ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

সালতামামি ২০২১: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচিত ১০


প্রকাশ: 31/12/2021


Thumbnail

দেখতে দেখতে নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেলো আরো একটি বছর। ২০২১ থেকে ২০২২ এ পদার্পণে এখন শুধু আর একটি রাতের অপেক্ষা। আর এই রাতের সাথে শেষ হতে চললো এই বছরের আলোচিত কিছু ঘটনাও যা সারা বছর জুড়ে বিশ্বকে রেখেছে সরগরম। দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধ শেষে তালেবানের আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ, আমেরিকার ক্যাপিটাল হিলে উগ্র ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা, তাইওয়ান-চীন রাজনৈতিক উত্তেজনা কিংবা ভারতের কৃষক আন্দোলন সব কিছুই আমাদের আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে সারা বছর জুড়েই আলোচনার জন্ম দিয়ে গেছে। সভ্য জাতি বলে নিজেদের পরিচয় দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এশিয়া, আফ্রিকা সব খানেই ছিলো চরম অস্থিরতা, বিক্ষোভ, দাঙ্গা ও সহিংসতা।

২০২১ শুরু হয়েছিলো আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের দেশটির ক্যাপিটাল হিলে উগ্র হামলার মধ্য দিয়ে। ট্রাম্পের উস্কে দেওয়া সমর্থকদের হামলায় ক্ষত বিক্ষত হয় ক্যাপিটাল হিল আর দাঙ্গায় মারা যান ৫জন। আর বছর শেষ হচ্ছে সুদানে সেনা-শাসনের বিরুদ্ধে হাজারো মানুষের বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে।

১. তালেবানের আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ: এই বছরের সব থেকে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে তালেবানের দীর্ঘ ২০ বছর আমেরিকান সৈন্যদের সাথে লড়াই চালিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সিরিজ হামলার পর মার্কিন সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়ে তৎকালীন তালেবান সরকারকে উৎখাত করে এবং নিজেদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে ২০ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান করেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সেনা সদস্যরা। আগস্টে আমেরিকার আফগানিস্তান ছাড়ার প্রাক্কালে দেশটির সেনাবাহিনীকে অবিশ্বাস রকম দ্রুততার সাথে পরাজিত করে ১৫ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করে তালেবান। তালেবানের এই জয়কে প্রতিবেশী ইরান ও পাকিস্তান স্বাগত জানালেও দেশটির অন্যান্য প্রতিবেশীদের জন্য তালেবানের এই জয় এটি একটি নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

২. মার্কিন ক্যাপিটাল হিলে হামলা: জো বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে বছরের শুরুতেই জানুয়ারির ৬ তারিখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কানিতে তাঁর উগ্র সমর্থকরা দেশটির কংগ্রেস ভবনে সহিংস হামলা চালান। এই হামলার ঘটনায় পাঁচ জন নিহত এবং শতাধিকের উপর আহত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই ঘটনাটিকে অন্যতম নিন্দা জনক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত করা হচ্ছে।

৩. যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের ক্ষমতায় আরোহণ: বছরের শুরুতে জানুয়ারির ২০ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন। দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণ করেন কমলা হ্যারিস। বিদায়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথা অনুযায়ী বিদায়ি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়েই পৃথকভাবে হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করেন। বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে করা পরমাণু চুক্তি পুনর্বহাল করেন, ফিরে আসেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ছাড়াও ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সামরিক যুদ্ধে সহযোগিতা বন্ধ করেন তিনি।

৪. অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতায় ফের আসীন সেনাবাহিনী: মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতাসীন নেত্রী অং সান সু চিকে হটিয়ে আবারো ক্ষমতা গ্রহণ করে। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে কারচুপি করেছে, এমন অভিযোগ তুলে তারা ফের দেশটির ক্ষমতার পালাবদল ঘটায়। বন্দি করা হয় অং সান সুচি সহ এনএলডির শত শত নেতা কর্মীকে। সেনা-শাসনের বিরুদ্ধে হাজারো মানুষ রাজপথে নেমে আসে। বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী সহিংস পন্থা বেছে নেয়। মিয়ানমারে সেনা-শাসনবিরোধী বিক্ষোভে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজারো মানুষ।

৫. করোনা জোরালো আঘাত: অতিতে হাম, পোলিও বা ম্যালেরিয়ার টিকা উদ্ভাবন করতে অনেক বছর সময় লেগেছিল। করোনার টিকা আসতে এত সময় না নিলেও নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের একের পর এক আঘাতে বিশ্ববাসী অনেকটাই পর্যুদস্ত হয়ে পরে। করোনার মহামারি ঠেকাতে ব্যর্থতা, লকডাউন, অর্থনৈতিক প্রভাবকে ঘিরে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে প্রাণ গেছে ৫০ লাখের বেশি মানুষের। এ ভাইরাস শুধু মানুষের প্রাণ নিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি, বৈশ্বিক রাজনীতি আর অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করেছে।

৬. পেগাসাস নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিরতা: পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ফোনে আড়ি পাতছে, এমন অভিযোগ ওঠে, যা নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠে বিশ্ব রাজনীতি। ইসরায়েলই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনএসওর তৈরি এই অবৈধ সফটওয়্যার ব্যবহার করে এক দেশের সরকার অন্য দেশের সরকারপ্রধানের ফোনে আড়ি পাতে। ‘দ্য পেগাসাস প্রজেক্ট’ নামে গত ১৮ জুলাই প্রকাশিত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে নড়ে চড়ে বসে বিশ্ব রাজনীতিবিদরা।

৭. ভারতে সফল কৃষক আন্দোলন: তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন পাসের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ভারতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। প্রায় বছরজুড়েই রাজ্যে রাজ্যে চলা এই আন্দোলন ভারতের ক্ষমতাসীনদের উস্কানিতে এক সময় রূপ নেয় সহিংসতায়। কৃষকদের তাদের ন্যায্য দাবি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে অনেক চেষ্টা করে মোদি সরকার। আন্দোলনে সহিংসতায় কৃষকদের প্রাণহানি ঘটে। টানা আন্দোলনের মুখে বছরের শেষ দিকে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করে নরেন্দ্র মোদির সরকার।

৮. বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে একরাশ হতাশা: সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে কার্বন নির্গমনের রাশ টেনে ধরার কোনো বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বোঝার জন্য এখন কাওকে আলাদা করে কোন রিপোর্ট পড়ার দরকার পড়বে না বলে মন্তব্য করেন জাতিসংঘ মহাসচিব অন্তেনিও গুতেরাঁ। ৯ আগস্ট জলবায়ু সম্মেলনের আগে জাতিসংঘের উদ্যোগে এ বিষয়ে ৪ হাজার পৃষ্ঠার এক বিশদ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বহু দেশই যে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেনি তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে জাতিসংঘ। নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) অনুষ্ঠিত হয়। ধরিত্রীকে রক্ষার জন্য এই সম্মেলনকে সর্বশেষ সেরা সুযোগ হিসেবে অনেকে অভিহিত করেন। জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানোর লক্ষ্যে আমূল ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে হাজারো মানুষ স্কটল্যান্ডে বিক্ষোভ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত সম্মেলনের অর্জন নিয়ে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেন। ২০২১ সালে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার খবরগুলো মাঝে মধ্যে সংবাদ শিরোনাম হয়। আমেরিকা দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে তীব্র খরা, বেলজিয়াম ও জার্মানিতে বন্যা ও গ্রিসে ব্যাপক দাবানল যার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এছাড়া এ বছর নেপাল ও ভারতেও মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বন্যা হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১৫ নভেম্বর ৫০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু পরিবর্তন বিলে সই করেন। যদিওবা তিনি তেলের দাম নিম্নমুখী রাখার জন্য বেশি করে তেল উৎপাদন করার জন্য ওপেকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

৯. বরফ গলে সৌদি-কাতার সম্পর্কের: ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করা এবং দোহাভিত্তিক আল-জাজিরা নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া সহ নানা বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠে মধ্যপ্রাচ্যর দুই প্রতিবেশী সৌদি আরব ও কাতার। কাতার তাদের অভিযোগ অস্বীকার করে এবং এই দেশগুলো যেসব দাবি করে কাতার সেগুলোও প্রত্যাখ্যান করে। ২০১৭ সালের জুনে চার প্রতিবেশী (সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর) মিলে কাতারের উপর আরোপ করে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, যেটিকে কাতার তাঁর উপর অবরোধ হিসেবে বর্ণনা করে। তবে সৌদির যোগসাজশে করা নিষেধাজ্ঞা কোন বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে নি কাতারের উপর। বরং এর ফলে কাতারের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর হয় ইরান, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রর সাথে। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সমস্যা সমাধানের জন্য সৌদি আরবের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। বছরের শুরুর দিকে কাতারের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পথে এগিয়ে আসে সৌদি আরব। ৫ জানুয়ারি সীমান্ত উন্মুক্ত করার পর সেখানে কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে স্বাগত জানান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব অবসানের লক্ষ্যে একটি চুক্তিও হয়।

১০. গাজায় ইসরায়েলের ফের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা: ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাহ এলাকা থেকে ছয় ফিলিস্তিনই পরিবারকে উচ্ছেদের পক্ষে রায় দেওয়ার পর গত ৬ মে থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠে ফিলিস্তিন। শুরু হয় বিক্ষোভ। বিক্ষোভ থেকে তা একসময় রূপ নেয় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। মে মাসের ১০ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত ফিলিস্তিনই ভূখণ্ডের গাজায় হামলা চালায় ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী। ১১ দিনের যুদ্ধে ফিলিস্তিনে শতাধিক নারী-শিশুসহ কমপক্ষে আড়াই শ জনের মৃত্যু হয়। ২১ মে ভোররাতে উভয়পক্ষের মধ্যে অস্ত্র-বিরতি হয়।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭