ইনসাইড ইনভেস্টিগেশন

‘ভিডিও প্রকাশ করে দায় স্বীকারের পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের’


প্রকাশ: 25/01/2023


Thumbnail

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের নানা মুহূর্তের ভিডিও প্রকাশ করেছে র‌্যাব। এসব ভিডিওতে এই জঙ্গি সংগঠনের আমিরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের প্রশিক্ষণ, রণকৌশলগত চলাচল, চলতি পথে অস্ত্র বহন এবং টহলকালীন ও ব্লক করার সময় অবস্থান কেমন হবে, তা দেখানো হয়েছে। এছাড়া শত্রুর ক্যাম্পে হানা দেওয়ার সময় কীভাবে ৩৬০ ডিগ্রির কৌণিক দূরত্বে সদস্যরা অবস্থান নেবেন, সেই মহড়াও রয়েছে ভিডিওতে।

র‌্যাব জানিয়েছে, বড় ধরনের হামলার পর অস্ত্রসহ এসব ভিডিও প্রকাশ করে দায় স্বীকারের পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের। বিশেষ করে কাশিমপুর কারাগারে একযোগে জঙ্গি হামলা চালিয়ে উগ্রপন্থিদের ছাড়িয়ে নেওয়ার ছক কষেছিলেন তারা। এরমধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছিল মূল লক্ষ্য। যে কারণে ছোট ছোট এই ভিডিওগুলো তিন-চার মাস আগে থেকে তৈরি করা। 

র‌্যাব জানায়, জামাতুল আনসারের সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমানকে এই ভিডিও করার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। প্রশ্নের উত্তরে এসব তথ্য জানায় জামাতুল আনসারের সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান। 

    

মাত্র ৮ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। ভিডিওটিতে স্পষ্ট  ফুটে উঠেছে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং নানা মুহূর্তের প্রস্তুতির চিত্র। সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তুতিসহ সংগঠিত হচ্ছে জঙ্গি সংগঠনটি- যা অনেকটা ফিল্মি কায়দায়। অর্থাৎ চলচ্চিত্র কিংবা যুদ্ধের কোনো ডকুমেন্টারিতেই এমন দৃশ্য দেখা যায়।     

মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে র‌্যাব। ভিডিওতে সামরিক পোশাকের আদলে তৈরি পোশাক পরে একে-২২ রাইফেল ও শর্টগান নিয়ে প্রশিক্ষণের দৃশ্য দেখা গেছে। ভিডিওতে তাতে যে ২২-২৩ জনকে দেখা গেছে, তাদের প্রায় সবার পরিচয় নিশ্চিত করা গেছে বলেও জানায় র‌্যাব। এদের মধ্যে রয়েছেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, কথিত সামরিক কমান্ডার শিব্বির আহমেদ ওরফে হামিদ কারছে এবং দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন।


র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত সোমবার (২৪ জানুয়ারি) ভোরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ও তার সহযোগী আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। মাসুকুর রহমানের কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। সেই ফোনেই পাওয়া যায় পার্বত্য অঞ্চলে সংগঠনটির সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও।

র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হওয়া ভিডিওতে জঙ্গিদের কয়েকটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দেখানো হয়েছে। সেগুলো হলো- জর্দান ক্যাম্প, ডা. আহমেদ ক্যাম্প, রেতলাঙ ক্যাম্প, রামজুদান পাহাড়ের পাশে রামজুদান ক্যাম্প। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এসব ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছে। ভিডিওর শুরুতেই জামাতুল আনসারের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদকে দেখা গেছে। ঠিক তার পেছনেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) এক প্রশিক্ষককেও দেখা গেছে।

ভিডিওচিত্রে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের জঙ্গি রয়েছে বলেও জানিয়েছে র‌্যাব। তবে এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীরের ছবি দেখা যায়নি। গত সোমবার কক্সবাজারে রনবীরের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া তার সহযোগী আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে ভিডিওতে দেখা গেছে। আবুল বাশার এই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং বোমা তৈরির বড় কারিগর বলে জানায় র‌্যাব।


ভিডিওতে আরও দেখা যায়, জঙ্গিদের হাতে অস্ত্র, ওয়াকিটকি, কারও মাথায় কাফনের কাপড়। সব তরুণের চোখ-মুখ হাস্যোজ্জ্বল। নিজেরা রান্না করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন ও খাওয়া-দাওয়া করছেন। পাহাড়ে তৈরি বাঙ্কারে কেউ কেউ পাহারা বসিয়েছেন। বিশাল কড়াইয়ে বনের ভেতরে কথিত হিজরতের উদ্দেশে ঘরছাড়া তরুণরা মাংস রান্না করছেন। কোনো তরুণের কাঁধে ভারী অস্ত্র। তারা কাঠের তৈরি ক্যাম্প পাহারা দিচ্ছেন। কারও গায়ে কমব্যাট ড্রেস। এ সময় রাতের আঁধারে একজনকে গাইতে শোনা যায়, ‘মাথায় কাফন বেঁধে জঙ্গি মিশন দুনিয়াতে ছড়িয়ে দাও’।

বিভিন্ন ক্যাম্পে সামরিক কার্যক্রম বা প্রশিক্ষণের সার্বিক দায়িত্বে থাকা দুই সদস্যকে ভিডিওতে দেখা গেছে জানিয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ভিডিওতে সাব্বির ওরফে কারসে এবং দিদার ওরফে চাম্পাইকে দেখা গেছে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সামরিক কার্যক্রম বা প্রশিক্ষণ দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। দুটি ভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় এ দুজনকে। আর পুরো সামরিক কার্যক্রম দেখভাল করতেন গ্রেফতার হওয়া সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান। ভিডিওতে সালেহ ও আল-আমিন নামের আরও দুজনকে দেখা গেছে। গ্রেফতার হওয়া সালেহ কদিন আগে বান্দরবানে শারক্বীয়ার দুই সদস্যের কবরের সন্ধান দিয়েছিলেন।


এই ভিডিও করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আছেন ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করা। সংগঠনটির সামরিক শাখায় যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তাদের করণীয় কী হবে, সে বিষয়টি সামনে রেখেও ভিডিওটি করা হয়েছে। সমতলে অবস্থানকারী বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভিডিও দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করাও ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।

প্রসঙ্গত, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া আটজন তরুণের মধ্যে চারজন ও কেএনএফ সদস্যসহ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বর্তমান আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। উগ্রবাদী এ সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্য রয়েছেন। তারা দাওয়াতি, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন।

এর মধ্যে শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতি শাখার প্রধান, রনবীর সামরিক শাখার প্রধান, মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার সেকেন্ড ইন কমান্ড, মোশারফ হোসেন রাকিব অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীন মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছেন।

নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের ৫৫ জন সদস্যকে কেএনএফ প্রধান নাথান বম, সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ভাংচুং লিয়ান বম, মিডিয়া শাখার প্রধান কথিত লে. কর্নেল লালজং মুই মাওয়াইয়া, কথিত লে. কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল চির চির ময়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।  



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭