ইনসাইড থট

কোভিড-১৯, ভ্যাকসিন এবং ভবিষ্যৎ কৌশল


প্রকাশ: 02/06/2022


Thumbnail

জেনাভা, সুইজারল্যান্ডে আমি আমার দ্বিতিয় কোভিড টিকা পাওয়ার ৬ মাসের পর ২০২১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি তৃতীয় বা বুস্টার COVID-19 ভ্যাকসিন টিকা পেয়েছি। তিনটিই ফাইজার mRNA ভ্যাকসিন ছিল। যুক্তরাজ্যে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মনে হচ্ছিল কোভিডকে গুরুত্ব সহকারে না নেওয়া একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, ভাবটা এমন ছিল যেন মারাত্মক কিছুই ঘটেনি বা ঘটবে না। আমি সে বছর জুন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের লিভারপুলে বসবাস করতাম। লিভারপুলে ২০২০ সালের মার্চের শুরুতে আমি আমার বন্ধুদের সাথে একটি অডিটোরিয়ামে জ্যাজ মিউজিক ফেস্টিভ্যাল উপভোগ করতে গিয়েছিলাম। ৩০০০ জনেরও বেশি লোক একে অপরের পাশে বসে, চিৎকার করে গানের সাথে তাল মিলিয়ে নাচ করছিল। কোনও সামাজিক দূরত্ব এবং মুখোশ কারো ছিল না, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের প্রাপ্যতার প্রশ্নই আসে না। এরপর এপ্রিল মাসে আমি লিভারপুল এম্পায়ার থিয়েটারে একটি অপেরা উপভোগ করতে গিয়েছিলাম, সেখানেও ৪০০০ জনেরও বেশি লোক একে অপরের পাশে বসেছিল। আমাদের পাশে বসা মধ্যবয়সী মহিলারা এক বোতল রেড ওয়াইন হাতে মদ্যপান করছিল, কোনও মুখোশ নেই, কোনও সামাজিক দূরত্ব নেই। তারপর কি হল তা সবার জানা। COVID-19 যুক্তরাজ্যে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কেয়ার হোমের বিপুল সংখ্যক বৃদ্ধ মারা গেল। তখনও লকডাউন জারি করা হয়নি। তখন ভাগ্যক্রমে আমি সংক্রমিত হইনি। আমাদের অনেক সহকর্মী সংক্রামিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। যখন পরিস্থিতি সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিল তখন লকডাউন আরোপ করার পর আমি কঠোরভাবে লকডাউন অনুসরণ করেছি এবং ভাগ্যক্রমে আমি সংক্রামের থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছি। নেতিবাচক পিসিআর পরীক্ষার সহ আমি ২০২০ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিকে যুক্তরাজ্য ছেড়ে জেনেভায় চলে আসি। তখন সারা সুইজারল্যান্ডে কঠোর লকডাউন আরোপ ছিল। কিছু মুদি দোকান ছাড়া অন্যান্য দোকান, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল, বিমানবন্দর এবং গণসমাবেশ বন্ধ বা নিষিদ্ধ ছিল। প্রয়োজনীয় মুদি কিনতে সবাইকে সেই কঠোর ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হতো– সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, দোকানে প্রবেশ করার আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা এবং সব সময় মাস্ক ব্যবহার করা। এপ্রিল ২০২১ এর মধ্যে আমি আমার দ্বিতীয় Pfizer টিকা পাওয়ার পর সাহস করে জুলাই মাসে লিভারপুলে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি কঠোর ব্যবস্থা অনুসরণ করেছি - মাস্ক এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সেই সময় যুক্তরাজ্যের খুব কম লোকই কোনও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অনুসরণ করছিল। সে সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্য বিপুল সংখ্যক লোককে কোভিড টিকা দেওয়া শুরু করায় তারা তাদের স্বাধীনতা, যেমন খুশী তেমন ভাবে চলাফেরা করা, ফিরে পাওয়ার জন্য লড়াই শুরু করে। সৌভাগ্যবশত সেখানে দশ দিন থাকার পর, আমি সংক্রমিত না হয়ে (যাত্রার আগে পিসিআর পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ ছিল) নিরাপদে জেনেভায় ফিরে আসি। ২০২১ নভেম্বরে আমার বুস্টার টিকা দেওয়ার পরে আমি ২০২২ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে আবার লিভারপুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যুক্তরাজ্যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার খুব আরো কম ব্যবহার দেখে অবাক হয়েছিলাম। সেই সময়ে যুক্তরাজ্যে ওমিক্রন “ঝোপের আগুনের” মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, যদিও হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যু অনেক কম ছিল। অবাক হওয়া অনেক মানুষের আমার দিকে তাকানো সত্বেও আমি সব রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অনুসরণ করেছি। লিভারপুলে ১০দিন থাকার সময়, আমি দুই দিনের জন্য ট্রেনে (প্রতিবার দুই ঘণ্টার যাত্রা) লন্ডনে গিয়েছিলাম। আমি ম্যানচেস্টার বিমানবন্দর হয়ে বিমানে জেনেভায় ফিরে আসি। সেদিন ম্যানচেস্টার বিমানবন্দরে ছিল প্রচণ্ড ভিড়। প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর, বিমানবন্দরের পাবলিক ঘোষণাগুলি মানুষকে মুখোশ পরতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার মত মাএ ২-৫% মানুষ মাস্ক পরেছিল, কেউ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছিল না। যুক্তরাজ্যে সাফলতার সাথে প্রায় ৭০% লোককে ২টি ডোজ কোভিড টিকা দেওয়া আর ব্যাপক বুস্টার টিকা শুরু করার সফলতার কারনে হাসপাতালে ভর্তি, গুরুতর যত্ন এবং মৃত্যু হ্রাস করতে সহায়তা করছিল। সরকার তাদের টিকার রাজনৈতিক সাফল্যের ঢোল বাজতে শুরু করে। আমার কাছে কেন জানি মনে হয়েছিল যে সেখানে দেশের অর্থনীতির আরও মন্দা রোধ আর জনরোষ প্রতিরোধ করতে রাজনীতিবিদরা কাউকে কিছু না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন “লোকরা সংক্রামিত হউক এবং অনাক্রম্যতা অর্জন করুক” সেই কৌশল। কারন সরকারের বিদ্যমান প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কোন প্রয়োগ ছিল না।

জেনেভায় ফিরে আসার পরের দিন আমার ঘন ঘন প্রচুর হাঁচি শুরু হয়। অন্যথায় আমার কোন সমস্যা ছিল না, পুরোপুরি ভালো বোধ করছিলাম। সেইদিন আমি অন্য আটজন বয়স্ক সহকর্মীর সাথে একটি অফিস ঘরের গোল টেবিলের চারপাশে বসে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বৈঠকে যোগ দিয়েছিলাম (সুইজারল্যান্ড শুধুমাত্র Pfizer বা Moderna ভ্যাকসিন ব্যবহার করে এবং তাদের সবাই কোভিড mRNA বুস্টার ডোজ টিকা নিয়েছে)। বৈঠক চলাকালে আমি অন্যদিকে তাকিয়ে আমার কনুইতে কয়েকবার হাঁচি দিয়েছিলাম। কেউ মাস্ক ব্যবহার করছিল না। পরের দিন আমার হালকা মাথাব্যথা শুরু হয় এবং তাপমাত্রা সামান্য বেশি ছিল, প্রায় ৩৭.৫’C। অন্য আর কোনো সমস্যা ছিল না। তৃতীয় দিন আমার স্ত্রীর হালকা মাথাব্যথা এবং হালকা জ্বর শুরু হয় (আমি তাকে সংক্রমিত করেছি)। আমরা বাড়িতে বসে নিজেরাই স্ব-কোভিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেই (আমাদের বাসায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষার কিট ছিল)। আমরা উভয়ই কোভিডে ইতিবাচক দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত যে আমি যুক্তরাজ্যে ওমিক্রনের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছি। আমরা অবিলম্বে বিচ্ছিন্নতা শুরু করি এবং আমাদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে জানাই। তাদের কারোরই কোনো উপসর্গ ছিল না এবং সকলেই অ্যান্টিজেন পরীক্ষার নেতিবাচক ফলাফল পায়। আমাদের হালকা উপসর্গগুলো দুই দিন ধরে চলে এবং এর পর কোনো লক্ষণ ছাড়াই আমরা ভালো বোধ করছিলাম। আমাদের প্রতিবেশী আমাদের প্রয়োজনীয় মুদি কেনাকাটা করতে সাহায্য করে। ১০দিন বিচ্ছিন্নতা পালন করার পর আমরা বাসায় স্ব-কোভিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করি এবং কোভিড নেতিবাচক ফলাফল পাই। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মেনে আমরা আবার আমাদের স্বাভাবিক জীবন শুরু করি। আমাদের দুইজনের ফাইজারের তৃতীয় ডোজ থাকা সত্ত্বেও আমরা সংক্রমিত হয়েছি। টিকা আমাদের সংক্রমিত হওয়া বন্ধ করেনি কিন্তু আমাদেরকে ভোগান্তি আর হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে বাঁচিয়েছে।

সফল টিকা কভারেজ পরে ভবিষ্যতে টিকা দেওয়ার কৌশল কী হওয়া উচিত তা নিয়ে কথা বলার জন্য আমি আমার গল্পটি বললাম। উচ্চ টিকা কভারেজ সহ বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশগুলি তাদের দেশ সম্পুর্ণ ভাবে খুলে দিয়েছে। যে কেউ কোভিড ভ্যাকসিনেশনের প্রমাণসহ, পিসিআর বা অ্যান্টিজেন পরীক্ষার প্রয়োজন ছাড়াই যে কোনও দেশ বা জায়গায় ভ্রমণ করতে পারে। মাস্ক পরার কোন বিধিনিষেদ নেই। এখন কম লোকই কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অনুসরণ করছে। যদিও ওমিক্রন মানুষকে সংক্রামিত করছে, কিন্তু কম উপসর্গ, হাসপাতালে ভর্তি এবং গুরুতর যত্নের প্রয়োজন অনেক কমে গেছে। চিকিৎসার উন্নতির কারনে মৃতের সংখ্যাও নগণ্য। ক্রমবর্ধমান ঋণ, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক, জনগণের অস্থিরতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারনে ধনী উন্নত দেশগুলি লকডাউন এবং আর বিধিনিষেধ আরোপের কৌশল বন্ধ করতে একরকম বাধ্য হয়েছে। দেশগুলোতে অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হচ্ছে। একমাস থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে থাকার পর, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে (এ বিষয়ে আমি আমার পরবর্তী লেখায় লিখব), আমি হেলসিঙ্কি হয়ে ব্যাংকক থেকে জেনেভা ফিরে আসি। সর্বমোট উড়ন্ত সময় পনের ঘন্টা। বিমানে ঘোষণা করা হয়েছিল বিমানের ভিতর মাস্ক পরা এখন আর বাধ্যতামূলক নয়। বলা হল এটি এখন ব্যক্তিগত পছন্দ। আজ আমি একটি স্ব-অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করেছি এবং ফলাফল নেতিবাচক পেলাম।

আসুন এই প্রেক্ষাপটে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশের কথা বলি। প্রাথমিক হেঁচকি সত্ত্বেও কোভিড-১৯ টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব ভালো করেছে। ইতিমধ্যেই ৭০% এরও বেশি মানুষ ২ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে। বুস্টার টিকা দেওয়া পুরোদমে শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ দুর্বল গোষ্ঠী ইতোমধ্যেই তাদের বুস্টার ডোজ পেয়েছে। সংক্রমণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। পরীক্ষিত সংক্রামিত লোকের সংখ্যা গত কয়েক মাস ধরে ৫০-এর নিচে। মাঝে মাঝে একজনের মৃত্যু হলেও কয়েক সপ্তাহ ধরে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এই বর্তমান কোভিড পরিস্থিতির উন্নতিতে বাংলাদেশে কোভিড ভ্যাকসিনেশন আসলে কী ভূমিকা পালন করেছে তা নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি। এ অবস্থায় আমাদের বিবেচনা করা দরকার ভবিষ্যতে আমাদের জীবন আর জীবিকা বাঁচাতে পরবর্তী করণীয় কী হবে বা কি হওয়া উচিত?

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ শুধু ভ্যাকসিন কেনার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে। কিছু দুষ্ট লোক বলছেন বাংলাদেশ ৪০ হাজার কোটির বেশী টাকা খরচ হয়েছে, তাদের মতে দুর্নীতির কারনে তা হয়েছে। কোভিড মহামারীর কারণে জীবন ও জীবিকা প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশের সর্বমোট আর্থ-সামাজিক খরচ সম্পর্কে কথা নাইবা বললাম। অন্যদিকে তৃতীয় ঢাকা বিমানবন্দর টার্মিনাল নির্মাণে বাংলাদেশের খরচ হচ্ছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা, মেট্রো ট্রেন এবং পদ্মা সেতু প্রতিটি ৩৫ হাজার কোটি টাকা। যমুনা রেলসেতু নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেললাইন, সমস্ত অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের উন্নয়ন, গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন, অন্যান্য মেগা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা ব্রিজ, দেশব্যাপী মহাসড়ক এবং গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ সব অবকাঠামোর উন্নয়ন আমাদের অর্থনীতির উন্নতি, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনীতি ও জীবিকার উন্নতি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক। তার জন্য, কোভিড বা কোভিড ছাড়া, অর্থের প্রয়োজন এবং অর্থনীতিকে তার পূর্ণ ক্ষমতায় চলতে দিতে হবে। হা ভ্যাকসিন জীবন ও জীবিকা বাঁচাবে। তবে মেগা প্রকল্প সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে, জীবিকা বাড়াবে এবং আরও কর্মসংস্থান দেবে। আমি বিশ্বাস করি সবাই একমত হবেন ঐসব অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। অতএব, আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে ভবিষ্যতে কোন খাতের ব্যয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ - খুব ব্যয়বহুল কোভিড গণ ভ্যাকসিনেশন অব্যাহত রাখা এবং তারজন্য বিপুল পরিমাণ তহবিল ব্যয় করা অথবা উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে বিনিয়োগের জন্য কঠোর ভাবে উপার্জন করা গুরুত্বপূর্ণ অর্থ ব্যয় করা?? অথবা জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর জন্য আমাদের কী বিকল্প আছে তা বিবেচনা করে আমাদের একটি ভালো কৌশল গ্রহণ করা উচিত যা টেকসই হবে। চলুন আলোচনা করি।

সমস্ত উপলব্ধ ভ্যাকসিন হাসপাতালের যত্ন, বিশেষ করে হাসপাতালের গুরুতর যত্ন এবং মৃত্যু কমাতে কার্যকর। এই ভ্যাকসিনগুলির কোনটিই সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর নয়। যদিও কেউ কেউ দাবি করবে টিকা দেওয়ার কারণে সংক্রামিত ব্যক্তিদের মধ্যে ভাইরাল লোড হ্রাস পায়, তার কারনে সংক্রমণের হার হ্রাস পাওযার সমভাবনা আছে। যদিও এটা নিশ্চিত নয়। ভবিষ্যতে ব্যয়বহুল এমআরএনএ ভ্যাকসিন গ্রহণ করাও পরেও একই কাজ করবে। যাইহোক, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ছয় মাস পর্যন্ত থাকে তাই বারবার বুস্টার ডোজের প্রয়োজন। বর্তমানে উপলব্ধ বেশিরভাগ টিকা ওমিক্রন বা ভবিষ্যতের উদীয়মান রূপগুলি সংক্রামন প্রতিরোধে কার্যকর হবে না। এটাই দুঃখজনক বাস্তবতা। অন্যদিকে, কোন আর্থিক ঝুঁকি ছাড়া ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো যারা ভ্যাকসিন তৈরি করছে, বিশেষ করে এমআরএনএ ভ্যাকসিন, সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ট্যাক্স প্রদানকারী সরকারি তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে। এসব কোম্পানির আর্থিক লাভ বিশাল, দুই অঙ্কের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং শেয়ার হোল্ডাররা দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ এবং মৃত্যুর খরচে উপকৃত হচ্ছেন। তারা বৌদ্ধিক সম্পত্তির অধিকার মওকুফ করতে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে তাদের নিজস্ব ভ্যাকসিন তৈরি করতে দিতে অস্বীকার করছে। একই সাথে তারা দেশগুলোকে চতুর্থ ডোজ এবং বার্ষিক ডোজ দেওয়ার জন্য তাদের টিকা ক্রয় চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে, যেমন কখনো শেষ না হওয়া একটা খেলার মত। মনে হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে তাদের নির্দেশ গ্রাস করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অনেক বিজ্ঞানী বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনও সেই কৌশল প্রচারের স্বার্থের দ্বন্দ্বে রয়েছেন।

ভাল খবর হল Pfizer, Marck এবং অন্যান্য অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীগুলি হয় ইতিমধ্যে তৈরি করছে বা আরো উন্নত মুখে খাওয়া ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়ায় রয়েছে যা উল্লেখযোগ্যভাবে ভ্যাকসিনের মতই কোভিডের কারণে ঘটা গুরুতর রোগ কমাতে পারে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, হাসপাতালের গুরুতর যত্নের প্রয়োজন এবং মৃত্যু কমাতে পারে। এসব ওষুধের দাম তেমন বেশি নয়, চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম ধীরে ধীরে আরও কমছে। তাই আমরা বলতে পারি ব্যয়বহুল mRNA ভ্যাকসিন বা অন্য সব কোভিড টিকা অথবা মুখে খাওয়া ওষুধের কোভিড মহামারী বন্ধে একই প্রভাব রয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকা কোভিড মহামারী মোকাবেলায় আফ্রিকান এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সমর্থন করার জন্য “পরীক্ষা এবং চিকিত্সা (টেস্ট এবং ট্রিট)” নীতির একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়ার কথা ভাবছে।

জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্য হল সংক্রমণ প্রতিরোধে সর্বোত্তম টেকসই কৌশল অবলম্বন করা, দুর্ভোগ এবং মৃত্যু কমানো, একই সাথে জীবিকা ও অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত না করা। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলভাবে কোভিড মহামারী এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব মোকাবেলা করেছে। বাংলাদেশে স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কোভিডের মার্ক এবং ফাইজারের মুখে খাওয়া উভয় ওষুধই উৎপাদন করছে এবং ব্যাপকভাবে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে থাকাকালীন আমি নিজেও তা দেখেছি। Pfizer ওষুধের সম্পূর্ণ চিকিৎসার মূল্য প্রায় ৪ হাজার টাকা (US$ ৪৫ এর কম)। সরকার ভ্যাট মওকুফ বা ভর্তুকি দিয়ে এর মূল্য আরো কমাতে পারে দরিদ্র লোকদের এই ওষুধের প্রয়োজনে। আমার ছোট ভাই এবং তার স্ত্রী সংক্রামিত হওয়ার পরে স্থানীয় ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনে ফাইজার ওষুধের চিকিত্সা বাসায় বসে করে এবং খুবই কম লক্ষণ এবং কষ্ট ছারা খুব দ্রুত সেরে উঠে।

তাহলে বাংলাদেশ কি ভবিষ্যতের জন্য “পরীক্ষা ও চিকিৎসার” অনুরূপ কৌশল অবলম্বন করবে বা করা উচিত? আমি বলব এখন থেকে “পরীক্ষা এবং চিকিত্সার” কৌশল অবলম্বন করুন এবং ব্যয়বহুল ভ্যাকসিন এবং টিকা নয় বরং উন্নয়নমূলক কাজের জন্য মূল্যবান অর্থ সঞ্চয় করুন। বাংলাদেশে ১৭০ মিলিয়ন মানুষের ৭০% (প্রায় ১১৯মিলিয়ন মানুষ) লোকদের বুস্টার এবং/অথবা বার্ষিক কোভিড টিকাদানের জন্য খরচ হবে (টিকা এবং টিকা দেওয়ার খরচ বিবেচনা করে) কয়েক বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, ধরা যাক বার্ষিক পরীক্ষা এবং ২ লাখ সংক্রামিত লোকের চিকিত্সার জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ হবে। প্রতি বছর ভ্যাকসিনের জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার অন্যদিকে “পরীক্ষা এবং চিকিত্সার” জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার দেশে এবং লোকের উপর একই রকম প্রভাব ফেলবে। প্রাথমিক ভুলভাবে পরিচালিত লকডাউনের পরে দেশের সব জায়গায় ব্যাপক সংক্রমণ, উপসর্গবিহীন সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তারের সাথে, কোভিডের বিরুদ্ধে উচ্চ স্তরের অর্জিত প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং উচ্চ কোভিড টিকাকরণ কভারেজের খুব সফলতার পর কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেমন দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা উচিত বা ব্যয়বহুল কোভিড ভ্যাকসিন কেনা এবং বছরের পর বছর টিকা দেওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য অর্থ অপচয় করা উচিত। যতদিন ধনী দেশগুলো এবং WTO বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার মওকুফ করার এবং বাংলাদেশকে সেই ভ্যাকসিন তৈরি করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না, বাংলাদেশের উচিত “পরীক্ষা এবং চিকিত্সার” কৌশল অবলম্বন করা এবং রাজনৈতিক কারনে প্রয়োজনে শুধুমাত্র সবচেয়ে দুর্বল গোষ্ঠীর বুস্টার টিকা দেওয়া যেতে পারে। এই কৌশল জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে এবং আরও অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর হবে।

আমি নিশ্চিত যে আমার “পরীক্ষা এবং চিকিত্সার” কৌশলের পরামর্শ দেশে বিশাল বিতর্ক তৈরি করবে তবে আমাদের এই বিতর্কটি আজই শুরু করতে হবে এবং আগামীকাল নয়। UN COVAX কৌশল উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। ধনী দেশের কোম্পানিগুলো প্রচুর মুনাফা লুটছে। আসুন সবাই মিলে সবদিক বিবেচনা করে আলোচনা করি এবং সিদ্ধান্ত নেই। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন কিনেছে এবং বিপুল পরিমাণ টিকা মজুদ রয়েছে। আমাদের যথেষ্ট পরিমান সমানভাবে কার্যকর বাড়িতে বসে মুখে খাওয়া কোভিড ওষুধও রয়েছে। তাই আরও কৌশলগত আলোচনার আগে সরকারের উচিত আর ভ্যাকসিন কেনা বন্ধ করা। কোভিড শীঘ্রই চলে যাচ্ছে না তবে আর বেশি বিপর্যয় সৃষ্টি করবে না, জীবন এবং জীবিকা চলতেই হবে এবং আমাদের এখনই ভবিষ্যতের কৌশল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আসুন আর কোভিড ভ্যাকসিন নয়, “পরীক্ষা এবং চিকিত্সা”এবং ভবিষ্যতের মহামারীর প্রস্তুতির কৌশলে কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭