নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 31/12/2017
দেশের প্রাচীনতম ও সবোর্চ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের জুনে। এরপর দুই যুগেরও বেশি সময় ডাকসু নির্বাচন বন্ধ রয়েছে নানা জটিলতায়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল বাকি সব সংগঠনের নির্বাচন নিয়মিতই হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নির্বাচন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচন হয়। সিনেট, সিন্ডিকেট এবং একাডেমিক কাউন্সিলের নির্বাচনও হচ্ছে। এতে কোনো ধরণের সমস্যা হচ্ছে না।
শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) সরেজমিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে উৎসবমূখর পরিবেশে। ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে প্রশাসনিক ভবনসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। অথচ যে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের নির্বাচনই অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু নির্বান হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ মাস্ট। এটা না হলে ভবিষ্যতে নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হবে।’
রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্যের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ডাকসু নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সবাই ভেবেছিলেন এবার হয়তো নির্বাচন হবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসময়ের ভিসি অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকও গণমাধ্যমকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান। কিন্তু সেই পদক্ষেপ আর নেওয়া হয়নি। পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নতুন ভিসি আখতারুজ্জামান ।
সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ২৫ নভেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসভবন সংলগ্ন স্মৃতি চিরন্তনে অনশন শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ আশরাফ। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ পর উপাচার্যের আশ্বাসে তিনি অনশন ভাঙেন।
এ ঘটনার প্রায় এক মাস হতে চলল। এখনো পর্যন্ত নির্বাচন হওয়ার কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি।
ঘুমন্ত ডাকসু ভবনে তারুণ্যের হাহাকার
দুই তলাবিশিষ্ট ডাকসু ভবনের নিচ তলার এক পাশে ডাকসু সংগ্রহশালা, অন্যদিকে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া। দ্বিতীয় তলাটি ডাকসু কার্যলয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে থাকা ৮টি কক্ষের মধ্যে ভিপি-জিএসের কক্ষদুটিতে তালা ঝুলছে দীর্ঘদিন ধরে। বাকি ৬টির মধ্যে পরিচালকের কক্ষ একটি, তরুণ দাস নামে একজন ভাস্কর উপাচার্যের অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করছেন আরেক কক্ষ। অন্য একটি কক্ষে বিভিন্ন সংগঠন সভা-সেমিনার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। আর এক সময় সরগরম থাকা ডাকসুর সম্পাদকদের জন্য নির্ধারিত কক্ষ এখন নিরিবিলি পত্রিকা পড়ান জায়গা। বাকি কক্ষ দুটি তালা দেওয়া। কখনো কখনো কক্ষগুলো কোনো সংগঠনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খুলে দেয়া হয়। উইপোকা ধরেছে প্রতাপশালী ভিপির কক্ষের হার্ডবোর্ডে। এক সময়ের উত্তাল, তারুণ্যে ভরা ডাকসু এভাবেই হাহাকার করে সময় পার করছে ২৭ বছর ধরে।
উপাচার্যের আশ্বাসের পর নির্বাচনের জন্য কোনো ধরনের নির্দেশনা পাননি বলে জানিয়েছেন ডাকসু কার্যালয়ের সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা আসেনি।
ডাকসু নিয়ে শিক্ষার্থীরা যা বলছে
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাবির এক সাবেক ছাত্র বলেন, ’৫২-এর পর থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিদ্যমান ছিল। তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল। এর ফলে ডাকসুসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সময় মতো নির্বাচন হত। আর এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলে একচেটিয়াভাবে। বড় সংগঠনগুলো তাদের নিজের স্বার্থের কারণে নির্বাচন দিতে চাইছে না।
তিনি আরও বলেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির ঘোষণার পরও যেহেতু নির্বাচন হয়নি, সেক্ষেত্রে আগামী এক বছরে নির্বাচন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম খান বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, দীর্ঘ সময় ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখন উঠে গেছে। এখন সবাই নেতামুখী। নেতারা কর্মী কিংবা শিক্ষার্থীমুখী নন। এই ২৭ বছরে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা কেউই নিজেদের ছাত্র সংগঠনের প্রভাব হারানোর ভয়ে নির্বাচন দেয়ার সাহস দেখায়নি। ফলে এখান থেকে যে ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে তারা একচেটিয়া মানসিকতার অধিকারী হয়ে বের হচ্ছে। তারা যখন জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করবে, তখনও তাদের মধ্যে এই অভ্যাসটি থেকে যাবে। ফলে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব বেড়ে উঠেছে।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মীর আরশেদুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পাসে বিরাজনীতিকরণ চলছে। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী ডাকসু নির্বাচনের কথা ভুলেই গেছেন।
ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষার্থী শামান্তা শারমিন বলেন, অপমানের জীবন ভাঙেন। একজন শ্রমিকও তার অধিকারের জন্য কথা বলে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েও তারা নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। মানুষ রাজনীতি করে সম্মানের জীবনের জন্য। আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার কোনো অধিকার নেই। সব কিছুই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। হলে ঘুমানোর জায়গা নেই। অথচ দাবি করা হচ্ছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড! রিডিং রুমে বসার জায়গা নেই, পালা করে পড়তে হয়। যা যথেষ্ট অপমানজনক। নতজানু রাজনীতি ছাড়ুন। ডাকসুর পক্ষে কথা বলুন।
ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। এরই অংশ হিসেবে ডাকসু নির্বাচন হয়নি। সবাই চাওয়ার পরও ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না। কারণ, ডাকসু নির্বাচন হলে সরকারি ছাত্র সংগঠনের একচেটিয়া ভূমিকাটা আর থাকে না। নির্বাচন হলে সবার অধিকার থাকবে। এতে উপাচার্য কিছুটা অসুবিধায় পড়বেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন না করার ফলে সিনেট অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে।
উপাচার্য যা বললেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। এই নির্বাচন দেওয়ার জন্য কিছু অনুষঙ্গ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে ডাকসু নির্বাচনের জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করবো’। তবে কবে নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে?- এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
বাংলা ইনসাইডার/জেডএ/টিবি
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭