ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

জ্বলছে ইউক্রেন: প্রেক্ষাপট ও পেছনের গল্প


প্রকাশ: 26/02/2022


Thumbnail

“বিচ্ছেদের করুণ সুর বাজে আজ এই মধুর অনুরাগে
পুড়ে ছারখার এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
হে প্রিয়তমা, তুমি আমার
মনে রেখো না কোনো দ্বিধা, ভয়, সংশয়”

গত দু’দিন ধরে ইউক্রেনিয়ান এক যুগলের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মাস্ক পরিহিত তরুণ-তরুণীর চেহারা বোঝা না গেলেও তাদের অব্যক্ত অনুভূতির কথা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে। হয়ত তারা একে অপরকে আশ্বস্ত করছেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইউক্রেন একদিন নিশ্চয়ই শান্ত হবে। তখন তাদের আবার দেখা হবে, পরিণয় হবে, মিলন হবে। নেটিজেনরা ছবিটিকে নানাভাবে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছেন। তবে রাজনৈতিক ডামাডোলে অনেকেই ভুলে গিয়েছেন আজ এই যুগলের যে অবস্থা, তা তো হবার কথা ছিল না। নাকি ছিল? আসুন, একটু প্রেক্ষাপটের দিকে ফেরা যাক-

সময়টা তখন ২০১৩ সালের নভেম্বর মাস। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে প্রতিবাদের ঢল নেমেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে বেশ লাভজনক একটি অর্থনৈতিক চুক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। স্টেট সিকিউরিটি ফোর্স রাস্তায় নামিয়ে দেয়ার পর তারা আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়। ফলে আন্দোলনটি আরও বেগবান হলো। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট চাপ সামাল দিতে না পেরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।

২০১৪ সালের মার্চ মাস। রাশিয়ান সেনারা ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করলো। ক্রিমিয়রা রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগ দেবার আগেই প্রয়োজন ছিল একটি স্থানীয় গণভোটের আয়োজনের। তার আগেই রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বললেন রাশিয়ান জনসাধারণ এবং ক্রিমিয়া ও দক্ষিন-পূর্ব ইউক্রেনের রুশ বক্তাদের অধিকার তিনি রক্ষা করতে চান। দুই মাস পর দনেতস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলের মানুষেরা একটি ভোটের আয়োজন করলো, যেখানে তারা চায় ইউক্রেন থেকে নিজেদের স্বাধীনতা হাসিল করতে।  

রাশিয়ার মদদ পাওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এবং ইউক্রেনিয়ান সেনাবাহিনীর মধ্যকার গোলযোগ পূর্ব ইউক্রেনে বেড়ে চলেছে। ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে এই পর্যন্ত যুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার তিনশত মানুষেরও অধিক প্রাণ হারায়, আহত হয় প্রায় ২৪ হাজার। মস্কো তার সংযুক্তি থাকবার কথা অস্বীকার করলেও ইউক্রেন এবং ন্যাটো বারংবার বলে আসছে যে দনেতস্ক এবং রুশ ক্রস-বর্ডারে রাশিয়ান সেনা নিযুক্ত রয়েছে এবং তারা যোদ্ধাদের নানা অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে।

২০১৪ সালের জুলাই মাস থেকেই দেখা গেলো যে ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে রাশিয়ার অবস্থা আরও সঙ্কটময় হয়ে দাঁড়ায়, যখন ইউক্রেনের আকাশসীমায় একটি মালয়েশিয়ান ফ্লাইটকে গুলি করে অন্তত ২৯৮ জন যাত্রীকে হত্যা করা হয়। ডাচ এয়ার এক্সিডেন্ট তদন্তকারীরা তাদের তদন্তের ফলাফলে ২০১৫ সালের অক্টোবরে জানায় যে রাশিয়ার তৈরি একটি সারফেস-টু-এয়ার মিসাইলের মাধ্যমে এই আঘাত হানা হয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তারা আরও জানায় যে মিসাইল সিস্টেমটি তৈরি করা হয়েছিল রাশিয়ায়। ধারণা করা হয়েছিল এটি নেয়া হয়েছিল পূর্ব ইউক্রেনে এবং এয়ারপ্লেনটি বিধ্বস্ত করবার পর তা আবার রাশিয়ার সীমানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া এবং ইউক্রেন চেষ্টা করে যাচ্ছে মিনস্ক চুক্তির সাপেক্ষে এই হানাহানি বন্ধ করবার। এই চুক্তির মধ্যে রয়েছে যুদ্ধসমাপ্তি, ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের সমাপ্তি, গোলযোগপূর্ন স্থানে ইউক্রেনিয়ান সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। তবে তাদের এই কূটনৈতিক বোঝাপড়ার ব্যাপারটি আর সদগতির দিকে যায়নি।

২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ন্যাটো ঘোষণা দেয় যে মিত্রশক্তির সেনাবাহিনী পূর্ব ইউরোপে চক্কর দেবে যাতে রাশিয়ার আগ্রাসন রোধ করা যায়। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড। মূলত, বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়া যেন আধিপত্য বিস্তার করে আগ্রাসন চালাতে না পারে, সেটিই ছিল ন্যাটোর লক্ষ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটো ট্যাঙ্ক ব্রিগেডকে সেনাদলের সাথে পোল্যান্ডে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে যোগ দেয়, যাতে আরও জোরদার বাঁধার মুখে তারা তীব্রভাবে রুখে দাঁড়াতে পারে।

২০১৪ সালে সংকটময় পরিস্থিতি শুরু হবার পর থেকে এই পর্যন্ত ইউক্রেন বেশ কয়েকবার সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। ২০১৫ সালের দিসেম্বর মাসে প্রায় সোয়া দুই লক্ষ মানুষ সাইবার আক্রমণের কারণে সংযোগ হারায়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কিয়েভ ঠিক একইধরণের একটি সাইবার আক্রমণের কারণে ব্ল্যাকআউটের শিকার হয়। ২০১৭ সালের জুন মাসে ইউক্রেনের সরকার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নটপেট্যা সাইবার আক্রমণের শিকার হয়। এই আক্রমণের ফলে ইউক্রেনের কম্পিউটার সিস্টেমে এককথায় ধস নামে এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিসাধন হয়।  

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ইউক্রেনে সিকিউরিটি সহায়তা আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়, যদিও পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা তখনও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন রাশিয়ার বেশ কিছু কর্মকর্তাসহ ২১ জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এছাড়াও নয়টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় যারা এই সঙ্কটের সাথে যুক্ত ছিল। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ইউক্রেনের কাছে অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ওয়েপন বিক্রি করার জন্য সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভুক্ত আরও সাতটি দেশের সাথে যোগ দেয়। পশ্চিম ইউক্রেনে এই আকাশসীমায় কুচকাওয়াজ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ২০১৮ সালে সবচেয়ে বিশাল আকারের কুচকাওয়াজ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার এই আঘাত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খুবই বিশাল এবং সংঘাতময় পদক্ষেপ। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্ক আরও তলানিতে এসে ঠেকেছে। এছাড়াও ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশের সাথে রাশিয়ার যে সম্পর্ক, তাও ক্রমহ্রাসমান। ইউক্রেনের সাথে এই সংঘাতময় পরিস্থিতি রাশিয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্কও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। বৈশ্বিকভাবে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটি দেশে। অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ, সাইবার সিকিউরিটি, নিউক্লিয়ার চুক্তি, এনার্জি সিকিউরিটি, কাউন্টার টেরোরিজমসহ রাজনৈতিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। সিরিয়া, লিবিয়ার মতো দেশগুলো হয়ে পড়বে আরও সংঘাতময় এবং অসহায়। ইতোমধ্যেই ন্যাটো বলে দিয়েছে যে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো যদি আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, তাহলে এই সংঘাতের মধ্যে তারা জড়াবে না। ইউক্রেনের অবস্থা হয়ে গিয়েছে এখন পাড়ার যুদ্ধগুলোর মতো, যেখানে বড়ভাইয়ের ভরসায় বাকিরা যুদ্ধে নেমে দেখে বড়ভাই পিঠটান দিয়েছে।

সংঘাতময় এই পরিস্থিতি থেকে ইউক্রেনের উত্তরণের উপায় কী, সেটা সময়ই বলে দেবে!


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭