ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

এবার কি বিদায় নেবে রাজপক্ষে পরিবার?


প্রকাশ: 04/04/2022


Thumbnail

রাবণের লঙ্কা যেমন হনুমানের লেজে পুড়ে ছারখার হয়েছিলো ঠিক তেমনি আবারও আগুন লেগেছে লঙ্কায়। গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটি। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে দেশটিতে। নানা অব্যবস্থাপনার কারণে একক অর্ধ রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি গণবিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। একের পর এক কারফিউ এবং কারফিউ ভেঙে রাস্তায় মানুষের বিক্ষোভ এখন দেশটিতে নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির কাছে আমদানিকৃত জ্বালানির দাম পরিশোধ করার মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। জ্বালানি সংকটে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না, পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জলাধারের পানি বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যাওয়ায় সেখানেও উৎপাদন সংকট দেখা দিয়েছে; ফলে দেশেজুড়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

এসব কিছু হয়েছে একটি পরিবারকে ঘিরে। যে পরিবার একাই নিয়ন্ত্রণ করছে সমগ্র লঙ্কাবাসির ভাগ্য। আর আধুনিক যুগে লঙ্কার এই রাবণ হলো রাজপক্ষে পরিবার। সমুদ্রে ঘেরা অপার সুন্দর এই দেশকে যেনো একাই ভোগ দখল করছে রাজপক্ষে পরিবারের সদস্যরা। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসনের বড় বড় কর্তা ব্যক্তি সবাই এই পরিবারের অনুগত। আর তাই তো ২০০৪ সালে পরিবারটির নাটের গুরু মাহেন্দ্র রাজপক্ষে দেশটির ক্ষমতায় বসার পর থেকেই গত প্রায় দেড় যুগ ধরে যেনো শ্রীলঙ্কাবাসীর ভাগ্যর বিধায়কই বনে গেছে এই একটি পরিবারটি। সীমাহীন দুর্নীতিতে আজ শ্রীলঙ্কার অবস্থা এখন খাদের কিনারায়। আর এই দুর্নীতির পেছনের সবচেয়ে বড় কারিগর শুধু একাই এই রাজপক্ষে পরিবার। এসব কারণে এখন দেশটির সবাই আঙ্গুল তুলছে রাজপক্ষে পরিবারের দিকেই। প্রশ্নও উঠছে লঙ্কাবাসির ভাগ্য নির্ধারনী এই রাজপক্ষে পরিবার কি এবার বিদায় নেবে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতা থেকে?

চীনের কাছ থেকে বিলাসী এবং অপ্রয়োজনীয় ঋণ গ্রহণ থেকে শুরু করে দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেনো নিছকই খেলায় খেলায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এই পরিবার। বিশেষ করে চীনের ঋণ দেশটির জন্য বড় একটি গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে হাম্বান্টোটা সমুদ্র বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে লীজ দিতে বাধ্য হয়েছে লঙ্কান সরকার। ঠিক তেমনিভাবে করোনা মহামারি ও শিল্পখাতে বিনিয়োগের অভাব দেশটির রাজস্ব একেবারে শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। আর এসবের ফলে দেশটিতে দেখা দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব। ফলে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি একেবারেই শূন্যর কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। দেখা দিয়েছে চাল, তেল, গ্যাস, ওষুধ, কাগজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যর ব্যাপক ঘাটতি। কাগজের অভাবে দেশটিতে বদ্ধ হয়ে গেছে স্কুল-কলেজ ও ছাপাখান, তেল ও গ্যাসের অভাবে বন্ধ বিদ্যুৎ সরবারহ ব্যবস্থার ঘাটতিতে দেশিটতে দেখা দিয়েছে দিনে ১৩ ঘণ্টার লোড শেডিং। বিদ্যুৎ ও ওষুধের অভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে বন্ধ রাখা হয়েছে অপারেশন ও জরুরি সেবা। আর তাই রাজপক্ষের রাবণের রাজ্য জ্বালিয়ে দিতে রাস্তায় নেমে এসেছে হনুমানের দল। 

রাজপক্ষে পরিবারের নাটের গুরু বলা হয় মাহেন্দ্র রাজাপক্ষেকে । ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ক্ষমতায় আরোহণ করেন মাহেন্দ্র। দেড় বছর পর ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্টের পদ দখলে নেন মাহেন্দ্র। সেই থেকে টানা ১০ বছর ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন মাহেন্দ্র। ক্ষমতা দখলের পর মাহেন্দ্র রাজপক্ষের সবচেয়ে বড় সফলতা আসে তামিল বিদ্রোহীদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে। সারা বিশ্বে তখন মাহেন্দ্রর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বললেও এই সব কিছু থেকে এড়িয়ে যান চতুর মাহেন্দ্র। সেই সময় লঙ্কার প্রধান জনগোষ্ঠী সিংহলীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন মাহেন্দ্র। তবে সেই সাথে সাধারণ জনগণ খুব অল্প সময়ের মাঝেই বুঝতে পারেন এ যেনো খাল কেটে কুমির নয় আস্ত হাঙ্গরকেই ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন তার। 

মাহেন্দ্রর শাসনামলে চীনের সাথে ব্যাপক সম্পর্কর উন্নয়ন ঘটে শ্রীলঙ্কার। তামিলদের সাথে গৃহযুদ্ধে সারা বিশ্ব যখন লঙ্কার বিরুদ্ধে তখন একাই চীন সরকার লঙ্কান সরকারকে অর্থ এবং সামরিক দিক থেকে সহযোগিতা করে গেছে। যুদ্ধ শেষ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার ঋণও নিয়েছেন মাহেন্দ্রা, তবে তার প্রায় সব উন্নয়ন প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতি ঘটেছে। মাহেন্দ্রর শাসনামলে তামিলদের সাথে যুদ্ধ জয় হলেও তামিলদের এখনো কোণঠাসা করে রেখেছেন তিনি। যুদ্ধ শেষে তামিলদের সাথে সিংহলিদের সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো প্রকার উদ্যোগই গ্রহণ করেননি তিনি। গৃহযুদ্ধে সংগঠিত ব্যাপক প্রাণহানির ফলে বিশ্বে অনেকেই তাকে কসাই বলেও সম্বোধন করে থাকেন। 

রাজপক্ষে পরিবারের সবচেয়ে ভয়ংকর সদস্য হলেন দেশটির প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় থাকা গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তার নিজ পরিবারের সদস্যরাই তাকে ‘দ্য টার্মিনেটর’ বা ‘বিধ্বংসী’ নামে সম্বোধন করে থাকেন। এর সবচেয়ে বড় কারণ প্রতিপক্ষকে বিনষ্ট করায় তার জুড়ি মেলা ভার। অল্পতেই মেজাজ হারান যেকোনো কাজে আর তাই তাকে ভয় পায় প্রতিপক্ষর লোকেরাও। 

গোতাবায়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিপক্ষের লোকজনকে গুম করে ফেলার জন্য ‘ডেথ স্কোয়াড’ গঠন করেছিলেন তিনি। তবে বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ‘দ্য টার্মিনেটর’ গোতাবায়া। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে থাকার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও তার অধীনে। মাহেন্দ্র রাজপক্ষে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তার প্রধান সহচর বা লেফটেন্যান্ট ছিলেন গোতাবায়া রাজপক্ষে। একসময় দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন গোতাবায়া। সেই সময় থেকেই দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী এই মন্ত্রণালয়ে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন গোতাবায়া। 

যদিও ২০১৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রুত কাজ শুরু করেন গোতাবায়া। যদিও তার কাজগুলো হিতে বিপরীত হওয়ার যোগাড়। ২০১৬ সালে ইস্টারে বোমা হামলায় এমনিতেই বিপর্যস্ত লঙ্কার পর্যটন শিল্প করোনায় ধাক্কায় আরো কোমর ভেঙ্গে পড়ে। সেই সাথে অর্থনৈতিক দুর্যোগ রুখতে বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি বাজারে নগদ অর্থ ছাড় দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি আরো বৃদ্ধি করে। কমে আসে কর আদায়। ফলে, বাজেট ঘাটতি আরও বেড়ে যায় অপরিকল্পিত বাজেট প্রণয়ন, কর ছাড় এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যর্থতায় রাজপক্ষে পরিবারের দেশটিকে আরো বিপদেই ফেলে গেছে প্রতি নিয়ত। 

শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাহিন্দা ও গোতাবায়া রাজপক্ষের ছোটভাই বাসিল রাজপক্ষে। সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে তিনি এখন পরিচিত কমিশন ব্যবসায়ী হিসেবে। সরকারি বিভিন্ন কাজে তার বিরুদ্ধে ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে আর এই কারণের তিনি এখন সমগ্র শ্রীলঙ্কা জুড়ে মি. টেন পার্সেন্ট নামেও পরিচিত। ঘুষ নেওয়ার পাশাপাশি অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে বাসিলের বিরুদ্ধে। দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকে লাখ লাখ ডলার পাচারের করেছেন বাসিল এমন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যদিও এসব বিষয়ে তার বিরুদ্ধে বেশ কবার তদন্ত হলেও কোন অদৃশ্য কারণে কোনবারই অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। বড় ভাই গোতাবায়া রাজপক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়।

পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্য চামাল রাজপক্ষে। পরিবারের সকল সমস্যা তিনি সামলে যাচ্ছেন সামনে থেকেই। পরিবারের গুরু মাহেন্দ্র চেয়েও তিন বছরের বয়সে বড় চামাল ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সামলেছেন শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকারের দায়িত্ব। বলা চলে সংসদে ছোট ভাইকে সব ধরণের বিরোধী আক্রমণ থেকে রক্ষার রক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করে গেছেন তিনি। স্পিকারের দায়িত্ব সামলানোর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তার রয়েছে শ্রীলঙ্কার জাহাজ পরিচালনা ও বিমান পরিবহন পরিষেবা মন্ত্রণালয় সামলানর অভিজ্ঞতাও। বর্তমানে যদিও সরকারের সেচ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তিনি, কিন্তু তার মূল প্রভাব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। গোতাবায়ার পর ওই মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হয় চামালকে।

পুরনো একটা প্রবাদের প্রচলন আছে আমাদের দেশে। রাজার ছেলে রাজাই হয়। ঠিক সেই মতোই নিজের দায়িত্ব সামলে যাচ্ছেন মাহেন্দ্রর বড় ছেলে নামাল রাজপক্ষে। সবাই তাকে পরবর্তী দেশ শাসক হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন। রাজপক্ষে পরিবারও ঠিক তেমনিভাবে গড়েও তুলছে নামালকে। পেশায় আইনজীবী নামাল ২০১০ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে পার্লামেন্টে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পার্লামেন্টের সদস্য হলেও পরিবারের পক্ষ থেকে নামালকে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া না হলেও বুদ্ধিমান নামাল বাবার প্রেসিডেন্টের পদের প্রভাব খাটিয়ে দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিজের শক্তির জানান দিয়েছেন ঠিকই। 

বর্তমানে তিনি শ্রীলঙ্কার যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও তার বিরুদ্ধেও ব্যাপক আকারের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সেই সাথে তার বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের অভিযোগ করে আসছে বিরোধী শিবির। যদিও বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন নামাল রাজপক্ষে। শ্রীলঙ্কায় জোর গুঞ্জন বাবা মাহেন্দ্র রাজপক্ষে ছেলে নামালকে দেশটির ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৈরি করছেন। নামালও নিজেও ভালো বা খারাপ যাই হোক না কেনো নিজ কাজের যোগ্যতা দিয়ে ইতিমধ্যে ভবিষ্যতের পরিবারের স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, শ্রীলঙ্কায় রাজাপাক্ষে পরিবারের বিভিন্ন দুর্নীতি গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটে ফেলেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। মূলত পর্যটনের জন্য বিখ্যাত এই দেশটি একে করোনার কারণে ক্ষতির সম্মুখীন, এর মধ্যে সীমাহীন দুর্নীতি দেশটিকে শেষ করে দিয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্তও তাদের পতনের মুখে দাঁড় করারো ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। এখন এই দেশটি দেউলিয়া হতে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে রাজপক্ষে পরিবারের পতন দেখছেন বিশ্লেষকরা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭