এডিটর’স মাইন্ড

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওলটপালট’ ক্ষমতা এবং মাহাথির থেকে শেখ হাসিনা


প্রকাশ: 16/04/2023


Thumbnail

মাহাথির মোহাম্মদ। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি। ১৯৮১ সাল থেকে টানা ২২ বছর মালয়েশিয়ার সরকারপ্রধান ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে মালয়েশিয়া বদলে গেছে। ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মাহাথিরের নেতৃত্ব এক উদাহরণ। মাহাথির মোহাম্মদ যখন তাঁর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের নজর পড়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধাবমান মালয়েশিয়ার প্রতি।  এর কারণ ছিল মালয়েশিয়ার গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ব নেতা হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের উত্থান। তিনি মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানাতেন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মাহাথির মার্কিন এ নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ইরাক আগ্রাসনের পর জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে মাহাথির মোহাম্মদ যুক্তরাষ্ট্রকে আগ্রাসনবাদী এবং যুদ্ধবাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। মাহাথিরের বক্তব্য সাড়া বিশ্বে তোলপাড় ফেলেছিল। পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র মালয়েশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসন, বিরোধী মত দমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ইস্যু সামনে এনেছিল। মাহাথিরকে চাপে রাখতে সেখানে উগ্র মৌলবাদীদের উসকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। মাহাথিরকে থামাতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে গোপনে নানা সহায়তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যাতে তারা মাহাথিরের বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। মালয়েশিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধী মত দমন নিয়ে সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন মালয়েশিয়ার সরকার পরিবর্তন করতে পারেনি। মাহাথির ২০০৩ সালে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। যুক্তরাষ্ট্র মালয়েশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট করেনি। দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেড়েই গেছে। কারণ, অর্থনৈতিক কারণে মালয়েশিয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আবার ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মালয়েশিয়ারও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন ছিল। দুই দেশের বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে ভিন্ন অবস্থানের পর কূটনৈতিক সম্পর্ক অটুট ছিল। এ সময় মাহাথির মোহাম্মদ এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি শত্রু হয় তাহলে বিপজ্জনক আর যদি বন্ধু হয় তাহলে তা মারাত্মক।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পেশাদারিত্বের এক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। বন্ধু বা শত্রু হননি। যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করতে এতটুকু ভয় পাননি। আবার তাদের ভালো কাজের প্রশংসাও করেছেন।

ঠিক কুড়ি বছর পর মাহাথিরের মতো একজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিশ্বনেতা দেখল বিশ্ব। সেই নেতার নাম শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বড় গুণ হলো- স্পষ্টবাদিতা। তিনি যা বিশ্বাস করেন তা সরাসরি বলেন। কোনো রাখঢাক ছাড়াই। অপ্রিয় সত্য বলতে তিনি পিছপা হন না। সত্য সরাসরি স্পষ্ট করে বলার বিপদ জেনেই তিনি অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেন। রাজনীতিতে এ জন্য যেমন তাঁকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তেমনি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা তিনি এ জন্য অর্জন করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ এ কবিতার পঙ্ক্তি যেন শেখ হাসিনার পথচলার দিশারী। তিনি জানেন, অনেকে অসন্তুষ্ট হবে, বিব্রত হবে তবুও তিনি ৭৫ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এত নেতা, এত বড় দল তারা কোথায় ছিল।’ ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কীভাবে হারানো হয়েছে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন অকপটে। বলেছেন, ‘গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি।’ ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে জেতাতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর ভূমিকা নিয়েও আওয়ামী লীগ সভাপতি একাধিক বক্তৃতায় স্পষ্ট, খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন। এসব বক্তব্যের পার্শ¦প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, কোনো প্রভাবশালী দেশ অসন্তুষ্ট হবে কি না ইত্যাদি ভাবনা তাঁকে সত্য উচ্চারণে পিছপা করেনি। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে জনগণকে পর্দার আড়ালের ষড়যন্ত্রের কথা খোলামেলাভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। লাভ-ক্ষতির নিক্তিতে সত্যকে মাপেননি। এটাই শেখ হাসিনা। সাহসী উচ্চারণই শেখ হাসিনার শক্তি। এ কথাটি আজ সবাই জানে। তবে ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্য অতীতের সব বক্তব্যকে ছাপিয়ে গেছে। জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, স্পষ্টভাষী, আক্রমণাত্মক এবং সাহসী। প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যে একটি দার্শনিক মর্মার্থ থাকে। শেখ হাসিনার বক্তব্যের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। শুধু দেশের প্রেক্ষাপটে নয়, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার বক্তৃতা গভীর তাৎপর্যময়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ বক্তৃতায় তিনি গণতন্ত্রের সব শত্রুকে একসঙ্গে চিহ্নিত করেছেন, সমালোচনা করেছেন। পাশাপাশি তাঁর বক্তৃতায় মুসলিম বিশ্বের সংকটও উঠে এসেছে। এ বক্তৃতায় তিনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন আবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার কথাও স্মরণ করেছেন। আমি মনে করি তিনটি কারণে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য আলাদা গুরুত্ব রাখে। প্রথমত. সময়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময়টি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন নানামুখী মেরুকরণ ঠিক তখন সংসদ নেতার এ বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রী যখন এ বক্তব্য রাখছিলেন তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেন ওয়াশিংটনে অবস্থান করেছিলেন। জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের কয়েক ঘণ্টা পরই ড. মোমেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। নানা কারণে বিশেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মোমেন-ব্লিঙ্কেন বৈঠক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বৈঠকের আগে সংসদ নেতা কি ইচ্ছাকৃতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথাগুলো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে সাহস পান না সেই কথাগুলো বলে প্রধানমন্ত্রী কি বাংলাদেশের বার্তাটি পৌঁছে দিলেন। বৈঠকের আগে নিশ্চয়ই মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে মি. ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জেনেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে হয়তো এর দৃশ্যমান প্রভাব চোখে পড়বে না। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তাদের কৌশল পুনর্বিন্যাস করবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময়টি গুরুত্বপূর্ণ। যখন চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব-ইরান বৈরিতার ইতি ঘটতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে একটি বলয় তৈরি হয়েছে। তখন ‘মুসলিম দেশগুলো কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে’ বলে শেখ হাসিনা মূলত প্রগতিশীল, উদার মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। যেমনটি হয়েছিলেন মাহাথির।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বিতীয় তাৎপর্য হলো সব ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর জাতীয় সংসদের ভাষণে গণতন্ত্রের পাঁচ প্রতিপক্ষকে একসঙ্গে চিহ্নিত করেছেন। শেখ হাসিনা সংসদের ভাষণে যাদের সমালোচনা করেছেন তারা হলেন বিএনপি এবং তাদের নেতৃবৃন্দ। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার গোষ্ঠী। সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালে ষড়যন্ত্র করছে এ পঞ্চভূত। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে নির্বাচনে যাবে না- এ দাবিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এ রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাতাস দিচ্ছে সুশীলরা। সুশীলদের এ তৎপরতাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রথম আলো গোষ্ঠী। সুশীলরা এবং প্রথম আলো মিলে দেশে আবারও এক-এগারোর মতো একটি অনির্বাচিত সরকার আনতে চায়। এ জন্যই তারা বিএনপির আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সুশীল নিয়ন্ত্রিত প্রথম আলো এক-এগারোর সময় কী ভূমিকা পালন করেছিল তা-ও উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, এ পুরো গণতন্ত্রবিনাশী তৎপরতায় পৃষ্ঠপোষকতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এ আগ্রাসী ভূমিকার কারণ তাদের স্বার্থ এবং ড. ইউনূসের তৎপরতা। প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক সভামঞ্চে বা সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে এ ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন না করে কেন সংসদে করলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আমার মনে হয় তিনি ইচ্ছা করেই এ বক্তব্যটি জাতীয় সংসদে রেকর্ড করে রাখলেন। জাতীয় সংসদে সংসদ নেতা হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বার্তা দিলেন। যাদের সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার ‘ওলটপালট’ করতে চাইছে তাদের দোষত্রুটি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দিলেন ষড়যন্ত্রকারীরা অযোগ্য। ভালো বিকল্প নয়। সংসদ নেতার ভাষণের তৃতীয় তাৎপর্য হলো- ক্ষমতাকে তুচ্ছজ্ঞান করা। আমার বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথা ছিল এরকম- “হ্যাঁ তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যে কোনো দেশে ক্ষমতা উল্টাতে পারে, পাল্টাতে পারে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে আরও কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।” প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। তারপরও তিনি সত্য উচ্চারণে দ্বিধাহীন। এখান থেকেই বোঝা যায় শেখ হাসিনা এখনো ক্ষমতার মোহে দিকভ্রান্ত হননি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতালোভীরা কত কিছু করে। যুক্তরাষ্ট্রের মর্জি মতো চলার সব চেষ্টা করে। মার্কিন ভয়ে স্বাধীন ও স্বকীয় সত্তা বিসর্জন দেয়। কিন্তু শেখ হাসিনা দেশের ও জনগণের স্বার্থের বাইরে কিছুই করেন না। এমনকি ক্ষমতা হারানোর ভয়েও তিনি আদর্শ বিচ্যুত হন না। ক্ষমতার লোভে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কারও অন্যায্য প্রস্তাব যে শেখ হাসিনা মানবেন না, এ বক্তব্য তাঁর এক দলিল।

প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যি বাংলাদেশের ক্ষমতার ওলটপালট করতে চায়? এ জন্যই কি নির্বাচন ইস্যুকে তারা সামনে এনেছে। একথা ঠিক বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ এখন রীতিমতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেই দিয়েছে আগামী নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক অর্থাৎ বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ এ নির্বাচনে নিশ্চিত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। এর কোনো ব্যত্যয় হলে তারা যে সেই নির্বাচন মানবে না। এখন বিএনপি বুঝে গেছে তাদের ছাড়া নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই তারা আরও গো ধরে বসে আছে। এর ফলে গণতন্ত্র সংকটে পড়ার শঙ্কায়। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আগ্রহী হতো তাহলে দুটি কাজ করত। প্রথমত. তারা নির্বাচন কীভাবে হচ্ছে তা দেখত। কারা অংশগ্রহণ করছে না করছে তা তাদের দেখার বিষয় নয়। কারণ একটি দেশে অনেক রাজনৈতিক দল থাকে। সব দল সব নির্বাচনে অংশ নেয় না। ব্যক্তিগত কারণে, দলগত কারণে অথবা কৌশলগত কারণে কোনো নির্বাচন থেকে একটি রাজনৈতিক দল দূরে সরে যেতেই পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন মানে বিদ্যমান দলগুলোর মধ্যে যে নির্বাচন হচ্ছে তা পরিপূর্ণ নিরপেক্ষ এবং অবাধ হচ্ছে কি না সেটি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত. যুক্তরাষ্ট্র সত্যি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাহলে তারা বিএনপিকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ নিত। একটি রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করত। যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার অবস্থান দেখে মনে হতেই পারে তারা রাজনৈতিক সমঝোতা নয় বরং বর্তমান সরকারকে চাপে ফেলতে চায়। অর্থাৎ নির্বাচন একটি উপলক্ষ মাত্র। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বহুমাত্রিক আগ্রহ আছে। বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের বাড়াবাড়ি রকমের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের এ আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত নয়। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারত চুটিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করছে। ভারতের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশকে চাপ দেওয়ার অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তাই চীনবিরোধী অবস্থানের পরও বিশ্ব মেরুকরণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত অনুগত নয়। পাকিস্তান ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের হাতছাড়া হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকটে ডুবতে থাকা পাকিস্তান এখন খরকুটোর মতো চীনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার শেষ চেষ্টায় ব্যস্ত। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পালিয়েছে। এক সময় বিশ্ব রাজনীতি এবং সামরিক কৌশলে এ উপমহাদেশ ছিল মার্কিন করতলগত। কিন্তু সেখানে এখন পতাকা উড়িয়েছে চীন। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গিনিপিগ’ হিসেবে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্যে হাত বাড়িয়েছে। আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। কিন্তু সেখানে মার্কিন সূর্য এখন অস্তমিত প্রায়। নয়া অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদে বিচলিত রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ। এ উপমহাদেশে বাংলাদেশই একমাত্র স্বাতন্ত্র্য কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে টিকে আছে। ‘কারও প্রতি বৈরিতা নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’- এ অবস্থানের জন্যই বাংলাদেশ যেমন চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়িয়েছে, তেমনি ভারতের সঙ্গে বিশ্বস্ত বন্ধুত্বকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়। ’৭১ এর আরেক পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক অটুট রেখেছে বাংলাদেশ। গত ১৪ বছরে অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন পরাশক্তিদের জন্য অত্যন্ত লোভনীয় এক ভূখ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে এটি একটি আকর্ষণীয় বাজার। আর বঙ্গোপসাগরের কারণে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামরিক উত্তেজনার কারণে ‘বাংলাদেশে’ এখন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আর এ কারণেই ইদানীং এ ছোট্ট ভূখন্ডের গণতন্ত্রের জন্য মার্কিন নীতিনির্ধারকদের নিদ্রাহীন রাত। তারা এখানে একান্ত অনুগত কাউকে বসিয়ে নিশ্চিত থাকতে চায়। তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কিছু সিদ্ধান্তে। যেমন ৪ এপ্রিল জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়। ইউরোপের কয়েকটি দেশ এ প্রস্তাব আনে। বাংলাদেশ এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশেই অনেকে এ সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া এ প্রস্তাবের বিপক্ষে যারা ভোট দেয় তারা হলো- চীন, বলিভিয়া, কিউবা, পাকিস্তান ইত্যাদি। তাহলে কি বাংলাদেশ তার বহুল প্রশংসিত পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসেছে? বাংলাদেশ কি নতুন বিশ্ব মেরুকরণে চীন-রাশিয়ামুখী? চার বছর ধরে সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরকম অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা বাংলাদেশ সহজেই এড়িয়ে যেতে পারত। এসব সিদ্ধান্ত পশ্চিমা বিশ্বকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে অতিরিক্ত আবেগময় করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারও কারও আগ্রহ সন্দেহজনক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক কূটনীতির ফলে কোণঠাসা যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু ভাবতে পারছে না। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো- যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অব্যাহত লবিং এবং প্রচারণা। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহলে এরা সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যাচার করছে। এর ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা ভালোই বিভ্রান্ত হয়েছেন। আবার সরকারের ভিতরের কিছু ব্যক্তির দায়িত্বহীন কর্মকান্ড দুই দেশের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। এরকম বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কৌশলগত এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর জাতীয় সংসদের ভাষণে। তিনি বুঝিয়ে দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি মর্যাদার সম্পর্ক চান। নতজানু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ হতে চান না। তিনি এটাও বুঝালেন অযোগ্য অনুগতের চেয়ে যোগ্য সমালোচক ভালো।

যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশের সঙ্গে কিউবা, ভেনেজুয়েলা কিংবা সিরিয়ার মতো আচরণ করবে? নাকি মালয়েশিয়া, তুরস্কের মতো আচরণ করবে? ৭১-এ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। সে সময় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নে বিভক্ত ছিল বিশ্ব। এখন সেই যুক্তরাষ্ট্রও নেই, বাংলাদেশও সে রকম পরনির্ভর অবস্থানে নেই। বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশ একে অপরের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশ চট করেই মার্কিনবিরোধী অবস্থানে যাবে না। এটা যাওয়াও অনুচিত হবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রকেও বুঝতে হবে ধমক দিয়ে, ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশকে ‘গৃহপালিত’ রাখা এখন আর সম্ভব নয়। সেই বার্তাটি প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দিয়েছেন। বিশ্ব নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ অংশীদার হতে পারে, ক্রীতদাস নয়। কিন্তু সমস্যা হলো প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগ এবং সরকারের কিছু চাটুকার ফিদেল ক্যাস্ত্রোর চেয়েও বড় মার্কিনবিরোধী হয়ে গেছেন। তারা এমন সব বেসামাল কথাবার্তা বলছেন যা দুই দেশের সম্পর্কে বহুমাত্রিক অবনতি ঘটাতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে এ ধরনের উন্মাদনা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন বাংলাদেশকে দরকার, তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশের দরকার যুক্তরাষ্ট্রকে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘে শান্তি মিশনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয়। প্রধানমন্ত্রী মার্কিন চাপের বিপরীতে পাল্টা চাপ দিলেন। বিশ্বে ¯œায়ুযুদ্ধের পর নতুন মেরুকরণ হচ্ছে আবার।  এ অবস্থায় বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে দর কষাকষি করতে পারে। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে। কিন্তু সম্পর্ক শেষ করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতা নয়, মর্যাদার সম্পর্ক দরকার। মালয়েশিয়ার মাহাথির পেরেছিলেন। শেখ হাসিনাও পারবেন নিশ্চয়ই।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭