ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

তবে কি সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট আসন্ন?


প্রকাশ: 23/05/2022


Thumbnail

বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষেরই হয়ত জানা নেই খাদ্য দ্রব্য উৎপাদন এবং তা রপ্তানিতে ইউক্রেন ও রাশিয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিংবা করোনায় বিশ্বব্যাপী কি পরিমাণ ক্ষতির শিকার হয়েছেন কৃষকেরা। বেশিরভাগ মানুষ শুধু তার বাসার বাজারেই তেলের দাম কিংবা ময়দার কেজি নিয়েই দোকানির সাথে তর্ক করেই ক্ষান্ত। কিন্তু এই সব অজানা তথ্য হয়ত সাধারণের জন্য সরাসরি কোন কাজে না আসলেও তা মানুষকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করবে নিশ্চিত। 

অনাবৃষ্টি এবং অত্যধিক ভারী বৃষ্টিপাতের মতো কারণে এমনিতেই ২০১১ সাল থেকে খাদ্য দ্রব্যর দাম রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছে ছিলো। সেই সাথে করোনা মহামারী ও সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের খাদ্য বাজারে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করে। এরই মধ্যে দেশে দেশে দেখা দিয়েছে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি। বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়। গমের দাম, বছরের শুরু থেকে বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। ভারত যখন ১৬ই মে তাদের দেশ থেকে গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে তখন এর দাম বৃদ্ধি পায় আরও ৬ শতাংশ। দ্যা ইকোনমিস্ট

এর আগে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা যাবে।‘

চীনের উহানে ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর সারা বিশ্বে ৮৫ কোটি মানুষ সরাসরি খাদ্য নিরাপত্তাহিনতার মাঝে ছিলো। কিন্তু এই পরিস্থিতি আরো পাল্টে যায় রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর। এই যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং মুহূর্ত তৈরি করে। 

সারা বিশ্বের মোট খাদ্য রপ্তানির ১০ শতাংশ একাই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অধীনে সারা বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য যাওয়া বেশির ভাগ খাবার একাই রপ্তানি হয়ে থাকে ইউক্রেন থেকে। এই যুদ্ধের ফলে সেখান থেকে খাদ্য রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ইউক্রেনে প্রতিটি বন্দর এখন হামলার প্রধান টার্গেট।     

বিশ্বের খাদ্য রপ্তানির জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা একটি পরিসংখ্যানে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে। বিশ্বের মোট সূর্যমুখী তেলের ৬০ শতাংশ, গমের ৩০ শতাংশ, বার্লির ২৫ শতাংশ, তিসির ২৪ শতাংশ, ভুট্টার ১৪ শতাংশ যেখানে ইউক্রেন থেকে একাই ১৩ শতাংশ, সূর্যমুখী বীজের ১৩ শতাংশ, খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সারের ১৪ শতাংশ রপ্তানি হয় দেশ দুটি থেকে। বিশ্বের কমপক্ষে ২৬টি দেশের কোটি কোটি জনগণ তাদের অর্ধেকেরও বেশি খাদ্যশস্যের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। ভক্স নিউজ। 



মিশর এবং তুরস্ক তাদের গম সরবরাহের ৭০ শতাংশের জন্য সম্মিলিতভাবে রাশিয়ান-ইউক্রেনীয়দের উপর নির্ভর করে। ২০২০ সালে ইউক্রেনের ৯৫ শতাংশ গম রপ্তানি হয়েছিল শুধুমাত্র এশিয়া (মধ্যপ্রাচ্য সহ) ও আফ্রিকায়। এমনকি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি, যেমন ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মত দেশগুলো এই অঞ্চলের গমের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। 

রপ্তানিতে এই বাধাগুলি সম্ভবত এই দেশগুলির খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের-এর মতে, ইয়েমেনের ৩ কোটি মানুষের প্রায় অর্ধেকই অপর্যাপ্ত খাবার পায়। বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ অপর্যাপ্ত খাদ্য পায়, এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৩০ শতাংশের বেশি দীর্ঘস্থায়ীভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। ইন্দোনেশিয়া এবং মিশরে যথাক্রমে আড়াই কোটি এবং ১ কোটি লোক অপর্যাপ্ত খাদ্য পায়, যেখানে নাইজেরিয়ার জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরও বেশি ৫.৫ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগছে।

সারা বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনে সারের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এই সার উৎপাদনে একা রাশিয়া বিশ্বে নিজেকে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। রাশিয়ার সারের উপর ইউরোপের কৃষি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সেই সাথে এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও কম দামে রাশিয়ার সার বেশ উৎকৃষ্ট। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি পুরো পরিবেশকেই ভারি করে তুলেছে। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থনীতিবিদ শার্লি মুস্তাফার মতে, রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম সার রপ্তানিকারক। যুদ্ধ পরিস্থিতির পর সারের দাম বেড়েছে, ইতিমধ্যেই যা খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। সার উৎপাদন বা রপ্তানিতে আরও ব্যাঘাত ঘটলে ইউরোপে কৃষির ক্ষতি হবে, সম্ভাব্যভাবে সারা বিশ্বের খাদ্যে উৎপাদন কমবে যা দাম বাড়বে আরো বেশি, সংকট ঘনীভূত হবে আরো দৃঢ়ভাবে। 

খাদ্যর দাম বিশ্বব্যাপী ২০২০ সাল থেকে ক্রমাগত ভাবে বেড়ে চলেছে। ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের বিশ্বব্যাপী খাদ্যর মূল্য সূচকে এখন তা ২০১১ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। যুদ্ধ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আবহাওয়ার পরিবর্তনগুলো বেশ ভালো ভাবে ভুগাচ্ছে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহতে। যেখানে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো খুব বেশি পরিমাণ অনাবৃষ্টিতে ভুগছে সেখান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অতিবৃষ্টি নষ্ট করছে অনেক ফসল। করোনার কারণে এমনিতেই খাদ্য উৎপাদনে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছিলো তার মাঝে গম উৎপাদনে বিশ্বে অতি গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় খরা তাদের উৎপাদন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। 

অন্যদিকে রাশিয়া আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের (ইএইইউ) বাইরে গম, রাই, যব ও ভুট্টা রপ্তানি সীমাবদ্ধ করেছে। অন্যদিকে ইউক্রেন ওডেসাতে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একমাত্র অবশিষ্ট বন্দর বন্ধ করে দিয়েছে।

তাছাড়া কাজাখিস্তানসহ কয়েকটি প্রধান শস্য সরবরাহকারী দেশ যখন রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই দেশগুলো এমন সিদ্ধান্ত নেয়।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে না এমন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১৬০ কোটি। দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে প্রায় ২৫ কোটি। পাশাপাশি আরও কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যতার মধ্যে পড়তে পারে।

এদিকে বিশ্ব সম্প্রদায়কে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইউক্রেনের কৃষিনীতি ও খাদ্যমন্ত্রী মাইকোলা সলস্কি বলেন, চলতি বছর প্রতি টন গমের দাম বেড়ে ৭০০ ডলারে দাঁড়াতে পারে, যা বর্তমানের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। এখন প্রতি টন গম বিক্রি হচ্ছে ৪৩০ ডলারে। 

শুধু মাত্র যুদ্ধ পরিস্থিতিই খাদ্য দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে না। এটি একটি বড় উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে চলমান জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা ভাইরাস আর এখন নতুন করে শুরু হওয়া যুদ্ধ বিশ্বকে খাদ্যর যোগান মেটানোর ক্ষেত্রে এক সংকটময় পরিস্থিতির মাঝে দাঁড় করিয়েছে। সংঘাতের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে যে নতুন মোড় তৈরি হয়েছে সেই মোড়ে বিশ্ব বাজারে অনেক দেশের অধিক মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করছে খাদ্য পণ্য দাম। আর এই সব কিছু মিলিয়ে বিশ্ববাসী আগামীর দিনগুলোতে খাদ্য পণ্য নিয়ে যে এক অস্থির সময় পার করবে তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।  


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭