাবৎ কোন অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার নজীর নেই। বরং নির্বাচিত ক্ষমতাসীন হওয়া সত্ত্বেও  আওয়ামী লীগকেই দু-দুবার সামরিক অভ্যুত্থানের লেবাস দিয়ে  ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। প্রথমবার ১৯৫৮ সালের ১০ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। প্রসঙ্গত ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন করলেও মোট ২৩৭টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই লাভ করে ১৪৩ টি। অপরদিকে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে শেরেবাংলার কেএসপি পায় মাত্র ৪০টি আসন। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভবিষ্যত বানী অনুযায়ী মোটে ৯টি আসনই পেয়েছিল। প্রাদেশিক পরিষদে  সংখ্যাগরিষ্ঠ্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারলেও তা করেনি। যুক্তফ্রন্ট চুক্তিতে ছিল, প্রাদেশিক পরিষদ নেতা অর্থাৎ পূর্ববাংলার  মুখ্যমন্ত্রী হবেন শেরেবাংলা আর পাকিস্তান গণপরিষদ নেতা হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাই হয়েও ছিলেন তাঁরা। অবিভক্ত বাংলার দুই প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর ত্রিমুখী কোন্দলের মুখে   যুক্তফ্রন্টের অবিস্মরণীয় সেই বিজয় ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়।  আওয়ামী লীগ ১৩ মাস  সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তান এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্বপাকিস্তান শাসন করলেও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। এরপর আওয়ামী লীগকে সরীসৃপের বিরুদ্ধে তেইশ বছর সংগ্রাম করে পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ এবং পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে রূপান্তর ঘটলেও সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের বিষদাঁত উৎপাটন করা সম্ভব হয়নি। বরং স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনীরা স্বাধীনতার চেতনা ও  মূল্যবোধকে ধ্বংস করার জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের চার নেতার জীবনও কেড়ে নেয়। খুনী মোশতাক রাষ্ট্রপতির ভাষণে বলেছিলেন, শেখ মুজিবকে অন্যকোনো পন্থায় ক্ষমতা থেকে সরানোর পথ সামনে না থাকায় সামরিক বাহিনীকে এই হত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা না হলে খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতি হতে না আর জিয়াউর রহমানকে  সেনাপ্রধান হতেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিটটা আসলে হত্যাকারীও নিতে পারেনি বরং পুরোপুরি নিয়েছেন জেনারেল জিয়া। সেই সূত্র ধরেই তো বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের রাজনীতি। স্বভাবতই এটা তারা মনপ্রাণে বিশ্বাস করে বলেই বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার সহ্য করতে পারেন না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা হীন চিন্তারই ফলশ্রুতি। 

দেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি বা বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের কোন কর্মসূচিও দেখা যাচ্ছে না। তাহলে ১০ ডিসেম্বর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে কি কারণে? তাহলে কী আরও একটি ২১ আগস্টের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসরমান তারা? ক্ষমতায় থেকে গোটা প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করে ২১ আগস্ট পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলাও যখন জাতির পিতার কন্যার লক্ষভ্রষ্ট হয়, তখন ক্ষমতার বাইরে থেকে বর্তমান শোচনীয় অবস্থায় আরেকটি গ্রেনেড হামলার চিন্তা নিশ্চয়ই করবেন না। পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আরোহনের দিন আর নেই। আমি একটি টকশোতে বলেছিলাম, সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো একটি রাজনৈতিক দলপ্রধানের হাত থেকে সেনানিবাসের বাড়িটির দখল অবমুক্তকরণ। এখন যেমনি করে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত হতে পারছে - সেটা সেনানিবাসের বাড়ি অবমুক্ত করা না হলে সম্ভব হতো না। সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের বিষ দাঁত এখনও ছোবল দিতে চাইবে - কিন্তু তাই বলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নতজানু অবস্থান গ্রহণ করবেন- তা হতে পারে না। বিশেষত যে দল স্বাধীনতার নেতৃত্বাদানকারী, সেই দলের প্রধান আর তিনি যদি হন জাতির পিতা কন্যা তবে তো নতজানুর প্রশ্নই নেই। এজন্য বীরদর্পে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলে এসেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মানবতার কথা বলে অন্যের মানবাধিকারের প্রশ্ন তোলে - অথচ তাদের দেশেই অনেক হত্যার বিচার হয়না। মানবাধিকারের কথা বলা হয় অথচ, আমার মা-বাবা- ভাইদের হত্যাকারীদের ঠাঁই দেয়। দন্ডপ্রাপ্ত খুনীদের ফিরিয়ে দেয় না। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের মূলেও ছিল বিদেশী ষড়যন্ত্র। দেশ-জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে চায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের কুটনৈতিক সম্পর্ক মধুর নয়, এটাকে পূঁজি করতে চাচ্ছে বিরোধীরা। কিন্তু তাদের ভুলে গেলে চলবে না, শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহানুভূতিও যথেষ্ট রয়েছে। বিরোধীদের ক্ষমতায় ফিরতে হলে নির্বাচনে বিজয়ী হতে হবে। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ  বন্দুকের নল দিয়ে ক্ষমতাদখল করে দল গঠনের যে নজীর সৃষ্টি করেছেন, এখনকার বাস্তবতায় সেই সুযোগও নেই। 

"মানবতার চূড়ান্ত মুক্তিসংগ্রাম যাহাতে বিলম্বিত না হয়, সেজন্য জনতাকে তাহাদের সমস্ত ব্যক্তিগত এবং দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়া এককাতারে সমবেত হইতে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আবেদন জানাইতেছে"- এই উচ্চারণ করেই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। জনতা ব্যক্তিগত বিভেদ বিসর্জন দিয়েই রচনা করেছিলো, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নোর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের স্বাধীনতায় লেপ্টে আছে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম। জনতা ঠিকই আওয়ামী লীগের আহবানে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল, কিন্তু দলগত বিভেদ বিসর্জন দেয়ার আহবান নেতাদের মধ্যে পুরোপুরি সাড়া ফেলতে পারেনি। যে কারণে যুক্তফ্রন্টের অবিস্মরণীয় বিজয়লাভের পরও নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগের প্রায় ২১ জন সদস্য শেরেবাংলার কেএসপিতে এবং আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ হলে প্রায় ২৪ জন সদস্য আইন পরিষদে ফ্লোরক্রসিং করেন। গোলাম মোহাম্মদ ও ইস্কান্দার মির্জা আওয়ামী লীগ ও কেএসপির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে প্রকটতর করে তোলেন যে আইন পরিষদ কক্ষেই স্পীকার শাহেদ আলী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সুযোগে ইস্কান্দার মির্জাকে খেদিয়ে আইয়ুব খান দশ বছরের জন্য বাঙালিকে গোলাম করে রাখেন। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই বাহাত্তরের সংবিধানে  ৭০ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত একটি বিধান করে ফ্লোর ক্রসিং বন্ধ করা হয়। অর্থাৎ এক দলের প্রতীকে বিজয়ী হয়ে আরেক দলে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয়।  সবকিছুতেই জনতা সমস্ত ব্যক্তিগত বিভেদ বিসর্জন দিয়েছিল। বিসর্জন দেয়নি বরং নেতারাই। তারা অনেকে ছয় দফার বিরোধিতা করেন। আবার অনেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেই পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নেতারাই দলে দলে গিয়ে খুনী মোশতাকের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছে।  ওয়ান ইলেভেনকালীনও আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার প্রতি দলীয় নেতাদের আস্থা আনুগত্যের পরিমাণ।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই যে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে রেখেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসলেও সরকারের ভেতরেই ভূত চেপে বসেছিল। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন, সিইসি সাঈদ, সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন সবই আওয়ামী লীগ সরকারের মনোনীত। এমন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাকে মনে করা হচ্ছিল নির্ভেজাল। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের ফলাফল হলো আওয়ামী লীগের জন্য চরম  বিপর্যয়ের। ওই ফলাফলের জের দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে হত্যা, ধর্ষন আর সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনে। সেই বিভীষিকার কথা মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে।

আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় ফিরতে কঠিনতর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। বহু নেতাকে বিএনপি - জামাত জোট সরকারের হাতে জীবন দিতে হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে। অর্থমন্ত্রী শাহ এমএস কিবরিয়া এমপি, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা  আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি, মমতাজ উদ্দিন, মঞ্জুরুল ইমাম এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাসহ শীর্ষনেতারা বেঁচে গেলেও জীবন কেড়ে নেয় নারী নেত্রী বেগম আইভী রহমান, মোস্তাক আহমেদ সেন্টুসহ ২৫ নেতাকর্মীর। এই আগস্টেই দেশব্যাপী বোমা বিস্ফোরণের কথা মানুষের মন থেকে মুছে যাবে না। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে হেফাজতের তান্ডবের কথাও তো সেদিনকারের ঘটনা।

সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের বিষ দাঁত উৎপাটন করা যায়নি আজও। দশ ডিসেম্বর থেকে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হবে- বিষয়টি  নিয়ে কানাঘুষা শুরু চলছে। এই সব ভ্রান্ত তত্ত্ব দিয়ে বিএনপির সাধারণ কর্মীদের বিপথগামী পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। এতে করে সরকারের সুযোগ হবে কর্মীদের গণহারে জেল-জুলুমের শিকার হতে। আওয়ামী লীগের আবদুল জলিল ৩০ এপ্রিল ফরমুলা দিয়ে হাস্যকরে পরিণত হয়েছিলেন  - তার কোন ক্ষতি হয়নি - ক্ষতি যা হবার সাধারণ নেতাকর্মীদের হয়েছিল। কৃতবিদ্য মানুষের মনের সুক্ষ্ম অনুভূতি ও আবেদন নিজের মন দিয়ে উপলব্ধি করার শক্তি ও ক্ষমতা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু কন্যার আছে। তাই সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত রুখে দেয়ার সাহসও তাঁর আছে। যে সাহস শেখ হাসিনাকে দিয়েছে সততা ও দেশপ্রেম। 

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।


বাংলাদেশ   রাজিনীতি   সাম্রাজ্যবাদ   দশ ডিসেম্বর  


মন্তব্য করুন


সোশ্যাল থট

আপনার চারপাশের ‘টক্সিক’ ব্যক্তিদের চিনবেন যেভাবে

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

যে কোনো কিছুতে অসম্মত হওয়ার প্রবণতাকে টক্সিক পারসোনালিটি বলে। এ ধরণের মানুষ আশেপাশে থাকলে তাদের জীবন থেকে এড়িয়ে চলাই উত্তম। কারণ এ ধরণের মানুষের ব্যবহার আপনার মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, এমনকি সামাজিকভাবেও হেয় করে। টক্সিক পারসোনালিটির মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। টক্সিক পারসোনালিটির মানুষকে এড়িয়ে চলতে পারাটাই নিজের জন্য মঙ্গল।

কথায় বলে, আপনি আপনার আশপাশের সবচেয়ে কাছের পাঁচজন মানুষের গড়। এর মানে হলো আপনার জীবনে গুরুত্ব পাওয়া মানুষগুলো আপনার চিন্তা, জীবনসঙ্গী বাছাই, পছন্দ, অপছন্দ, রুচি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এ সবকিছুতে প্রভাব ফেলে। আপনি এই মানুষগুলোর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এই মানুষগুলো আপনাকে ক্রমাগত পিছিয়ে দেয়। এমনকি জীবন থেকে ছিটকেও পড়তে পারেন।

তাই ‘টক্সিক’ এই মানুষগুলো থেকে দূরে থাকার জন্য আপনি আগে জীবন থেকে এই মানুষগুলোকে বিদায় করুন, নিজে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।

১. ‘টক্সিক’ মানুষেরা সাধারণত কোনো কিছুর দায়িত্ব নিতে চায় না। যেকোনো কিছুর দায়ভার অন্যের কাঁধে চাপাতে তারা ওস্তাদ। তাদের নিজেদের দুরবস্থার জন্য আপনাকে বা অন্যদের দায়ী করে। অন্যদিকে কৃতিত্ব নিজের দিকে টেনে নেওয়ার বেলায় পটু।

২. এরা সহানুভূতিশীল নয়। ‘টক্সিক’ এই মানুষেরা কখনো আপনার জুতায় নিজের পা গলিয়ে আপনার অবস্থা বা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবে না। এই মানুষদের আপনি আপনার অনুভূতি বোঝাতে ব্যর্থ হবেন।

৩. সমালোচনা, কথা লাগানো তাদের অবসরের প্রিয় কাজ। বিয়ের পর মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, চরিত্রের বিশ্লেষণ, নেতিবাচক চর্চা-এগুলোতে তারা কখনোই ক্লান্ত হয় না। আপনি মনে রাখবেন, আপনার কাছে অন্যের সম্পর্কে এই ধরনের কথা বলছে। এর অর্থ হলো আপনার সম্পর্কে এই ধরনের কথা বলতেও তাদের নীতিতে আটকাবে না।

৪. সম্পর্ক মানেই বিশ্বাস, ভরসা আর স্বস্তির একটি জায়গা। তা হোক বন্ধুত্বের সম্পর্ক কিংবা ভালোবাসার। কিন্তু এই সম্পর্ক যদি আপনাকে তিনটি উপাদানের একটি দিতেও ব্যর্থ হয় তবে বুঝতে হবে, কোথাও সমস্যা আছে।

৫. ব্যক্তিভেদে সম্পর্কের ধরন ভিন্ন হয়, সম্পর্কের সংজ্ঞাও একেকজনের কাছে একেক রকম। তবে আপনার সঙ্গী যদি প্রতিনিয়ত আপনাকে ছোট করে কথা বলে, যেকোনো কাজে জবাবদিহিতা চায় এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, সবসময় আপনাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে এমন সম্পর্ককে টক্সিক বলা যায়।

৬. আপনাকে আপনার পরিবার বা কাছের মানুষদের থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে এই টক্সিক মানুষেরা। এসব টক্সিক মানুষ আপনাকে ‘একঘরে’ করে ফেলতে পারে।

৭. এসব ‘টক্সিক’ মানুষদের সঙ্গে কথোপকথনের পর আপনার হালকা অনুভূত হয় না। বরং আবেগীয়ভাবে ভার ভার লাগে। আমাদের আশপাশেই রয়েছে অনেক ‘টক্সিক মানুষ’। এই মানুষদের সঙ্গে কথা বলার পর আপনার ওপর ‘নেতিবাচক এনার্জি’ ভর করে। মাঝেমধ্যে বিরক্তি, হতাশা আর রাগ আপনাকে গ্রাস করে।

৮. আসলে আমাদের জীবনে বাড়ির বাস্তুর প্রভাব খুব বেশি করে পড়ে।

৯. নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করতেও পিছপা হয় না তারা।



মন্তব্য করুন


সোশ্যাল থট

তবে কি তাদের নিজেদের বিশ্বাসেই ঘাটতি রয়েছে?

প্রকাশ: ০৯:২৯ এএম, ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪


Thumbnail

মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের কোনোকিছু খারাপ লাগলেও সেটি মাথা ব্যথার কারণ কখনোই হয়নি, যে পর্যন্ত সেটি সমাজের জন্য হানিকর বলে বিবেচিত না হয়েছে!

ষাটোর্ধ্ব বয়সী এক লোক সম্প্রতি বিয়ে করেছেন, এই বয়সী ব্যক্তির অষ্টাদশী তরুণীর সাথে বিয়ে গ্রামে প্রায়শই কম করে হলেও ঘটে! সমস্যা এখানে নয়, সমস্যা হলো সম্প্রতি তৃতীয় বিয়ে সম্পন্নকারী এই ব্যক্তি তার বিয়ে পরবর্তী সময়কে দারুণভাবে গ্লোরিফাই করে বেড়াচ্ছেন। একইসাথে তার মত অতি প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সাথে স্বাভাবিকভাবেই তার সহধর্মিণী সহমত পোষণ করে আরও ঝাঁঝালো বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন এবং তিনি তা উপভোগও করছেন।

আজ বইমেলায় স্কুল, কলেজ পড়ুয়া অনেক বাচ্চারা নববিবাহিত এই দম্পতির বই কিনতে যেয়ে, শ্যুগা ( Sugar) ড্যাডি টার্মকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এই ধরনের বিয়ে অথবা ড্যাডি টাইপ কারো সাথে থাকাকে জায়েজ মনে করে নিচ্ছে! এই কিশোরীদের সামনে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ছে কারা? বোধহীন এই প্রশ্নগুলো করছেন, তথাকথিত কিছু ইউটিউব চ্যানেলের বুমধারী ব্যক্তিগণ, যাদের কাছে নিজ চ্যানেল অথবা পেইজের কিছু সস্তা ভিউজ প্রাপ্তি ছাড়া আর কোনো দায়বদ্ধতা নেই!

আমাদের স্বল্পশিক্ষিত, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত অথচ মননে অশিক্ষিত সম্প্রদায়ের হাতে নতুন কিছু ভুলক্রমে চলে আসলে সেটি ভাজা ভাজা না করে আমাদের নিস্তার নাই। সম্প্রতি শ্যুগা (Sugar) ড্যাডি অথবা মম বিষয় নিয়ে অতি উৎসাহী হওয়ার মানে দাঁড়াচ্ছে, এই মস্তিষ্ক বিবর্জিত শ্রেণী অতি সম্প্রতিই এই শব্দদ্বয়ের সাথে পরিচিত হয়েছে! যার কারণে নিজ নিজ পেইজে ১৮+ কনটেন্টের মত বিষয়াদি ছাড়াও আরও বর্জ্য সংযুক্ত করে নিচ্ছে!

অন্যদিকে ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোকের সহধর্মিণী তাদের এই বিয়েকে প্রতিনিয়ত জাস্টিফাই করে যাচ্ছেন। তিনি ভুল করছেন এই জায়গাতেই! কোনোকিছু স্বাভাবিক মনে করলে সেটিকে বারবার বলে বুঝাতে হয় না এটি স্বাভাবিক! এই দম্পতি সমাজের একমাত্র দম্পতি নন, অন্য সবাই তাদের মত জাস্টিফাই করতে তো আসছেন না! তারা তবে কেন এই চেষ্টা করছেন? নিজ সম্পর্ককে স্বাভাবিক বোধ করলে অন্যের কাছে তা প্রতিষ্ঠিত করার এত তীব্র চেষ্টা কেন করছেন? তবে কি তাদের নিজেদের বিশ্বাসেই ঘাটতি রয়েছে?

বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ভুল নয় কিন্তু সেটিকে প্রচারণার মাধ্যমে জৌলুসপূর্ণ করে প্রকাশ করে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বিভ্রান্ত করা, অত্যন্ত ভুল একটি পদ্ধতি! ১৮ বছর বয়সী কারো মাথায় সেই বোধ পুরোপুরি না-ই আসতে পারে, ষাটোর্ধ্ব কারো মাথায় এটি কেন কাজ করছে না সেটাই বোধগম্য নয়!

লেখক : ইফতেখায়রুল ইসলাম

এডিসি, ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড ফোর্স ডিভিশন।

(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)



মন্তব্য করুন


সোশ্যাল থট

টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা অনেকটা আমার মতো: তসলিমা নাসরিন

প্রকাশ: ০১:৫০ পিএম, ০৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪


Thumbnail

টাঙ্গাইল শাড়ি এবং টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা অনেকটা আমার মতো। বাংলাদেশে জন্ম, কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি বলে মন্তব্য করছেন ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিন। 

তসলিমা নাসরিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এক পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়ি ও টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিদের নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন, টাঙ্গাইল থেকে প্রচুর হিন্দু তাঁতি ভারত ভাগের পর পূর্ব বঙ্গ থেকে, বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে বা বাংলাদেশ থেকে মুসলমানের অত্যাচারের ভয়ে ভারতে চলে এসেছেন। ভারতেই তাঁরা টাঙ্গাইলে যেভাবে শাড়ি বুনতেন, সেভাবেই শাড়ি বুনছেন। কিন্তু প্রচুর তাঁতি তো টাঙ্গাইলে রয়েও গেছেন। তাঁরাও বুনছেন টাঙ্গাইল শাড়ি। 

আশির দশকে, আমি যখন থেকে শাড়ি পরতে শুরু করেছি, আমার সবচেয়ে প্রিয় শাড়ি ছিল টাঙ্গাইল শাড়ি। দামে কম, মানে ভাল। আমার বাড়ির কাছে বেইলি রোডে ছিল টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। ডাক্তারি চাকরি করতাম প্রথমে মিটফোর্ডে তারপর ঢাকা মেডিকেলে। বেতনটা পেলেই বেইলি রোডের দুটো দোকানে চলে যেতাম, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির থেকে কিনতাম টাঙ্গাইল শাড়ি, আর তার পাশের সাগর পাবিলিশার্স নামের বইয়ের দোকান থেকে কিনতাম বিস্তর বই। আমি প্রচুর বই পড়তাম, এবং খুব গুছিয়ে শাড়ি পরতাম। রঙ মিলিয়ে কপালের টিপ পরতাম, রঙ মিলিয়ে হালকা কানের দুল বা হাতের চুড়ি পরতাম। আমার যত শাড়ি ছিল, তার সত্তর বা পঁচাত্তর ভাগই ছিল টাঙ্গাইল শাড়ি। টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি আমার ভালবাসার কথা অনেকেই জানতো। আমার সেই জীবনকে এখন রূপকথা বলে মনে হয়। 

এখন টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই অর্থাৎ জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশান ভারত পেয়েছে বলে চারদিকে বিতর্ক চলছে। ভারতের লোকেরা বলছে, কাজটা ভাল হয়েছে, বাংলাদেশের লোকেরা বলছে, কাজটা ভাল হয়নি। প্রশ্ন উঠছে, টাঙ্গাইল থেকে তাঁতিরা ভারতে চলে গিয়ে একই পদ্ধতিতে যদি টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি করতে পারেন, তাহলে কি তাঁরা টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব আইনত পেতে পারেন? এ নিয়ে কেউ বলছেন পারেন, কেউ বলছেন পারেন না। টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব হয়তো ভারতে চলে আসা তাঁতিরা পেতে পারতেন, যদি টাঙ্গাইল শাড়ি বোনা টাঙ্গাইলে বন্ধ হয়ে যেত, যদি টাঙ্গাইল শাড়ি বোনার কেউ আর বাস না করতো টাঙ্গাইলে, যদি কারখানায় তালা পড়তো এবং যদি ভবিষ্যতে এই তাঁত শিল্প রক্ষা করার উপায় না থাকতো। তা কিন্তু ঘটনা নয়। 

টাঙ্গাইল শাড়ি বোনার তাঁতিদের মধ্যে বসাক বংশ বিখ্যাত। বসাক বংশের সবাই বাংলাদেশ ত্যাগ করেননি। প্রচুর বসাক রয়ে গেছেন টাঙ্গাইলে, এবং বংশ পরম্পরায় তাঁরা আজও শাড়ি বুনছেন। টাঙ্গাইল টাঙ্গাইলেই আছে, থাকবে। যে বসাক তাঁতিরা টাঙ্গাইল থেকে ভারতে চলে গিয়ে শান্তিপুরে স্থায়ী হয়েছেন, সেই শান্তিপুরও শান্তিপুরেই আছে, থাকবে। শান্তিপুরের বসাকরা কিন্তু যে শাড়ি বুনছেন, সেই শাড়িকে শান্তিপুরী শাড়ি না বলে টাঙ্গাইল শাড়ি বলছেন। শান্তিপুরের নাম তাঁরা চাইলেও বদলে দিতে পারেন না, বদলে  টাঙ্গাইল রাখতে পারেন না। এই তাঁতিদের একজন পদ্মশ্রী পেলেও, শান্তিপুরে বোনা শাড়িকে টাঙ্গাইল শাড়ি বলে ডাকলেও শান্তিপুরের নাম টাঙ্গাইল হবে না এবং টাঙ্গাইলের নাম টাঙ্গাইলই রয়ে যাবে। এবং টাঙ্গাইলে বোনা শাড়ির নামও টাঙ্গাইল শাড়িই রয়ে যাবে।  

মনে রাখতে হবে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা দু’দেশে ভাগ হয়ে গেছেন। টাঙ্গাইল নামের অঞ্চল তো শাড়ি বানায় না, শাড়ি বানায় মানুষ। মানুষই কারিগর। ঢাকায় যেমন আমার বাড়ির পাশে টাঙ্গাইল শাড়ির দোকান ছিল, আমি ভারতের যে শহরে এখন বাস করছি, সে শহরেও আমার বাড়ির পাশে রয়েছে একটি টাঙ্গাইল শাড়ির দোকান। এখান থেকেও আমি যখন ইচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ি কিনতে পারি। দেশের কত কিছু মিস করি, টাঙ্গাইল শাড়ি মিস করি না। কলকাতায় মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান দেখে একবার চমকে উঠেছিলাম। ঢাকার মরণচাঁদের দই আর মিষ্টি স্পেশাল ছিল। এখন মরণচাঁদের উত্তরাধিকারীরা যদি তাঁদের সিক্রেট রেসিপি  নিয়ে ঢাকা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে কলকাতায় আসেন, এবং পুরোনো রেসিপি অনুযায়ী দই মিষ্টি বানান, তবে তাঁদের কেন অধিকার থাকবে না সেসবের স্বত্ব পাওয়ার? একবার তো শুনেছিলাম বাসমতি চালের স্বত্ব  দাবি করেছে আমেরিকা। রসগোল্লার স্বত্ব নিয়ে বহুদিন মারামারি চলেছে পশ্চিমবঙ্গ আর উড়িষ্যার মধ্যে।

এখন জরুরি কথা হলো, শাড়ি পরা তো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে দু’দেশেই, তাহলে শাড়ির মালিকানা নিয়ে কী লাভ কার? আমি খুব চাই মেয়েরা শাড়ি পরুক, ভালবেসে পরুক। টাঙ্গাইল শাড়ি দু’দেশেই পাওয়া যায়। একই কোয়ালিটির, একই স্টাইলের। স্বত্ব নিয়ে যখন লড়াই চলছে, অনেকে হয়তো নামটা প্রথম জানবে শাড়ির। শাড়ি কেমন দেখতে চাইবে, পরতে কেমন তাও জানতে চাইবে। এভাবে আগ্রহ বাড়ুক। টাঙ্গাইল নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। টাঙ্গাইলকে কেউ ধরে বেঁধে কোথাও নিয়ে যায়নি। টাঙ্গাইল শাড়ি  টাঙ্গাইলেরই থাকবে। ভারত সেই স্বত্ব ভুল করে পেলে ভারতকে তা ফিরিয়ে দিতে হবে। দেশভাগের আগে টাঙ্গাইল ভারতবর্ষের অংশ হলেও দেশভাগের পর টাঙ্গাইল বাংলাদেশের অংশ। তারপরও এ কথা আমাদের অস্বীকার করার উপায় নেই যে কাঁটাতার পেরিয়ে টাঙ্গাইলের যে তাঁতিরা এপারে অর্থাৎ ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরাও বুকের ভেতর তাঁদের জন্মের ভূমি টাঙ্গাইলকে লালন করেন, তাঁদেরও স্বত্ব  পাওয়ার অধিকার আছে বলে তাঁরা মনে করেন। সেক্ষেত্রে অন্য কোনও নামে টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব তাঁরা পেতে পারেন, যেমন আদি টাঙ্গাইল শাড়ি বা নিউ টাঙ্গাইল শাড়ি। এই নামের মধ্যে রয়ে যাবে দেশ ভাগের আর সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস। বাংলাদেশের কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব আমার আমার বলে চেঁচালে চলবে না, টাঙ্গাইলে যে তাঁতিরা শাড়ি বানাচ্ছেন, তাঁরা যেন টাঙ্গাইলে নিরাপদে বাস করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। যে বসাকরা টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি করছেন, তাঁরা যেন তল্পি তল্পা গুটিয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য না হন, তা দেখতে হবে। যেন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা আর না ঘটে দেশে।    

টাঙ্গাইল শাড়ি এবং টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা অনেকটা আমার মতো। বাংলাদেশে জন্ম, কিন্তু  নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। বাংলাদেশ এবং ভারত...এই দু’দেশে বসবাসের সময় অনেকটা সমান হয়ে এসেছে আমার। বাংলাদেশ যতটুকু আমার, ভারতও ঠিক ততটুকু আমার। বাংলাদেশ আর ভারত দু’দেশের ক্রেতারা আমাকে ভুলতে বসেছে, এ যেমন ঠিক, আমাকে নিয়ে গর্ব করার লোকও এদেশে ওদেশে কিছু আছে...এও তেমন ঠিক।



টাঙ্গাইল শাড়ি   তাঁতি   তসলিমা নাসরিন  


মন্তব্য করুন


সোশ্যাল থট

এই পূজা অশুভ শক্তির অবসান ঘটাক: সজীব ওয়াজেদ জয়

প্রকাশ: ১২:৫০ পিএম, ২২ অক্টোবর, ২০২৩


Thumbnail

সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের অঙ্গীকার নিয়ে দুর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) তিনি লিখেছেন, ‘এই পূজা অশুভ শক্তির অবসান ঘটাক এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ সমাজে মানুষের সমৃদ্ধি হোক।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’

সজীব ওয়াজেদ আরও লিখেছেন, সবাইকে দুর্গাপূজার অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

উল্লেখ্য, গত ২০ (অক্টোবর) থেকে শুরু হয়  শারদীয় দুর্গোৎসব । আজ রোববার মহাঅষ্টমী। সকাল ৬টা ১০ মিনিটে মহাঅষ্টমী পূজা শুরু হয়। সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে পুষ্পাঞ্জলি দেয়া হয় এবং ১১টায় কুমারী পূজা। রাজধানীর রামকৃষ্ণ মঠে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

রাত ৮টা ৬ মিনিটে সন্ধিপূজা শুরু হবে। রাত ৮টা ৫৪ মিনিটে পূজা শেষ হবে


পূজা   সাম্প্রদায়িক   অবসান   ঘটাক   শক্তির   উৎসব  


মন্তব্য করুন


সোশ্যাল থট

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য স্বচ্ছ নয়: এডিটরস গিল্ড

প্রকাশ: ০৯:২৪ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

বাংলাদেশের মিডিয়াও মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় আসতে পারে—ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের এমন বক্তব্যে উদ্বেগ জানিয়েছে এডিটরস গিল্ড।

বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগ জানিয়েছে সংগঠনটি।

এতে বলা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর স্পষ্টভাবে বলেছে, বাংলাদেশে যাদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ শুরু করেছে এই ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। ঘোষিত নীতিমালায় গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম পেশাজীবীদের বিষয়ে কিছুই ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই ২৪ সেপ্টেম্বর পিটার হাস একটি সাক্ষাতকারে বলেন যে, বাংলাদেশের মিডিয়াও মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় আসতে পারে। 

পিটার হাস এর এই বক্তব্যের পর বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের মিডিয়ার ওপর তার আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে নাকি মিডিয়া পেশাদারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব মতপার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বিবাদমান দলগুলোর কোনো পক্ষ না নিয়ে টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র এবং অনলাইন পোর্টালে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ঘটনাগুলো কভার করছেন এবং নির্বাচনকে একাধিক ফরম্যাটে কভার করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আমরা জানতে চাই কী কারণে রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের মিডিয়াকে হেয় করার জন্য ব্যস্ত সক্রিয়তা শুরু করেছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য যথেষ্ট স্বচ্ছ নয় এবং এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সাংবাদিকদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ সম্প্রসারণের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে জনগণের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার এবং গণমাধ্যমের উপর অদৃশ্য সেন্সরশিপ আরোপ করার একটি প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা যেতে পারে, যা গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নীতির পরিপন্থী। এবং শাসন।


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন