ইনসাইড থট

ভারতের চিকিৎসা ভিসা এড়াতে স্বাস্থ্যখাতে আমাদের করণীয়


প্রকাশ: 11/10/2022


Thumbnail

আমার এক নিকট আত্মীয় পিঠে ও কোমর ব্যথায় অতিষ্ঠ হয়ে ভারত যেতে চাইছে। সে জানে চেন্নাইতে আমার এক চিকিৎসক বন্ধু পল টি হেনরি নিউরো সার্জারিতে বেশ নাম করেছে। আমি তার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলাম। পলের সাথে আমার নিজেরও একটা প্রতিশ্রুতি ছিল একবার তার ওখানে যাবো। সে যুক্তরাষ্ট্রের ‘হেনরি ফোর্ড হেলথ সিস্টেমে’র সাথে সমন্বয় করে সেখানে একটি অলাভজনক হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। পল হেনরির অনুরোধে আমিও সেই আত্মীয়ের সাথে যেতে মনস্থ করলাম। খুশিতে আত্মহারা পল আমন্ত্রণপত্র মেইল করে লিখলো, ‘বি মাই গেস্ট ডিয়ার’! 

পলের দেয়া সকল কাগজপত্র নিয়ে আমি ট্যুরিষ্ট ভিসা ও আমার সেই আত্মীয় মেডিক্যাল চেক-আপের জন্যে ভারতীয় ভিসা সেন্টারে ভিসার জন্যে আবেদন করি। শত শত লোকের ভিড় ঠেলে আমাদের সেই আবেদন জমা দিতে সময় লেগেছে প্রায় ৪ঘন্টা। ভিড় ঠেলে বাইরে এসে জমা স্লিপে দেখি ভিসা ডেলিভারি হবে ২২দিন পরে! আবার ভিড় ঠেলে অনুসন্ধান কাউন্টারে গিয়ে জানালাম এই ভিসা আরও আগে পাওয়া দরকার কারণ যিনি অসুস্থ তার জন্যে এই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা কঠিন হবে। সেখানকার স্টাফ জানালেন ই-মেইল করতে হবে হাই কমিশনে।

আমি বাসায় ফিরেই আনুমানিক ৩টার দিকে সেই আত্মীয়ের পক্ষে ই-মেইল করলাম বিস্তারিত জানিয়ে। কোন উত্তর আজও পর্যন্ত আসেনি। না কোন প্রাপ্তি স্বীকার না কোন প্রতিউত্তর। একটি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সৌজন্য ও পেশাদারিত্ব সম্পর্কে আমার মনে সন্দেহ তৈরি হলে আমি তাদের ফোন করার উদ্যোগ নিলাম। একে একে সব কর্মকর্তাদের ফোন করলেও কেউ কখনও ফোন ধরেনি। তাহলে এদের ফোন কি সব নষ্ট! আমি সরাসরি হাই কমিশনারের নাম্বারে কল দিলাম। এক ভদ্রলোক ধরলেন ও সব শুনে বললেন আমি যেন ই-মেইলে সব জানাই। এছাড়া তার আর কিছু বলার নেই।

আবার ই-মেইল! শুনে আমার ডাক্তার বন্ধু পল হেনরিও সাথে সাথে ই-মেইল করেছে। কয়েকদিন যাবত আমরা চেষ্টা করলাম যেন দ্রুত ভিসা পাওয়া যায় বা ভিসা ছাড়াই যেন পাসপোর্ট দিয়ে দেয় যাতে অসুস্থ মানুষটি অন্য কোন দেশে যেয়ে চিকিৎসা নিতে পারে। শেষে সাংবাদিক বন্ধু, আমলা বন্ধু, পররাষ্ট্রের পরিচিতজন, সাবেক ভারতীয় এক ডেপুটি হাই কমিশনার, দিল্লীতে তাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিচিতজন সকলের মাধ্যমে ধরনা দিয়েও কোন কাজ হলো না। ছয়দিন পরে তারা ফোন করে জানালো এসে পাসপোর্ট নিয়ে যান। আমি সাথে সাথে গেলে পাসপোর্ট দিয়েছে কিন্তু সেই আত্মীয়েরটা দেয় নাই। তাকেই আসতে হবে। সে তো অসুস্থ, নড়তে পারে না, বলেছে তার স্ত্রী বা বাবা-মা আসতে পারে! আমি নিকটাত্মীয়, তার চিকিৎসার জন্যে টিকেট পর্যন্ত কাটা কিন্তু তাদের হৃদয় গলে নাই। উল্টো হাই কমিশনে কাকে বা কেন মেইল করেছিলাম ইত্যাদি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হলাম। বলেছি তার নাম্বারে কল করে ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই করে পাসপোর্ট দিন। কানেই নিলো না!

ফিরতে ফিরতে ভাবলাম ভারতীয় দূতাবাস বা তাঁদের কর্মকর্তারা তো এমন ছিল না। বাংলাদেশের প্রতি এমন কৌশলে কেন তারা গেল! আমি সরকারের মেধাবৃত্তি পেয়ে ১৯৮৪ সালে ভারতে (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) স্নাতকোত্তর থিসিস করতে গিয়েছি। সে দেশের বহু স্বনামধন্য মানুষ আমার পরিচিত। আমি দুই বাংলার সাংস্কৃতিক বিনিময় পরিষদের উদ্যোক্তা-আহবায়ক ছিলাম টানা ৫ পছর (১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত)। এই জীবনে শতাধিকবার ভারতে গেছি। আমার জন্যে চেন্নাই থেকে চিকিৎসক মেইল করেছে। দিল্লিতে তাদের পররাষ্ট্রের আমার যারা বন্ধু তাঁরা সুপারিশ করেছে। আগের ডেপুটি হাই কমিশনার বিশ্বদ্বীপ দে (এখন মুম্বাইতে এটমিক এনার্জিতে আছেন) বলেছেন কিন্তু তারা সামান্য সৌজন্য দেখায়নি। এটা কষ্টকর ও নাগরিক হিসেবে অপমানজনক। একজন মুমূর্ষু মানুষকেও নিজে যেয়ে কয়েক শো মানুষের লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট জমা দিতে হবে, এম্বুলেন্সে করে হলেও নিজে যেয়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসতে হবে – এসব কটু কথা আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের জন্যে ক্ষতিকর। মেডিক্যাল এথিক্স ও কূটনীতির ব্যবস্থাপনা যে এক নয়, এটা আর যাই হোক ভারত বা এই দূতাবাস সেটা বুঝে না।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। ভারতের চেয়ে আমাদের উন্নতি কোন অংশে কম নয়। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির প্রশংসা খোদ অমর্ত্য সেনও করেছেন। অপরদিকে আমরা এই দেশের স্বাস্থ্য খাতে একটি সাংস্কৃতিক দৈন্য তৈরি করে রেখেছি। ওবায়দুল কাদের সাহেব যখন গুরুতর অসুস্থ হলেন আমাদের দেশের চিকিৎসকগণ তার জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন ও তাঁকে যথাসম্ভব জরুরি ব্যবস্থাপনা দিতে পেরেছেন। কিন্তু আমরা ভারত থেকে ভাড়া করা বিমানে দেবি শেঠিকে নিয়ে এলাম, তিনি এসে জানালেন সব চিকিৎসা যথাযথ হয়েছে। এই সনদপত্রের কি আমাদের খুব জরুরি ছিল? আমরা তো ওবায়দুল কাদের সাহেবকে আরও উন্নততর চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুরে পাঠালাম, ভারতে নয়। কিন্তু দেশের মানুষের কাছে কী বার্তা গেল? দেশের মানুষ আমাদের চিকিৎসক সমাজের প্রতি একটি অনাস্থা ও অবিশ্বাসের বার্তা পেলো- যতই যা হোক, ভারতের ডাক্তার না দেখালে আমরা সন্তুষ্ট হ’তে পারছি না।

ভারতের তুলনায় আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা মোটেই দুর্বল নয়। দুর্বলতা হলো আমাদের মনের মধ্যে আর অন্যতম দু’টি দুর্বলতা হলো আমাদের চিকিৎসক সমাজের ধারাবাহিক চিকিৎসা পড়াশুনার (CME – Continuing Medical Education) ঘাটতি। আর এর সাথে আছে গবেষণার ব্যাপক দুর্বলতা। ভারতের চিকিৎসায় গবেষণার বালাই নেই। এরা যে কাজটা করেছে তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নত দেশের গবেষণা ফলাফল দৃশ্যমান অনুকরণ আর কাউন্সেলিং-কে রিচুয়াল বা ধর্মের সাথে মিশিয়ে সেবাকে বড় করে দেখানো। এটা সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের কাজ, এরা স্বাস্থ্য ব্যবসায় এই কৌশল নিখুঁতভাবে মেশাতে পেরেছে ফলে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন চিকিৎসাপ্রার্থী খুব সহজেই ভারতীয়দের এই সেবায় আকৃষ্ট হয়ে তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরমজ্ঞান বা আরাধ্য করে ফেলেছেন।

আমরা কখনও হিসাব করে দেখিনি বছরে আমরা আমাদের কী পরিমাণ কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে খরচ করি। চিকিৎসা সেবা ও তীর্থ ভ্রমণ এক করে ভারতে যাবার যে পারিবারিক পরিকল্পনা আমরা করি তা অসম ও বাংলাদেশে পর্যটক আকর্ষণ করার তুলনায় নিতান্তই ক্ষীণ। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভারতের তুলনায় আমাদের উন্নততর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা মোটেই কঠিন নয় যদি আমরাও সেবা সহনশীল হয়ে একে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অন্যতম কর্তব্য মনে করে নেই। এটাও মনে রাখতে হবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন শুধু সরকারের নয় জনগণেরও। আমরা বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে যেসব বিনিয়োগ করি তা খুবই অপরিকল্পিত ও রোগ-ব্যাধি নির্ভর নয়। আমরা দ্রুত মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে জেলা উপজেলায় অগণিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসেছি তা অনুমোদিত হোক বা না হোক, লক্ষ্য হলো মানুষ। অথচ চিকিৎসা ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল রোগ যেন তা মানুষ বা সমাজ বা পরিবেশের এমনকি অন্যান্য প্রাণিকুলের জীবনেও যেন অসুখ নিয়ে না আসে, যেন সবাই নিরোগ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে পারে। এই ইনক্লুসিভ বা সমেত প্রতিরোধ চিন্তা আমাদের এখন জরুরি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কট যেন কখনও প্রকট হয়ে আমাদের উন্নয়ন অর্থনীতিকে হুমকি না দেয় সে কারণেও আমাদের এই নাগরিক কর্তব্য বোধ জরুরি।

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যে এখন অতি আবশ্যক হলো রোগ প্রতিরোধ ও রোগ নির্ণয়ে জোর দেয়া। কোভিড সঙ্কটে দেখা গেছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রগুলো ফাঁকা, ডাক্তার সাহেবদের চেম্বার যেগুলো রাত ১টা ২টা পর্যন্ত রোগী দেখতো সেখানে কেউ নেই! কিন্তু দেশে মৃত্যুর বন্যা বয়ে যায়নি। ভারতে এতো পরিচিত সুন্দর স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সে সময়ে রাস্তা ঘাটে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকার বীভৎস ছবি আমরা দেখেছি। আমাদের দেশের মানুষের মনোবল, আমাদের সামাজিক সাহস ও রোগ প্রতিরোধে সম্মিলিত চেষ্টা সে সময়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তাহলে শুধু চিকিৎসার দ্বিতীয় মতের জন্যে আমাদের কেন ভারতে যেতে হবে?

আরও একটি বিষয় আমাদের ভালো করে বুঝা দরকার মানুষ কিন্তু অসুস্থ হয় বাড়িতে, হাসপাতালে নয়। কিন্তু আমরা এতো হাসপাতাল বানাচ্ছি কেন? আমাদের বানাতে হবে প্রান্তিক পর্যায়ের আধুনিক রোগ নির্ণয় কেন্দ্র যার একটি মডেল ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ ধারণ করতে পারে। এই ব্যবস্থায় গ্রামের যে কোন মানুষ সামান্য খরচে তার অসুখের পরামর্শ পেতে পারে ও ধীরে ধীরে রোগের মাত্রা বুঝে সে গ্রাম থেকে ইউনিয়নে, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা-জেলা ও বিভাগীয় শহরে যেতে পারে। কিন্তু কাজটা শুরু হ’তে হবে বাড়ী থেকেই। আমি আমার রামপাল স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের কাজে লক্ষ্য করেছি ১০০জন গ্রামবাসীর স্বাস্থ্যগত অসুবিধা যাচাই করে যদি যথাযথ নির্ণয় সেবা দেয়া যায় ধাপে ধাপে বিভাগীয় শহরে বা তৃতীয় প্রশাখা (টারশিয়ারী) স্তরের চিকিৎসার জন্যে গ্রামগুলো থেকে যাবার উপযুক্ত হন মাত্র ৬জন। বাকী ৯৪জনের চিকিৎসা বাড়িতে বা স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে দেয়া সম্ভব। কিন্তু শহরের চাকচিক্যময় ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রগুলো সেবা প্রত্যাশীদের উঁচু দাম নিয়েও হিমশিম খাচ্ছে, ভিড়ের জন্যে সেসবের বারান্দায় হাঁটাচলাও দায়।

আর বাড়িতে রেখে চিকিৎসার জন্যে যুক্ত হ’তে পারে ভার্চুয়াল কেয়ার বা দূরসেবা যা মাইক্রোসফটের সহায়তায় আমি আমার প্রকল্পে নিরাপদ করতে পেরেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্যে এই এক বিশাল সুযোগ। প্রতি গ্রামে যদি একজনও স্বাস্থ্য কর্মী থাকে তার হাতে একটি স্মার্ট ফোন থাকলেই যথেষ্ট। গ্রামের মানুষ যে কোন প্রয়োজনে ওই কর্মীর কাছে যাবে বা তাঁকে বাড়ি ডেকে নেবে। সেই কর্মী সব শুনে, সব তথ্য ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসা কেন্দ্রে বা চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে ভিডিওতে কথা বলতা পারে। বড় শহরে যাওয়া আসার খরচ ও ব্যয়ের চিন্তা বাদেও যদি এই কর্মীকে সেবা পেয়ে সামান্য সম্মানী দেয়া হয় তাতে গ্রামে গ্রামে অন্তত একজন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। কেন আমরা মানুষের কাছে সেবা নিয়ে যাবার এই চিন্তা করছি না জানিনা, নাকি একটি ‘চিকিৎসা কূটনীতি’র চক্র আমাদের যেতে দিচ্ছে না তা নিয়ে সকলের ভাবা উচিত। 


পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প 
ই-মেইল: rezasalimag@gmail.com


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭