ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

অর্থনৈতিক যুদ্ধে জয়ের পথে রাশিয়া


প্রকাশ: 03/06/2022


Thumbnail

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার বিকৃত প্রভাব যে শুধু রাশিয়াকেই ভোগ করতে হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর ফলে বিশ্বের বাকি অংশেও বেড়ে গেছে জ্বালানি ও খাদ্য পণ্যর দাম এবং এর সাথে সাথে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাও। 

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর পরই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করে পশ্চিমা বিশ্ব। তিন মাস হতে যাওয়া এই অর্থনৈতিক যুদ্ধ একেবারেই পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছে না পশ্চিমাদের জন্য। বরং এর খারাপ দিকগুলোই এখন প্রকট আকার ধারণ করছে দিনকে দিন। 

‘নিষেধাজ্ঞা’ ব্যতীত ভ্লাদিমির পুতিন তথা রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অন্য কোনো উপায়ও হাতে ছিলো না। কিছু না করা কিংবা সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার চেয়ে নিষেধাজ্ঞাকেই সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ হিসেবে মনে ধরে পশ্চিমাদের। 

রাশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থার উপর পশ্চিমাদের প্রথম আঘাতটি আসে ইউক্রেনে হামলা শুরুর কিছুদিনের মাথায়। তখন পশ্চিমারা ভয়ে ছিলো হয়ত খুব দ্রুতই ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করে নিবে। তবে সকলকে অবাক করে দিয়ে বৃহৎ রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনবাসি। যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন যত বেড়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক যুদ্ধও তত তীব্র হয়েছে। 

যদিও, অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। উল্টো রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমাদের এই দুটি পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হচ্ছে। যেসব ইউরোপিয়ান দেশ ব্যাপকভাবে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভরশীল, অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে তেল ও গ্যাসের দাম ব্যাপক আকারে বেড়ে যাওয়ায় সেসব দেশেই পুতিন এখন অতিরিক্ত দামে এসব রপ্তানি করছে যা পক্ষান্তরে রাশিয়াকে যুদ্ধ পরিচালনায় অর্থায়ন করছে। ২০২২ সালের প্রথম চার মাসে রাশিয়া ৯৬ বিলিয়ন ডলারের জীবাশ্ম জ্বালানী রপ্তানি করেছে ইউরোপের ক্রেতাদের কাছে যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি। 



এই সপ্তাহের শুরুতে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার তেল রপ্তানির উপর আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ক্রেমলিনকে আরেক দফা আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে দিলেও নতুন ক্রেতা খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধাই হয়নি পুতিনের। এপ্রিল মাসেই রাশিয়া থেকে চীনে তেল ও গ্যাস রপ্তানি ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ক্রমান্বয়ে আরো বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। 

তবে এর অর্থ এই নয় যে, নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অনুমান, পশ্চিম থেকে আমদানি কমে যাওয়ায় এই বছরে রাশিয়ার অর্থনীতি ৮.৫ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। যদিও রাশিয়ার কাছে আমদানি করা পণ্যর যোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও নিজের অর্থনীতি চালু রাখার মতো প্রয়োজনীয় পণ্যর মজুর রয়েছে। তবুও দেশটিকে এই সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। তবে সময়ের সাথে সাথে রাশিয়ার জনগণও এই সংকটের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষমও হয়ে উঠবে। 

ইউরোপ কেবল আস্তে আস্তে নিজেদের রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে শুরু করেছে। যার ফলে মহাদেশটি এখনও অনেকাংশে রাশিয়ার উপর নিজেদের জ্বালানির চাহিদার জন্য নির্ভরশীল। এর ফলে পুতিনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক সংকট এড়ানো সম্ভব হয়েছে। রুবল দিয়ে গ্যাস ও তেলের মূল্য পরিশোধে ইউরোপীয় ক্রেতাদের বাধ্য করার ফলেও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে পুতিন। সেই সাথে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে ইচ্ছুক দেশগুলো থেকে নিজেদের চাহিদার খুচরা যন্ত্রাংশ এবং বিভিন্ন উপাদানের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতেও ক্রেমলিনের হাতে যথেষ্ট সময়ও রয়েছে। 

গেল সপ্তাহে যখন সারা বিশ্ব থেকে আগত আন্দোলনকারী ও বিশ্বনেতারা সুইজারল্যান্ডের দাভোসে মিলিত হন, তখন সকলে একযোগে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা এবং ইউক্রেনের জনগণের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।



ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের বাড়তে থাকা দামকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে নিমিষেই। যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে যা দেশটির ৪০ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ। পেট্রোলের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং অক্টোবরে এটি ৭০০-৮০০ পাউন্ড বৃদ্ধি পেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে বিশেষজ্ঞরা। 

যুদ্ধের ফলস্বরূপ, পশ্চিমা অর্থনীতিগুলো ধীরগতি বা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হতে শুরু করেছে যা বিশ্বব্যাপী ১৯৭০ এর স্থবিরতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি - ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড সহ – মনে করে সুদের হার বাড়িয়ে প্রায় দুই সংখ্যার কাছাকাছি থাকা মুদ্রাস্ফীতি রোধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। দেশজুড়ে বেকারত্ব বাড়তে চলেছে। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলি একই সমস্যার সম্মুখীন। কারণ তাদের বেশিরভাগই যুক্তরাজ্যের তুলনায় রাশিয়ান গ্যাসের উপর অনেক বেশি পরিমাণ নির্ভরশীল। 

বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলি আবার ভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি। দরিদ্র দেশগুলোতে এখন সবচেয়ে বড় সংকটের নাম খাদ্য। ইউক্রেন ও রাশিয়া বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ৩০ শতাংশ একাই সরবরাহ করে থাকে। ইউক্রেনের ব্ল্যাক সি বন্দর থেকে গম সরবরাহ বন্ধ থাকার কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে দিন দিন খাদ্য সংকট আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। 

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলি বলেন, "এই মুহূর্তে, ইউক্রেনের খাদ্য ভাণ্ডারগুলো শস্যতে পরিপূর্ণ ছিলো। কিন্তু একই সময়ে, বিশ্বজুড়ে ৪৪ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।”

প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন - আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ - মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যদি না উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেরাই জ্বালানী রপ্তানিকারক না হয় তবে তাদের একটি ত্রিমুখী আঘাতের সম্মুখীন হতে হবে। যেখানে জ্বালানী, খাদ্য সংকট এবং একই সাথে আর্থিক সঙ্কট সৃষ্টি করবে। দেশগুলোকে তাদের নিজের জনগণকে খাওয়ানো কিংবা তাদের আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের অর্থ ফেরত দেওয়ার মুখোমুখি হতে হবে যা দেশগুলোর সরকারকে একই সাথে বেশ বিপাকে ফেলবে। রুশ আগ্রাসনের পর শ্রীলঙ্কাই প্রথম দেশ যারা ঋণ খেলাপি কিন্তু এটিই শেষ নয়। ১৯৯০ দশকের পর থেকে যে কোনো সময়ের তুলনায় বিশ্ব এখন একটি ঘোর ঋণ সংকটের কাছাকাছি। 



শুরু থেকেই পশ্চিমারা পুতিনকে ‘খাদ্যকে পুঁজি’ করে বিশ্বব্যাপী সংকট তৈরির জন্য দায়ী করে আসছেন। অবশ্যই রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি এই যুদ্ধকে ঘিরে এক দীর্ঘ খেলা খেলার প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছেন। তার বিপক্ষে এখন আন্তর্জাতিক জোট টুকরো টুকরো হওয়ার অপেক্ষায়। ক্রেমলিন মনে করে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের কষ্টের সীমা পশ্চিমের চেয়ে ঢের বেশি এবং এটি সম্ভবত সঠিক। 

পশ্চিমাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা যে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে না তা যদি প্রমাণের প্রয়োজন হয়, তাহলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের ইউক্রেনকে আরো বেশি উন্নত রকেট সিস্টেম সরবরাহ করার সিদ্ধান্তকে খেয়াল করলেই তা বোঝা যাবে। পশ্চিমারা আশা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি জ্বালানী নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ফলেও পুতিনের আগ্রাসন বন্ধ করতে যে ব্যর্থতা তৈরি করেছে তা পুনরুদ্ধার করবে। ইউক্রেন থেকে পুতিনকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করবে। 

যুদ্ধের ময়দানে পুতিনের সম্পূর্ণ পরাজয়ই কেবল রাশিয়াকে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে পারে। যদিও সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ থেকে তেমটি আশা করার কোনো উপায় নেই। তবে অন্যান্য সম্ভাব্য উপায়ও আছে যুদ্ধ বন্ধে, আর সেটি হলো অর্থনৈতিক অবরোধ যদি শেষ পর্যন্ত কাজ করে, একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা যদি রাশিয়াকে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। অন্যথায় আলোচনার টেবিলই এই যুদ্ধ বন্ধের শেষ ভরসা। 

বর্তমান যুদ্ধের অবস্থান থেকে এটি স্পষ্ট, পুতিন এই যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন না এবং এই অর্থনৈতিক যুদ্ধের ফলে দুই পক্ষের সমান্তরালভাবে ক্ষতির সম্ভাবনা সুস্পষ্ট। উন্নত দেশগুলিতে জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী; দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সংকট এবং ঋণ সংকট প্রকট আকারে দেখা দিতে শুরু করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। 

বর্তমান বাস্তবতায় রাশিয়ান সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতায় ক্রেমলিনের সাথে আপোষ করা কঠিন হলেও, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় কেবল একটি জিনিসের কথাই বলা যায়: আজ না হোক কাল একটি চুক্তির দেখা মিলবে।

দ্যা গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত
আর্টিকেল লেখক: ল্যারি এলিয়ট, গার্ডিয়ানের অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭