ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

ইউক্রেন নিয়ে পুতিন আসলে কি চায়?


প্রকাশ: 24/02/2022


Thumbnail

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সীমানা এবং দ্বিতীয় সামরিক শক্তিধর দেশ রাশিয়া। একসময় দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ অংশ ছিলো, ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে মোট ১৫টি আলাদা আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয় যার ফলে রাশিয়ার আগের সেই জৌলুস হারালেও হারায়নি একজন ব্যক্তির ইচ্ছা। আর তিনি হলেন রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। 

পুতিন তার অনেক বক্তব্যতে বার বার বলেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়া তিনি কখনই মানতে পারেননি। তিনি চান আগের সবগুলো দেশ নিয়েই আবারো সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হক। আগের সেই চাওয় বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব না হলেও তিনি তার প্রতিবেশীদের সাথে ঠিকই ছোট ভাইয়ের মতই আচরণ করে চলেছেন। আর তার সর্বশেষ উদাহরণ ইউক্রেন। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশটি ছিলো ইউক্রেন। অর্থনীতি কিংবা সামরিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের পর সবচেয়ে সয়ংসম্পন্ন দেশটি ছিলো এই ইউক্রেন। সোভিয়েত আমলের বড় বড় সব পারমাণবিক স্থাপনা, শিল্পকারখানা এমনকি সামরিক শিল্পগুলো ছিলো সাবেক সোভিয়েত রাজ্যটিতে। আর তাই পুতিনের স্বপ্ন পূরণে ইউক্রেনের উপর নিয়ন্ত্রণ পুতিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

ইউক্রেন সংকট:

রাশিয়া সাথে ইউক্রেন নিয়ে সংকটের সূচনা হয় ২০১৪। সেই বছর ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন বিক্ষোভের মুখে। এরপর তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে মাখামাখি করছিলেন, কিন্তু আবার মস্কোকেও ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখিয়ে চলেছিলেন। কিন্তু তারপরও প্রেসিডেন্ট পুতিন তাকে সহ্য করেছেন।

কিন্তু যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে এক বিশাল বাণিজ্য চুক্তি করতে চাইলেন - যা এককথায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়া প্রকান্তরে ন্যাটোতে যোগদানের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া - তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করলেন



এরপর যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাণিজ্যচুক্তির আলোচনা ভেঙে বেরিয়ে এলেন, তখন তার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। তার পতনের পর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়, যা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ক্ষুব্ধ করে। 

সে সময় ইউক্রেনের দখলে থাকা দ্বীপ ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। সেই সাথে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ান ভাষাভাষী এলাকাগুলোতে রাশিয়ায় সাথে যোগ দানের জন্য শুরু হয় ছায়া যুদ্ধ। যাতে পূর্ণ সমর্থন জানায় রাশিয়া। যদিও এই সমর্থনগুলো কখনোই প্রকাশ্য স্বীকার করেনি মস্কো। কিন্তু অর্থ এবং গোলাবারুদ দিয়ে রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে পুতিনের ইশারায় নিয়মিত সহযোগিতা করে আসছিলো রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। 



তাছাড়া ক্রিমিয়া দখলের পিছনে রাশিয়ার আরেকটি বড় কারণ ছিলো ক্রিমিয়ায় অবস্থিত সেভাস্তাপোল নৌঘাঁটি। এটি বাল্টিক সাগরে ঢোকার রাশিয়ায় একমাত্র নৌঘাঁটি। প্রায় ২০০ বছর ধরে কিন্তু ক্রিমিয়া রাশিয়ারই অংশ ছিল। ক্রিমিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষও জাতিগত রুশ। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এটি হস্তান্তর করেন তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছে। তখন তারা ভাবেননি, কোনো একদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে এবং ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে।

কাজেই ইউক্রেন যখন ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে কথা বার্তা শুরু করে তখন নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করতে ক্রিমিয়ার দখল নেয় পুতিন বাহিনী। আর এর সাথে শুরু হয় ইউক্রেন-ন্যাটো ও রাশিয়ার মাঝে দ্বন্দ্ব। 

পুতিন কি রাশিয়ার সামরিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন: 

অনেকে ভাবতে পারেন রাশিয়ার মত পৃথিবীর দ্বিতীয় শক্তিধর দেশ কিভাবে তার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে পারে? কিন্তু গত ৫০০ বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে রাশিয়া বহু বিদেশী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়েছে, আর এই সবগুলো আক্রমণই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে।

১৬০৫ সালে পোলিশরা আক্রমণ চালিয়েছিল এই পথ ধরে। এর পরে আসে সুইডিশরা। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফরাসীরা। জার্মানরা রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছে দুবার - ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, আবার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।

১৮১২ সালে নেপোলিয়নের সময় থেকে হিসাব করলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে প্রতি ৩৩ বছরে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপের সমতলভূমিতে একবার করে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কাজেই রাশিয়ার ধারণা, তাদের দেশের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি যদি থেকে থাকে, সেটি এই পথেই আসবে। আর তাই বর্তমান সময়ে যখন ইউক্রেনে ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে একমত তখন রাশিয়া এটিকে নিজেদের সীমানায় বিদেশি শক্তির প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবেই মনে করছে। 

ইউক্রেন সংকট কি রাশিয়ার গ্যাস বাণিজ্যর একটি বড় ইস্যু:

রাশিয়া আদতে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ সামরিক শক্তিধর দেশ হলেও দেশটি সবচেয়ে বড় শক্তি কিন্তু অস্ত্র বা সেনাবাহিনী নয়। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি দেশটির মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ, গ্যাস ও তেল। ইউরোপের মোট গ্যাসের ৪০ শতাংশ এবং মোট জ্বালানির ২৫ শতাংশ একাই সরবরাহ করে রাশিয়া। আর এই জ্বালানী সরবরাহের সবচেয়ে বড় রাস্তা হল ইউক্রেন। ইউক্রেন যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করে প্রকান্তরে ন্যাটোতে তবে তা হবে রাশিয়ার সামরিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় হুমকি। 

কাজেই ইউক্রেনে যদি রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়ার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে বলে আশংকা করে।

তবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম-২ নামে নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার ইউক্রেনের সামরিক আগ্রাসনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে এই পাইপলাইনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জার্মানিও। 



তবে, ইউরোপ যেভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে করে রাশিয়া অন্যান্য দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের যে সুযোগ পাচ্ছে তা ইতিমধ্যে টের পেতে শুরু করেছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। 

ট্রাম্প প্রশাসনে কাজ করা একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, ইউক্রেন নিয়ে এই সংকট নতুন নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই পুতিনের নজর ছিল ইউক্রেনের দিকে। মাঝে মাঝেই ইউক্রেনকে বিরক্ত করেছেন তিনি। ২০০৬ সালে ইউক্রেনে গ্যাস বন্ধ করে দেয় মস্কো। গত ২২ বছর ধরে শাসন ক্ষমতায় আছেন পুতিন। এই সময়ে নানাভাবে তিনি বিপদে ফেলার চেষ্টা করেছেন ইউক্রেনকে।

পুতিন ইউক্রেনকে রাশিয়ার অধীনে রাখতে চান। তিনি এই কাজে সফল হলে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকতে পারবেন। পুতিন একটি ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য বানাতে চান। সেই জন্যই তার নজর ইউক্রেনে। দেশটি এক সময় রাশিয়ার সঙ্গে ছিল। পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই পুতিনের ইচ্ছা ইউক্রেনকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা।

পুতিন চান সব দেশ রুশপন্থি হোক। সে কারণেই পুতিন চান না ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন জোটে কিয়েভ যোগদান করুক। উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে জার সাম্রাজ্যের মতো একটি পরিস্থিতি রৈ করতে চাচ্ছেন তিনি। অথবা তার ইচ্ছা সাবেক সোভিয়েতকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা। তবে মজার ব্যাপার হলো, পরিকল্পিত সোভিয়েতে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা না করে ব্যক্তি শাসনের ওপরই জোর দিয়েছেন পুতিন। এ জন্যই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একেবারে তৈরি তিনি।

পুতিনের দাবিসমূহ: 

ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া প্রেসিডেন্ট পুতিনের দাবিগুলো নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে পশ্চিমা বিশ্বে। ইউক্রেন নিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের চাওয়াগুলোর মাঝে আছে ন্যাটোকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, তারা আর সম্প্রসারণ করবে না। বিশেষ করে ইউক্রেনকে কখনোই ওই জোটে নেয়া হবে না। তিনি মনে করেন, ইউক্রেন কোন দিনই প্রকৃত অর্থে একটা রাষ্ট্র ছিল না। এখন যা ইউক্রেন তা আসলে 'প্রাচীন রুশ ভূখণ্ড।' 

এছাড়া তার আরেকটি দাবির মাঝে আছে, রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি কোন আক্রমণকারী অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে না ন্যাটো। সেই সঙ্গে ১৯৯৭ সালের পর যেসব দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়েছে, সেসব দেশ থেকে সৈন্য এবং সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নিতে হবে। এর মানে হলো, মধ্য ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ এবং বাল্টিক সাগরের তীরের দেশগুলো থেকে ন্যাটোর সৈন্যদের সরাতে হবে।

তবে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দাবির সাথে কোনভাবেই একমত নয় ইউরোপিয় সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যরা। ন্যাটো বলছে, নতুন সদস্যদের জন্য তাদের দরজা সবসময়ে খোলা। তারা এই নীতি পাল্টাতে রাজি নয়। ন্যাটোতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে একটি পরিষ্কার সময়সীমা চেয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট, তবে জার্মানি পরিষ্কার করে দিয়েছে, এটা খুব তাড়াতাড়ি ঘটবে না। বরং নেটোর কোন সদস্য দেশ তাদের সদস্যপদ ত্যাগ করবে এমন সম্ভাবনাও নেই।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭