কালার ইনসাইড

আমি আমার বাবাকে বাবা বলতে চাই, ড্যাড না

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/02/2018


Thumbnail

ভাষার মাস গৌরবের মাস অহংকারের মাস বীরের মাস প্রতিবাদী মাস ফেব্রুয়ারি। মনে পড়ে যায় ৫২র সেই রাজপথ রাঙ্গানো স্মৃতির কথা। সেই মাসে ২১শে ফেব্রুয়ারি’র মর্যাদায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১জন গুণীকে একুশে পদক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ ২০শে ফেব্রয়ারি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদকপ্রাপ্তদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। এ বিষয়ে কথা হয় ২১ জন গুণীর একজনের সাথে আর তিনি হলেন আমাদের বাংলা গানের কিংবদন্তী সুরকার শেখ সাদী খান।

একুশে পদক প্রাপ্তি কেমন লাগছে?

যেকোনো প্রাপ্তি কিংবা স্বীকৃতি ভালো লাগার এবং ভালো লাগে। নিজেকে তখন বলতে ইচ্ছে হয় যে কর্মের সম্মান কর্মেই মেলে।। আর একুশের পদকের মতো প্রাপ্তিতো আসলেই আনন্দের। আমার ভালো লাগছে। আসলে সঙ্গীতইতো আমার জীবনের সব ছিলো। এটাকে ঘিরেই তো বেচেঁ আছি।

এই সাধনায়তো সারা জীবন পার করলাম। এখন বয়সের শেষে এসে এমন স্বীকৃতি সত্যিই প্রশান্তির। একুশে পদক কর্তৃপক্ষসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর সবার কাছে দোয়া চাই যেন আমৃত্যু সঙ্গীত দিয়ে আপনাদের আনন্দ দিতে পারি।

বাবা ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার ওস্তাদ আয়াত আলী খান, সঙ্গীত পরিবারে বেড়ে ওঠা আপনার….

আমার বাবা বা চাচার ছিলেন এক একজন দিকপাল। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান চাচা। ওস্তাদ আয়েত আলী খান বাবা। বিখ্যাত ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান, বাহাদুর হোসেন খান ও সংগীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খানের ছোট ভাই। আমার নয় ভাইবোন। তাঁদের প্রায় সবারই বিচরণ সংগীতের আঙিনায়। সবারই হাতেখড়ি বাবার কাছেই। আমার বোনের জামাই আবার পন্ডিত রবিশঙ্কর।

সঙ্গীত পরিবারের হওয়াতেই কি গানে আসা?

আমার ভাবনাটা আসলো আমি যখন এসএসসি পাশ করলাম। আমার মেজ ভাই একবার বাংলাদেশে আসলেন। উনি ভারতেই থাকতেন। তখন বললেন তোমার পরীক্ষা তো শেষ হয়েছে। আসো আমার কাছ থেকে কদিন বেড়িয়ে যাও। ওই বেড়াতে গিয়ে আমি আষ্টেপিষ্টে আটকে পড়লাম। তখন উনি বললেন আসছো যখন আমার কাছ থেকে কিছু তালিম নেও। ওনার শিষ্যত্য গ্রহন করলাম। আমার বেহালার হাতেখড়ি হলো। আমার ক্ল্যাসিক মিউজিক শিক্ষার জার্নিটা ওনার কাছ থেকেই শুরু হলো।

সুরকার হওয়াটা কীভাবে?

আমার টোটাল ফ্যামিলি কিন্তু যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী। কিন্তু আমাদের আপন ভাইদের ভিতরে কেউ বেহালা বাজাতেন না। ওই যে বললাম আমার তালিম নিলাম ওস্তাদ বাহাদুর খানের কাছে। যিনি আমার গুরু। যখন ভারত থেকে ব্যাক করে আসলাম। তখন আমার বাবা নিয়ে গেলেন চট্টগ্রাম রেডিওতে। এটা ১৯৬৫ সালের কথা। বাবা বললেন তুমি একটা অডিশন দেও। যতটুকু বিদ্যা শিখেছো সেটা নিয়মিত না করলে তো ভুলে যাবে। এসএসসির পর তিন বছর পড়াশুনায় গ্যাপ। তখন এসে পড়াশুনাও শুরু করলাম। তো ওখানে বাজনা শুনে তারা আমাকে জোর করে চাকরি দিয়ে দিল। আমি তো চাকরি কি বা আমার কাজটা কি। কিছুই জানি না। তারা বললেন তুমি এখানে থাকো শুধু। ওখানে আমার যে শিক্ষাটা হলো, ক্লাসিক থেকে কমার্শিয়াল শিক্ষটা হলো। ওখানে তিন বছর ছিলাম। ঢাকাতে আসার পরে আমাকে অফার দিলো বাংলাদেশে টেলিভিশন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন…

২৫ শে মার্চ গনহত্যা হওয়ার পর আসলে সবার মন পরিবর্তন হয়ে গেছে। একটা রাতেই মানুষের মন কতটা পরিবর্তন হতে পারে সেদিন বুঝলাম। কারফিউ ওঠার পরে দেখলাম এখানে ওখানে লাশ পরে আছে।তখন মনটা চাইতো কিছু করি। আর কিছু না পারি ওখান থেকে পালিয়ে যাই। ওই সব দেখা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিলো। এপ্রিলের শুরুর দিকে শুনলাম পাকিস্তানিরা আমাদের গ্রামের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। আমার মা আর ছোট ভাই বোনরা তখন কুমিল্লায় থাকেন। বাবা ১৯৬৭ সালের দিকেই মারা গিয়েছিলেন। এই খবর শুনে আমার বড় ভাই বললেন তুমি গ্রামে গিয়ে পরিবারের পাশে দাড়াও। এখানে আমি গান পয়েন্টে আছি। আমি সরতে পারবো না। অনেক কষ্টে গ্রামে গিয়ে আমার পরিবার রেখে আসলাম বোন জামাইর বাড়ি রাজাপুরে। সে সময় কথা হয় আমার বোন জামাই ও বন্ধু মেজর গিয়াসের সঙ্গে। সেখান থেকে আমি, নিজাম, গিয়াস, আমার আরেকজন খালাতো ভাই। আমরা চলে গেলাম আগরতলা। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিবো। কিন্তু ওখানে আমার আরো কিছু বন্ধু পেয়ে গেলাম। ওরা আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দিলো না। তারা বললো তুই স্বাধীন বাংলা বেতারে জয়েন্ট করো। আমি জানতাম না কোথায় কী। তখন ওরাই বললো যা শুনতে পেরেছি। কলকাতাতে এটা অবস্থিত। আমার ভাই ছিল রেডিও বাংলাদেশের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা। মোবারক হোসেন খান। তিনি আমাকে আগেই বলেছিলেন পরিবার শিফট করে চলে আসবে। তোমার নাম খাতা- কলমে আছে। তুমি কোথাও কিছু করলে আমাকে এসে ধরবে। আমি কোনভাবে গেলাম কলকাতায়। গিয়ে দেখি আমার ছোট ভাইবোন থেকে শুরু করে সবাই কলকাতায়। মানে আমার আগেই চলে এসেছে। কিন্তু আমি কলকাতা নেমেই খোজ করলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কোথায়। ওখানে ভাইয়ের বাসার কাছাকাছিই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার। সেন্ট্রাল রোডের একটা বাড়িতে ছিল ওটা। তখন সমর দাশ, আব্দুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, সুজেয় শ্যাম, কল্যানী ঘোষদের পেয়েছি আমি। ওখানে আমি ভায়োলিন বাজাতাম। একটা গানের সুর করেছিলাম। কিন্তু কোন না কোনভাবে সেই গানটা রেকর্ডিং করতে আমি পারিনি। সেটাও আমার জীবনের একটা দু:খ বলা যায়।

তারপরের চলন কীভাবে হল ?

যুদ্ধ শেষে হওয়ার আগেই চলে এলাম দেশে। বাংলাদেশ বেতারে চাকরি নিলাম। ওখান থেকে আসলে নিজেকে প্রমান করার সুযোগগুলো পাচ্ছিলাম।

এই যে নতুন প্রজন্ম গান গাইছে। তাদের ভিতরে বাংলা সংস্কৃতি কতটা দেখেন?

আমি কিন্তু অত্যন্ত আধুনিক মানুষ। আমার সাজপোশাক এবং চলন-বলনেও তা প্রকাশ পায়। তাই বলে আমি আমার বাবাকে বাবা বলতে চাই, ড্যাড না। আমার সংস্কৃতিকে যতটুকু পারি, ইম্প্রোভাইস করে এই সময় নিজের জায়গা করে নিতে চাই। সেভাবেই চলছি।নতুন প্রজন্মকে সেটা ভাবতে হবে।

 

বাংলা ইনসাইডার/এমআরএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭