প্রকাশ: 13/10/2022
বাংলাদেশের ঐত্যিহ্যবাহী ও প্রাচীন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আমি গর্বিত যে, আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম। দেশপ্রেম, নৈতিকতা, সততা, দলীয় কর্মীদের প্রতি ভালোবাসা, নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি শিখেছি ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই। সম্মান, খ্যাতি, নেতৃত্ব, ইত্যাদি যাকিছু পেয়েছি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকেই। কাজেই ছাত্রলীগের যে কোন দুর্নাম আমাকে ব্যথিত করে, কষ্ট দেয়।
১৯৪৮ সালের
৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতাকামী
প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী গড়ার আতুড়ঘর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দেশের রাজনীতিতে খ্যাতিমান
রাজনীতিবিদদের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছে এই ছাত্র সংগঠনে। এই দেশে যত বড় বড় রাজনৈতিক
অর্জন তা ছাত্রলীগের হাত ধরেই এসেছে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান,
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদান জাতি
চিরকাল স্মরণ করবে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা
থাকবে।
বর্তমানে দেশব্যাপী
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মকান্ডে যেন ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যবাহী জৌলুস হারাতে বসেছে।
চেইন অব কমান্ড না থাকা, অনুপ্রবেশকারীদের আধিপত্য, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজিসহ
বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সঙ্গে নেতাকর্মীরা জড়িত, এমন খবর এখন প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে।
ছাত্ররাজনীতির বর্তমান অবস্থা বেশ ‘ছন্নছাড়া’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিভিন্ন ছাত্র
সংগঠনের বর্তমান এবং সাবেক নেতৃবৃন্দ। বর্তমান সময়ের মত এতটা ‘ছন্নছাড়া’ ছাত্র রাজনীতি
কখনোই হয়নি বলে মনে করছেন কোন কোন সাবেক ছাত্রনেতৃবৃন্দ। এমনি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির
জন্য শুধুমাত্র ছাত্রনেতাদের দোষারোপ করা সঠিক নয় বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন।
যে কোন শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত তাদের ব্যক্তিগত
ব্যবহার ও আচরণে একজন সাধারণ ছাত্র আকৃষ্ট হয়। পরিচিত হয়ে সম্পর্ক স্থাপন করে। পরবর্তিতে
তাদের দলীয় আদর্শের কথা জানতে চেষ্টা করে। ছাত্রনেতাদের ব্যক্তিগত কর্মকান্ডে সন্তুষ্ট
হয়ে, তার দলীয় আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এবং সাবেক ছাত্রনেতার ভবিষ্যৎ জীবন পর্যালোচনা
করে একজন সাধারণ ছাত্র কোন একটি ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়, ছাত্ররাজনীতিতে হাতেখড়ি নেয়।
একজন ছাত্র
স্কুল জীবনে পিতামাতা বা অভিভাবকের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছাত্রনেতাদের
সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। সেসময় রাজনৈতিক দলের আদর্শের
প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নয়, নিতান্তই ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেই পছন্দের নেতাদের নেতৃত্বে
মিটিং-মিছিলসহ বিভিন্ন সমাবেশে অংশগ্রহণ করে থাকে। তারপর বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক বই
পড়া ও দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবর ও গুনীজনদের লেখা প্রবন্ধ পড়া এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতা থেকে জ্ঞান অর্জন করে,
বিভিন্ন সভা সমাবেশে জাতীয় নেতাদের বক্তব্য শুনে, বিভিন্ন বিশ্লেষণের পর পছন্দের নেতাদের
দলীয় আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে থাকে। এমনিভাবেই দেশের ক্রান্তিলগ্নে জীবনবাজি রেখে একজন
সাধারণ ছাত্র রাজনৈতিক দলের নেতার নেতৃত্বে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়। নিজেকে দলীয়
আদর্শের একজন কর্মী ও নেতায় পরিনত করে। দলীয় আদর্শের ভিত্তিতে দেশকে গড়ে তোলার জন্য
আত্মনিয়োগ করে, আত্মত্যাগ করে।
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ুয়া একজন ছাত্রনেতার লক্ষ্য থাকে ছাত্রসংসদ নির্বাচন। নির্বাচিত ভিপি-জিএস হয়ে বা
ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শাখার সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হয়ে পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ছাত্ররাজনীতিতে
অংশগ্রহণ করবে। কেন্দ্রীয় ছাত্ররাজনীতি শেষে
নেতারা জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবে। সেই লক্ষ্যে নিজেকে গড়ে তোলে। সাধারণ
ছাত্রছাত্রীদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত আচরনে ও চলাফেরায় সর্বদা সজাগ থাকে।
নিজেকে একজন যোগ্য প্রার্থী হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে।
কিন্তু বাস্তবতায়
যদি ভিন্ন চিত্র দেখা যায় তখনই ঐ সাধারণ ছাত্রটি, যিনি ছাত্রনেতায় পরিনত হয়েছেন,
বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। যেমন, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন না হওয়ায়
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতিতে
সম্পৃক্ত নেতাকর্মীরা হতাশায় নিমজ্জিত হয়। সে তখন কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার স্বপ্ন বাদ
দিয়ে বাস্তবতা মেনে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করে। শিক্ষা জীবন শেষ করে
একটা ভাল চাকুরী সন্ধানে নেমে পরে। কিন্তু চাকুরী প্রাপ্তিতেও বিভিন্ন বিড়ম্বনা। ছাত্ররাজনীতির
সাথে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীরা তার আরেক বন্ধু যিনি রাজনৈতিক কর্মী নন, তার সাথে প্রতিযোগিতায়
কৃতকার্য হতে পারে না। একপর্যায়ে চাকুরীর বয়সসীমা অতিক্রান্ত হলে হতাশ হয়ে বিপথগামী
হয়। বেঁচে থাকার তাগিদে, অনিচ্ছা সত্বেও, বৈধ-অবৈধ যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জনের পথ
খুঁজে বেড়ায়। কেউ সফল হয়, কেউ হারিয়ে যায়।
জেলা, কলেজ,
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সভাপতি সাধারণ সম্পাদকসহ যে সকল ছাত্রনেতা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে ব্যর্থ হয়, তারা স্থানীয় রাজনীতিতেও সুবিধা করতে
পারেনা। কারণ, স্থানীয়ভাবেও রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা
রয়েছে। সেখানেও ছাত্রনেতাদের তেমন সুযোগ নেই। তখনই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বেঁচে থাকার
তাগিদে অর্থ উপার্জনের উপায় খুঁজে। কিন্তু সেখানেও ছাত্রনেতাদের সুযোগ নেই। কারণ হঠাৎ
করে ব্যবসায়ী হওয়া যায় না, সেক্ষেত্রেও অভিজ্ঞতার সনদ খুঁজে।
এছাড়া বর্তমানে
সাবেক ছাত্রনেতা ও বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ভিপি-জিএস ও অন্যান্য নির্বাচিত
ছাত্রনেতাদের মধ্যে কতিপয় ছাড়া বেশীর ভাগের রাজনৈতিক পরিনতি দেখে পরবর্তী প্রজন্ম
আসলেই হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নাই।
ছাত্র রাজনীতির
সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি নেতাকর্মীর জন্য সংগঠনসমূহে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।
তাদের প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি শেষে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত
হওয়ার সুযোগ না থাকলে যোগ্যতা অনুযায়ী স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া বা চাকুরী
প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকলে দলীয় আদর্শে উজ্জীবিত সাবেক ছাত্রনেতারা বিপথগামী হবে না।
এছাড়া যেসব নেতাকর্মীর চাকুরীর বয়সসীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে তাদের বেঁচে থাকার তাগিদে
প্রয়োজনীয় অর্থ বৈধ উপায়ে উপার্জনের জন্য তাদেরকে ব্যবসা-বানিজ্যে বৈধ সুযোগ-সুবিধা
নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। অন্যথায় অনিচ্ছা সত্বেও, বেঁচে থাকার তাগিদে
অর্থ উপার্জনের জন্য টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত
হয়ে নিজের সংগঠনকে কলংকিত করে। নিজেদের বলয় ভারী করার জন্য এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল
করার জন্য আদর্শহীন অনেক টোকাই প্রকৃতির বা ভিন্ন দলীয় সন্ত্রাসী ছেলেদেরকে নিজের
সংগঠনের সদস্য করে। ফলে সংগঠনে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়, অনুপ্রবেশকারীদের আধিপত্য
বাড়ে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হয়।
সুতরাং বর্তমান
‘ছন্নছাড়া’ অবস্থার জন্য শুধু ছাত্রনেতাদের বা ছাত্ররাজনীতিকে দোষারোপ না করে ছাত্ররাজনীতির
স্বর্ণযুগে প্রচলিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন চালু করা এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিবর্তে
ছাত্ররাজনীতি শেষে সাবেক ছাত্রনেতারদের যোগ্যতা অনুযায়ী জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত
করা প্রয়োজন। আর সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত সাবেক
ছাত্রনেতাদের শিক্ষা শেষে চাকুরী বা বেঁচে থাকার তাগিদে প্রয়োজনীয় ব্যবসা-বানিজ্য প্রাপ্তির
নিশ্চয়তার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন, তাহলেই বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব
হতে পারে।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭