লিভিং ইনসাইড

তবে কি বড় হয়ে গিয়েছি!


প্রকাশ: 03/05/2022


Thumbnail

ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই উল্লাস। ঈদ মানেই চাঁদ রাতে দল বল নিয়ে স্লোগানে বের হয়ে যাওয়া '১, ২, ৩/রাত পোহালেই ঈদের দিন' এরকম আরো কত স্লোগানে পাড়ার ছেলে মেয়েরা ঈদকে আগমণ জানায়। তবে এখনো কি সেই আমেজে ভরপুর আছে এখনকার ঈদ নাকি আমি বড় হয়ে গেছি!

ঈদ মুসলিম ধর্মালম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব। এক বছর প্রতিক্ষার পর পর আসে 'ঈদ'। আর ঘরে ঘরে ছেয়ে যায় আনন্দ উৎসবে। তবে শৈশবের ফেলে আসা ঈদের রঙিন দিনগুলো যেনো আজ বিষাদের রং আর ব্যস্ততায় হারিয়ে শুধুই স্মৃতি। হারিয়ে গিয়েছে আমার ঈদের আনন্দ, শৈশবের দুরন্তপনা। সবই এখন মৃত অতীত। 

ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম সব থেকে আনন্দের দিন মানে বছর ঘুরে আসা ঈদ। বছর ঘুরে দুইতা ঈদ থাকে এক রোজার ঈদ মানে 'ঈদুল ফিতর' আরেকটা ঈদ হলো কুরবানীর ঈদ। রোজার ঈদ শেষে ২-৩ মাসের মাঝামাঝি সময়ে উটযাপন করা হয় কুরবানীর ঈদ। তবে কুরাবনীর ঈদ থেকে রোজার ঈদই অপেক্ষাকৃত বেশি আনন্দের। কারণ সেখানে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা, চাঁদ দেখা না দেখার ওপর অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা ও আনন্দ মিশে থাকত।

ইফতারের অন্যদিন গুলিতে মূলত অপেক্ষায় থাকতাম মুখরোচক ভাজা-পোড়া খাবারগুলোর প্রতি। তবে ত্রিশ বা ঊনত্রিশ ইফাতারের দিন আর সেই ভাজা-পোড়ায় মন বসতো না। অপেক্ষায় থাকতাম কখন ইফতার শেষ হবে আর টিভির সামনে বসবো। হারিয়ে যাওয়া সেই সময়টাতে এখনকার মত এত সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ে পড়ে থাকতো না কেউই। পাড়ার ছেলেদের সাথে মাঠে ঘাঠে চলে যেতো আমার ছোট ভাই রিফাত। যেখানে গাছপালার ফাঁকে পশ্চিম আকাশের কার্নিশ দেখা যায়। সবাই মিলে একদৃষ্টিতে পশ্চিমে চেয়ে থাকতো। চিকন কাঁচির মতো হলুদাভ একটা চাঁদের অপেক্ষায়! কে কার আগে দেখতে পায়। তাদের সে কী মজার প্রতিযোগিতা ছিলো!

অন্যদিকে বাড়ির সবার ছোট তন্ময়। সেই সময়টাতে ছিলো খুবই ছোট, তাই তাঁকে নিয়েই আমি বসতাম টিভির সামনে সাথে থাকতো চাচতো বোনেরাও। মাঝে মাঝে ভাই এসে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলতো কিরে আপু, খবরে কিছু বলছে চাঁদ উঠছে কিনা ! সে কি আগ্রহ আর উত্তেজনা ছিলো আমাদের চাঁদ রাতের দিন।  

চাঁদ দেখা মাত্রই উৎসবের আমেজে মেতে উঠতো সবাই। বাইরে শোনা যেতো ছোট বাচ্চাদের '১,২,৩/ রাত পোহালে ঈদের দিন' এ স্লোগানের মধ্য দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে ঈদকে। এইদিকে বাবা বাজার নিয়ে চলে আসতো, আর রান্না ঘর থেকে ঠক ঠক শীলনড়ার শব্দ ভেসে আসতো। তাঁর মানে ছিলো ঈদের দিন রান্নার জন্য আম্মু মসলা বাটা শুরু করে দিয়েছে। ঠক ঠক শীলনড়ার শব্দের পাশপাশি ভেসে আসতো আদা, রসুন পেয়াজের কাঁচা মসলার ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ যেনো আরো সতেজ করে তুলতো ঈদ আনন্দকে। 

ঈদ আনন্দের আরেকটা বড় অংশ ছিলো পিঠাপুলি। এটা বলা যায় রোজা শুরু থেকে বানানো শুরু হয়। এরপর রোদে শুকিয়ে ঈদের জন্য প্রস্তুত করে রাখেতেন। আর যখনই চাঁদ দেখা যায় , সাথে সাথেই এলাকা জুড়ে ধুম চলতো পিঠাপুলি ভাজার, আর সেই ভাজা পিঠা খেজুড়ের ঘুরের তৈরি করে রাখা শিরায় চুবানো হত। পিঠা ভাজা আর শিরা বানানোর ঘ্রাণ তখনকার ঈদ আনন্দকে নিয়ে যেতো অন্যমাত্রায়!

আর অন্যদিকে ধুম চলতো মেহেদী পড়া নিয়ে। ঈদের আগের দিন মেহেদী দেওয়ার প্রচলন অনেক আগে থেকেই। ছোট বেলা থেকেই আমি মোটামুটি ভালো মেহেদী ডিজাইন পারতাম। তাই চাঁদ উঠার সাথে সাথেই এলাকার পরিচিত বাচ্চারা চলে আসতো আমার কাছে মেহেদী দিয়ে দেওয়ার জন্য। আর নানা নকশায় অঙ্কিত হতো ছোট্টমনিদের হাত। 

পিঠাপুলি, মসলা বাটা, মেহেদী দেওয়া এসব আনন্দ আরো দ্বিগুন করে দিতো  বিটিভিতে চলা কবি নজরুলের বিখ্যাত গানটি ' রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ'। ফুল সাউন্ডে সেই গান বাজতো আর আম্মু রান্না করতো। আমি বসে বসে বাচ্চাদের হাতে মেহেদী দিতাম। মাঝে মাঝে আম্মু এসে আবার ভেজে রাখা একটা দুইটা পিঠাও দিয়ে যেতো। মেহেদী দেওয়ার পাশাপাশি পিঠায় এক কামড় দিতাম আর মনোযোগ দিয়ে সেই গানটাও শুনতাম এবং গানটা শুনে কেমন একটা ধাক্কায় শিউরে উঠতাম। গানের প্রতিটা লাইন ও সুরের ধাঁচ বুকের ভেতরে ধাক্কা মারত। কী পবিত্র মনে হতো সেই গানের কথা ও সুর। গান শেষে বিভিন্ন ঈদ অনুষ্ঠান হতো টিভিতে সেগুলাও উপভোগ করতাম আর মেহেদীর হাত একের পর এক বদল হয়েই যেতো কোনদিক দিয়ে টেরও পেতাম না। আর বাইরের ঈদের আমেজ তো ছিলো অন্যরকম। ভেসে আসতো নানা ধরনের গান। তখনকার সময়ে সবই ছিলো ঈদ সংশ্লিষ্ট গান। এছাড়াও সেই সময়ে হুমায়ুন আহমেদের নাটক ও হানিফ সংকেতের ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছিল সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

এর মধ্যে স্টিলের আলমারি থেকে নতুন জামার প্যাকেট আর বাটা স্যান্ডেলের খাকি রঙের বাক্সটা বের করে পুনরায় একবার দেখে নিতাম। সব ঠিক ঠাক আছে তো? ঈদ না আসা পর্যন্ত প্রতিদিনই নতুন জামার গন্ধ ও ভাঁজগুলো দেখে নেওয়া ছিল রুটিন ওয়ার্ক। নতুন বাটা স্যান্ডেলের গন্ধটা তখন অমৃতের মতো লাগত৷ কোথাও কোনো ময়লা বা ধুলা লেগে থাকলে গায়ের জামা দিয়ে মুছে ফেলতাম৷ জামা না পরেই নিজের সামনে মেলে ধরে আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে দাঁড়াতাম। নিজেকে কাল কেমন দেখাবে চোখের আন্দাজ করে ফেলতাম।

আব্বু, দুই ভাই তন্ময় আর রিফাতের ঈদের পাঞ্জাবি বের করে রাখতাম। পাশাপাশি আমারটাও বের করে রাখতাম। তবে সেটা একদমই শেষ রাতে যখন বাসায় একদমই মানুষ থাকতো না। কারণ, তখন এটা বিশ্বাস করতাম ঈদের জামা কেউ দেখে ফেললেই পুরান হয়ে যাবে আর ঈদ মানেই নতুন জামা পড়তে হবে। এইসব চিন্তা ভাবনা মাথায় রেখে কখনোই ঈদের আগে কাউকে জামা দেখাতাম না। বাড়ির সকলের ঈদের জামা বের করে টেবিলের উপরে রাখতাম পর পর। তখন বিষয়টাতে একটা আনন্দ খুঁজে পেতাম। রেখেই নিজের হাতে মেহেদী দিয়ে শুয়ে পরতাম। আম্মু বলা যায় সারারাতই রান্না ঘরে কাজ করতো। আর হারি পাতিলের টুং টাং শব্দ এসে কানে লাগতো। তবে তখন এই শব্দ আর কানে লাগতো না, এই টুংটাং শব্দ যেনো সে কানে কানে বলতো এইতো আর কিছুক্ষন! রাত পোহালেই ঈদ। আনন্দ আর ঘুম আসতো। শেষ রাতে যদিও একটু চোখ লেগে আসতো, তবে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আম্মু এসে সব ভাই বোনকে ডেকে তুলতো। আব্বু দুই ভাইকে নিয়ে এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তে যেতো তাই তাদের গোসলের সিরিয়াল ছিলো বরাবরই আগে। তারপরেও চাইতাম যে যত আগে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে নতুন জামা পড়তে পারে। 

আম্মু সবসমই রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতেন আর আমি গোসল সেরে নতুন জামা পড়ে ঘর গুছাতাম। ঈদ উপলক্ষে নিজেদের জামা-কাপরের পাশাপাশি আম্মু ঘরের জন্য নতুন বিছানার চাদর কিনতেন, বালিশের কভার, পর্দা ইত্যাদি। ঈদ না আসা আগ পর্যন্ত এই জিনিস গুলা একদমই বের করতাম না। অপেক্ষায় থাকতাম ঈদের জন্য। আর ঈদ আসলেই আমি সেগুলাই ইদের দিন সকালে বের করে গুছাতাম।  ভেজা কাপড় দিয়ে সব ফার্নিচার পরিষ্কার করতাম৷ ভেঙে যাওয়া ও রং ঝলসে যাওয়া ফার্নিচারগুলো কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখতাম৷ যাতে কোনো মেহমান দেখতে না পায় যে আমাদের ভাঙাচোরা ফার্নিচার আছে৷ মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে এই ঠুনকো মানসম্মান বাঁচানোর প্রতিযোগিতা। ঘরে যখন আকর্ষণীয় কিছুই থাকে না তখন ভাঙাচোরা জিনিসগুলোই এদিক সেদিক করে সাজিয়ে রেখে নিছক সম্ভ্রান্ত হওয়ার চেষ্টা।

বাবা-ছোট দুই ভাই রেডি হয়ে যেতো নামাজের জন্য। এইদিকে ওরা রেডি হতে হতে মা রান্না ঘরে চলে যেতেন সেমাই ভাজার জন্য ৷ লম্বা ঝাটার কাঠির মতো মোটা মোটা সেমাইগুলো মা ভেঙে ছোট করে ডালডা ও ঘি দিয়ে ভাজতেন। লাচ্ছা সেমাইগুলো ভাজা লাগত না। তেল চুপচুপে লাচ্ছা সেমাইয়ের প্যাকেটটা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ আসত ৷ আগে পরে যাইহোক, ঈদের দিন বাবাসহ ছোত ভাইদের নামাজের জন্য একটা তাড়াহুরো থাকতোই। রি তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে আম্মু গরম গরম রান্না করা সেমাই এনে দিতো আর দুই-এক চামচ মুখে দিয়েই ওরা বের হয়ে যেতো। এরপর বাসায় আমি আর মা একা। মা রান্না বান্না করে আর আমি নতুন জামা পড়ে বসে বসে টিভিতে বিভিন্ন  ঈদ অনুষ্ঠানগুলো দেখতাম। মাঝে মাঝে চাচাদের বাসা থেকে এরা ওরা আসতো তখন ওদের পিঠা বা সেমাই বের করে দিতাম। হ্যা আর নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। 

বাবা নামাজ শেষে করে এসেই নাশতাটা সেরে প্রতি ঈদে আমাকে নিয়ে বের হতো। ঈদের দিন সকালে নাশতাটা করি সেটা হচ্ছে জীবনে যা খেয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে সেরা খাবার৷ সেটা ছিল মায়ের হাতের ভুনা খিচুড়ি ও গরুর মাংস ভুনা। আমি খুব অবাক হই, মা অন্য দিনেও ভুনা খিচুড়ি করতেন, কিন্তু সেটা মুখরোচক হলেও ঈদের দিনের মতো এমন অমৃত হতো না৷ আজও সেই ভুনা খিচুড়ি ও গরুর মাংসের স্বাদ ভুলতে পারিনি ৷ সাধারণত যেকোনো খাবার যতই মুখরোচক হয়, পেট ভরার সঙ্গে সঙ্গে মুখে স্বাদের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু মায়ের হাতের খিচুড়ি ও গরুর মাংস ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম৷ আমার ৫ টা ফুপি ছিলো। এক এক করে সবার বাসায় আমাকে সাথে নিয়ে যেতো। এটা যেনো প্রতি ঈদে একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিলো। তারপর আমাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বাসায় ফিরতো বাবা। অন্যান্য সময় থেকে ঈদের দিন বাবা আমাকে প্রচুর সময় দিতো। আর আমিও ঈদে অন্য কারো সাথে ঘুরার থেকে বাবার সাথেই ঘুরতে সব থেকে বেশি ভালোবাসতাম। এই জিনিসটাই এখন সব থেকে বেশি মিস করি। এখন আমার সময় নেই, বাবা বয়স বেড়েছে, আমিও বড় হয়ে গিয়েছি, ব্যস্ত হয়ে পড়েছি পড়াশোনা আর কর্মজীবন নিয়ে। এই ব্যস্ততায় ডুবে যাচ্ছে শৈশব, হারিয়ে যাচ্ছে আনন্দ। অতীত হচ্ছে স্মৃতিতে পরিণত।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭