বাংলাদেশের
সঙ্গীতের যুগ বলতে যেই সময়টাকে বোঝায় তা এক কথায় আশি নব্বইয়ের দশক নামে
পরিচিত। আধুনিক গানের পাশাপাশি অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য ব্যান্ডেরও আবির্ভাব
হয় সেই সময়টাতেই। গানের জগতে টিকে থাকার ও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখার
সবচেয়ে বড় একটা সময়ও ছিল সেই সময়টাই। ক্যাসেট, সিডির সেই সময়টায় ট্যাকনিকাল
পরিবর্তন এসেছে খুব কমই। খুব বেশি দিবস কেন্দ্রিক চর্চাও ছিলনা। বছরে দুই
ঈদ 'ডেইজ ইভেন্ট' হিসেবে স্বীকৃত হলেও সারা বছরই ইন্ডাস্ট্রি ব্যস্ত সময়
পার করতো। এখনও তাই হয়, ব্যস্ততার কমতি নেই আজও। কিন্তু যাদের জন্য এই
সৃষ্টিশীল কাজ, সেই শ্রোতাদের আগ্রহের ঘাটতি বেশ চোখে পড়ার মত।
এই
অনাগ্রহের কারণ কি? শ্রোতাদের অভিরুচির নেতিবাচক কোনো পরিবর্তন? একদমই না।
সেই যুগে শ্রোতাদের মন জয় করে যারা শিল্পী হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন, তারা
আজও এক নামেই সবার কাছে পরিচিত। এক্ষেত্রে অপ্রিয় সত্যটা হলো এখনকার মৌলিক
গানে এমন কিছু একটার অভাব আছে যা শুধু মাত্র সুর আর গানের কথা দিয়ে পূরণ
হচ্ছে না।
নতুন
নতুন অনেক গান হচ্ছে, কিন্তু তা মনে নাড়া দেবার সামর্থ পাচ্ছে না। অনেক
নতুন শিল্পীর আবির্ভাব হচ্ছে, কিন্তু লেগেসি ধরে রাখার ও শ্রোতাদের জিইয়ে
রাখার মতো আবেদন সেই অর্থে কেউ তৈরি করতে পারছে না। বিভিন্ন রিয়ালিটি শো,
লাইভ শো বা প্লেব্যাকের হাত ধরে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও একালে মৌলিক
গানের দূরাবস্থা অত্যান্ত পীড়াদায়ক। একজন শিল্পী বেঁচে থাকে তার মৌলিক
গানে। কিন্ত সেই বাস্তবতা ছাপিয়ে এখনকার দিনে শিল্পীদের মধ্যে তারকাখ্যাতি
মূখ্য হয়ে উঠেছে। আবার যারা নতুন গান নিয়ে কাজ করছে, বলা চলে সংগীতবোদ্ধারা
তাতে কোন ভাবেই আকৃষ্ট হচ্ছেন না, আগ্রহ হারাচ্ছেন। এখানে গানগুলির মান
প্রশ্নাতীত হতে পারছে না। অথচ সৃজনশীলতার প্রশ্নে পারফেকশনই প্রথম কথা। আর
এই পারফেকশনের জন্য শুধু কন্ঠ বা গায়কিই যথেষ্ট নয়। একটি গান শ্রোতাতের মনে
জায়গা করে নেওয়ার জন্য, কালজয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন কথা, সুর ও দর্শন-এই
তিনের সমন্বয়।
এমনতো
আর নয় যে, কোন কালেই দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে প্রতিভাবান গায়ক, গীতিকার,
সুরকাররা ছিলেন না। বরং একটা সময় রাজকীয় হালেই দাপট দেখিয়েছেন এদেশের
সংগীতাঙ্গনের তারকারা। ফেইসবুুক, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর চল তখন
ছিলনা, প্রচার-প্রসারের সুযোগ ছিল খুবই সীমিত, যার ফলে দেশের গানগুলো
বিশ্বমঞ্চ মাতানোর খুব বেশি সুযোগ হয়তো পায়নি, কিন্তু যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা
থাকা সত্ত্বেও সে সময় বাংলাদেশের গান পার্শ্ববর্তী দেশে ভীষণভাবে প্রশংসিত
হয়েছিল। এদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে শুরু করে পপ ও ব্যান্ড সংগীতের
প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন ওপার বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনের শিল্পী-কলাকুশলীরা।
আশি
নব্বই দশকের পরও একটা সময় নতুন কয়েকজন গুণী শিল্পীদের হাত ধরে অসংখ্য
শ্রোতাপ্রিয় গানের সৃষ্টি হয়েছিল। ফুয়াদ, হাবীব, বাপ্পা মজুমদার, বালাম,
ন্যান্সি, অর্ণব, তাহসানদের তো প্রতিশ্রুতিশীল বেশ কয়েকজন গুণী শিল্পী
অনেকটা নতুনভাবে নতুন একটা যুগের শুরু করেছিল এবং এফএম রেডিওর কল্যাণে
গানগুলোর জনপ্রিয়তা সে সময় ছিল তুঙ্গে। এটি খুব বেশি আগের কথাও নয়। মাত্র
দশ বছর আগের সেই গানগুলোর জনপ্রিতার কাছে কখনো মনেই হয়নি, দশ বছর পর
মনমাতানো গানের জন্য শ্রোতাদের মনে এমন হাহাকার সৃষ্টি হবে।
সৃষ্টিশীল
মানুষগুলো এখনো তাদের কাজ নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে নতুন
শিল্পীদেরও আর্বিভাব হচ্ছে। তারা দু-একটা মৌলিক গান উপহার দিচ্ছেন, তবে সেই
সময়ে যেমন একটি যুগ সৃষ্টি হয়েছিল সেরকম একটা যুগ সৃষ্টি হতে পারেনি।
কিন্তু
বিষয়টিকে মেনে নেওয়ারও সুযোগ নেই। সংস্কৃতিপ্রেমী কোন জাতি তাদের
যুগশ্রেষ্ঠ সময়কে হাতে নিয়ে বসে নেই। বরং অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন যুগের সুচনা
করছে। তাতে আগের সময়টি ম্লান হয়ে যায়নি, বরং পূর্বসূরীদের আদর্শ মেনে
সংস্কৃতির আরো বিস্তার হয়েছে। সংস্কৃতির হয় বিস্তার হবে নয়তো ম্লান হবে,
এটিই সত্য। আর এই সত্যকে মেনে নিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মের উচিৎ হবে আরো
উদার মানসিকতার সাথে, সমন্বিতভাবে এবং অহংবোধকে দূরে রেখে কার করে যাওয়া,
একই সাথে ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীলতার উৎকর্ষতা সাধন করা। নিজেকে যেমন সৃজনশীল
হতে হবে তেমনি সম্মান করতে হবে সৃষ্টিশীল মানুষদেরও। সৃষ্টিশীল কাজ
প্রতিযোগীতায় চলতে পারে না, শুধুমাত্র সমঝোতা ও সৌহার্দ্যের মধ্য দিয়েই
চলতে পারে।
আমাদের
সঙ্গীতের জগতে অসংখ্য গুণী সুকণ্ঠী গায়ক গায়িকা আছেন। কিন্তু অভাববোধের
জায়গাটা তৈরি করেছে গানের স্রষ্টারা। শিল্পীর গায়কি একটি গানে অনন্য মাত্রা
যোগ করতে পারে। কিন্তু কথা, সুর ও দর্শন- এই তিনটির সমন্বিত প্রয়াস পারে
একটি গানকে কালজয়ী সৃষ্টি হিসেবে উপহার দিতে। আর এই দায়িত্বটি সবার আগে
নিতে হবে গীতিকার-সুুরকার তথা গানের স্রষ্টাকেই।
এই
ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের অবস্থান নিজে তৈরি করে নেওয়ার ধারণা নিতান্তই বোকামী।
অবস্থান তৈরি হবে শ্রোতাদের ভালবাসায়। আর এই ভালবাসা সৃষ্টি হবে মানসম্মত ও
সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে। এদিকে বিভিন্ন গানের সাথে মিউজিক ভিডিওর
নামে বিদেশি অনুকরণের প্রবণতাও এখনকার দর্শক-শ্রোতাদের মনে বিরক্তির সৃষ্টি
করছে। দর্শকগেলানোর ধ্যানধারণার ব্যবসায়িক প্রভাব যে স্লো পয়জনের মতো ধীরে
ধীরে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকেই গিলে নিচ্ছে, বর্তমান সময়ের মিউজিক
ইন্ডাস্ট্রির কলাকুশলীতের এই বোধটুকুও আসতে হবে।
সৃষ্টিশীল
কাজে অর্থলিপ্সা বা পেশার দৌরাত্ব নয়, নেশা থাকা চাই। একইসাথে বিদেশি
অনুুকরণ থেকে দূরে থেকে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চাকেই ধরে রাখতে হবে। তাহলেই
সম্ভব হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনে, আমাদের বাংলা গানকে বিশ্বমঞ্চে তুলে
ধরা। দেশের কোটি মানুষের মন জয় করে এদেশের গান একদিন বিশ্বমঞ্চেও জায়গা করে
নেবে, বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে এই কামনা দেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের।