ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

মণিপুর ও মিজোরামের জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে উঠবে মায়ানমারের 'গৃহযুদ্ধ'


প্রকাশ: 31/05/2023


Thumbnail

ভারতের মণিপুরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে জাতিগত হিংসা চলছে, তা উত্তর-পূর্ব ভারতের অসংখ্য সমস্যার  একটি মাত্র। এই হিংসা নানান সমস্যার একটা ফল— কারণ নয় এমনটাও বলা যেতে পারে এক্ষেত্রে। আগামী দিনে একটা বড় বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। বস্তুত, অঞ্চলটি ইতিমধ্যেই সমস্যায় আক্রান্ত। এই বিপদ হল মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ।

মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের প্রায় ১,৬৫০ কিলোমিটারের সীমান্ত। এই সীমান্তের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার মণিপুরের সঙ্গে। মণিপুর-লাগোয়া মায়ানমারের দু’টি প্রদেশ হল সাগাইং এবং চিন। এই দুই প্রদেশেই গণতন্ত্রকামী বাহিনীর সঙ্গে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী টাটমাডো'র লড়াই চলছে। লড়াই তীব্র হয়েছে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পরে। মাঝে মাঝেই টাটমাডো সাগাইং এবং চিনে বোমা ফেলছে। বছর ছয়েক আগে চিনের দক্ষিণে রাখাইন থেকে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন, তখন ভারত এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে তাঁদের ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এখন বিপদ অন্য ধরনের। চিন প্রদেশ থেকে যাঁরা গত দু’বছর ধরে ঢুকছেন, তাঁদের সঙ্গে জাতিগত (এথনিক) সম্পর্ক রয়েছে মিজোরাম এবং মণিপুরের জনজাতি সমাজের। ফলে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা অতীতে স্পষ্ট জানিয়েছেন, চিন প্রদেশ থেকে শরণার্থী আসতে দিতে হবে। সমস্যা হল, ভারত নানা কারণে আন্তর্জাতিক শরণার্থী চুক্তিতে (১৯৫১) সই করেনি। ফলে, শরণার্থী বলে কিছু ভারতে হয় না— যেটা হয়, তার নাম ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’।

এখন জ্ঞাতিভাইদের ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ বলতে নারাজ মিজোরাম। ফলে মিজোরামে ভারতের নীতি হচ্ছে চুপচাপ থাকা। মিজোরামের মানুষ চিন প্রদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের তাঁদের সামর্থ্য মতো খাবারদাবার, জায়গা দিয়ে বসিয়েছেন। শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও করেছেন। আন্তর্জাতিক শরণার্থী অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা মিজোদের মানবিকতার প্রশংসা করেছেন। শুধু ‘এথনিক’ সম্পর্ক নয়, মিজোরামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ অনেক কম। এর কারণ, মিজোরামের ৯৫% মানুষ জনজাতি সম্প্রদায়ের। প্রায় ৮৮% খ্রিস্টান। বিরোধের ক্ষেত্র সীমিত।

অন্যদিকে, মণিপুরের চিত্র আলাদা। সেখানেও কুকি সমাজের (এখানে বোঝার সুবিধার জন্য জনজাতি সমাজের কুকি-চিন-মিজো-যোমি-হামর জনজাতিদের কুকি বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মণিপুরেও তা-ই করা হয়) মানুষ অরণ্য ও পাহাড় অঞ্চলে শরণার্থীদের বসিয়েছেন। গত বছরের মে মাসে এক প্রতিবেদনে ইম্ফল ফ্রি প্রেস জানিয়েছিল, ৯৬৬টি নতুন বসতি গড়ে উঠেছে মণিপুরের অরণ্য-পাহাড়ে। তারা সরকারি স্বীকৃতির আবেদন জানিয়েছিল।

কিন্তু মণিপুরে জনসংখ্যার ৪০% জনজাতি, যার মধ্যে প্রধান কুকিরা। এই ৪০% মানুষ রাজ্যের ৯০% পাহাড়-অরণ্য অঞ্চলে রয়েছেন বলে দাবি সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের, যাঁরা জনজাতিভুক্ত নন। তাঁদের বক্তব্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাঁরা রয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ অঞ্চলে। এর উপরে মায়ানমার থেকে শরণার্থী প্রবেশের ফলে তাঁদের জায়গা আরও কমবে। ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার আশঙ্কা। সেই কারণেই তাঁরা জনজাতি হিসাবে সংরক্ষণ চেয়েছেন, যার পরিণতি গোষ্ঠী সংঘাত। আগামী দিনে মায়ানমারের ‘যুদ্ধ’ মণিপুর ও মিজোরামের জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে উঠবে বলেই আশঙ্কা।

দ্বিতীয় সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির। দীর্ঘ সময় ধরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবক্তাদের একটা বড় অংশ উত্তর-পূর্ব ভারতে হিন্দুত্বের চর্চা করছেন। শুধু উত্তর-পূর্বেই নয়, গোটা ভারতেই জনজাতি অঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরে হিন্দুত্বের চর্চা হচ্ছে। সম্প্রতি এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। এই গবেষকদের অন্যতম অর্কটং লংকুমের। উত্তর-পূর্ব নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চিত নাম তিনি। উত্তর-পূর্বে হিন্দুত্বের প্রসার নিয়ে তাঁর বই দ্য গ্রেটার ইন্ডিয়া এক্সপেরিমেন্ট: হিন্দুত্ব অ্যান্ড দ্য নর্থ-ইস্ট-এ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) কাজকর্মের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। “আমি যখন পিএইচ ডি-র ফিল্ডওয়ার্ক (২০০৪-০৫) করতে অসমের ডিমা হাসাও জেলার হাফলং এবং লাইসং-এ ছিলাম, তখনই সেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে কঠোর পরিশ্রম করতে দেখেছিলাম। তাঁদের ‘কমিটমেন্ট’ দেখে অবাক হয়েছিলাম। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝেছিলাম যে, তাঁরা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে তাঁদের কাজকর্ম ছড়াতে চান,” অধ্যাপক লংকুমের লিখেছেন তাঁর বইয়ের মুখবন্ধে।

এই ছড়ানোর কাজ আরএসএস উত্তর-পূর্বে খুব ভাল ভাবে করেছে গত বিশ-ত্রিশ বছরে। উত্তর-পূর্বে সাতটির মধ্যে এখন ছ’টি রাজ্যে বিজেপি সরকারে রয়েছে। যেখানে নেই— অর্থাৎ মিজোরামে— সেখানেও ক্ষমতাসীন দল (মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট) পরোক্ষভাবে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স-এ রয়েছে। নানা ভাবে আরএসএস উত্তর-পূর্ব ভারতে ঢুকেছে। এই প্রবেশের একটা প্রধান দিক হল, উত্তর-পূর্ব ভারতের ধর্মীয় বিশ্বাস ‘অ্যানিমিজম’ (নির্জীব বস্তু, উদ্ভিদ, প্রাকৃতিক ঘটনা, সব কিছুর মধ্যে প্রাণের দর্শন) এবং ‘শ্যামিনিজম’-কে (ভিন্ন ধরনের প্রাণের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক) বোঝা। অঞ্চলে পড়ে থেকে হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ দীর্ঘদিন এ কাজ করেছেন, এক ধরনের ‘মিশনারি’ প্রতিজ্ঞা নিয়ে। চিন-ভারত যুদ্ধের পরে, চিনের থেকে অরুণাচল প্রদেশকে সুরক্ষিত করতে কংগ্রেসও সেখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনাকে মদত দিয়েছে।

হিন্দুত্ববাদীদের গবেষণার যে অংশটা এখন সামনে আসছে, সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। অরুণাচল প্রদেশে ‘ডনি-পোলো’ সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদীদের নির্দিষ্ট মতামত রয়েছে। ‘ডনি-পোলো’ হল সূর্য এবং চাঁদ এবং সংশ্লিষ্ট ধর্ম। যেহেতু হিন্দু ধর্মে চন্দ্র-সূর্য দেবতা, ‘ডনি পোলো’তে বিশ্বাসীদের বলা হচ্ছে যে, হিন্দু ধর্মের সঙ্গে তাঁদের ধর্মের ‘ওভারল্যাপ’ রয়েছে। নাগাল্যান্ডে রয়েছে আরও চমকপ্রদ এক আধুনিক ধর্মীয় আন্দোলন, যার নাম হেরাকা। লংকুমেরের এ নিয়েও একটি বই রয়েছে। এর পাশাপাশি আরও একাধিক 'অ্যানিমিস্ট' বা 'শ্যামিনিস্ট' ধর্মীয় আন্দোলন রয়েছে উত্তর-পূর্বে (আমিক মাতাই, রংফ্রা প্রভৃতি), যা প্রধানত খ্রিস্টধর্ম আসার পরে চাপা পড়ে যায়। এখানেই রাজনৈতিক খেলা— হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি যেহেতু উত্তর-পূর্বের অন্যতম প্রধান খ্রিস্ট ধর্ম, তাই খ্রিস্টানদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে লোকজ ধর্মকে বোঝানো হচ্ছে যে, তাঁরা চাপা পড়ে গিয়েছেন খ্রিস্টানদের জন্য।

এর ফলে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে উত্তর-পূর্বে। কারণ উত্তর-পূর্বে তিন রাজ্যে (মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড) খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অরুণাচল প্রদেশে দু’পক্ষই সমান, প্রায় ৩০ শতাংশ। মণিপুরেও তাই, দুই পক্ষই ৪১ শতাংশ। সমসংখ্যক হিন্দু এবং খ্রিস্টান থাকার ফলে মণিপুরে কী হয়েছে, সে সম্পর্কে পাঠক হয়তো অবগত। ‘গুডউইল মিশন’ নামে মণিপুরের গির্জাসমূহের সংগঠন জানায়, সাম্প্রতিক সংঘাতের দুই সপ্তাহে ২৯৩টি গির্জা বা গির্জা সংলগ্ন অফিস আংশিক বা পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এখানে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, যাঁরা লোকজ ধর্মের মধ্যে রয়েছেন, তাঁরা আবার সংগঠিত ধর্মের মধ্যেও থাকতে পারেন। তাছাড়া, জনজাতি সমাজের বড় অংশ এখনও খ্রিস্টান। ফলে সংঘাত আরও জোরালো হতে পারে। খ্রিস্টান সম্প্রদায় যে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন, তা সম্প্রতি বুঝতে পারলাম শিলঙে। শিলঙের এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মন্তব্য করলেন, “এর পরের টার্গেট তবে আমরাই।” তার এই মন্তব্যের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং আতঙ্ক স্পষ্ট। নিরাপত্তাহীনতা যে কোনও সমাজকেই অস্থির করে। আর সেটাই সত্যি। চূড়ান্ত অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটছে উত্তর-পূর্বের একাংশের।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭