ইনসাইড থট

কতটুকু নির্লজ্জ ও নির্মম হলে আমরা খুনিদের সঙ্গে সংলাপের কথা বলি


প্রকাশ: 15/07/2023


Thumbnail

১৬ জুলাই ২০০৭।দিনটি স্মরণীয় এজন্য যে গণতন্ত্রে নেত্রী তৎকালীন সংসদের  বিরোধীদলীয় নেতা আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে  গ্রেফতার করে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় শুরু হয় রাজনৈতিক নির্বাসন। আজকের লেখাটি ২০০১-২০০৯ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করবো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু মাঝ পথে আমার লেখায় বাধা পড়ে গেলো "সংলাপ পরামর্শ বিষয়টি "  যা আমাদের উন্নয়নের বন্ধুদের মুখে শুনতে হলো। 

উন্নয়ন গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের বন্ধুদের পরামর্শ আমাকে আজকের শিরোনাম নির্ধারণে  প্রভাবিত করেছে সেটা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই। এর সঙ্গে ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের একটি উক্তি আমাকে আরও উদ্দীপ্ত করলো এই কথা বলতে - উনি কি কোনো একটি জনসভাতে গিয়েছিলেন যে, বলে ফেললেন বিএনপির জনসভাতে লোক বেশি হয়েছিল।  আমি বিএনপির জনসভা দেখিনি, তবে আওয়ামী লীগের শান্তি সভা দেখেছি।  সুতরাং , তুলনাটি করতে আমার সামান্য অধিকার আছে বোধ হয়। আমি আওয়ামী লীগের শান্তিসভাকে জনসুমুদ্র হিসেবে তুলনা করতে দ্বিধান্বিত নই।   

যাই হোক , ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই দিনটিতে প্রতিদিনের মতো উদ্বেগের সঙ্গে কম্পিউটারের সামনে বসেছি  পত্রিকা পড়বার জন্য। আমি তখন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে পিএইচডি করছি। মেলবোর্ন ও ঢাকার সময় পার্থক্য ঘন্টা। অনেক দিন ধরেই আভাস পাচ্ছি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হতে পারে।কিছু দুর্নীতির মামলা সাজানো হয়েছে।সাবেক শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমেদ স্যার এর সঙ্গে কথা বলে এরকম তথ্যের সত্যতা জানবার চেষ্টা করতাম।সেনা শাসিত সরকার আওয়ামী লীগকে টার্গেট করবে ধারণার বাইরে ছিল।এপ্রিল মাসের শেষ দিকে ঢাকা থেকে এক অতিথি এলেন।উনার কাছে জানলাম বিএনপি নেতাদের ধরা শেষ, এবার আওয়ামী লীগ ধরা হবে।  কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। 

সন্দেহ অবশ্য ছিল যখন দুই নেত্রীর এসএসএফ নিরাপত্তা তুলে নেয়া হলো।তবুও বিশ্বাস ছিল নেত্রীর কিছু হবে না।কিন্তু সব  বিশ্বাস ভেঙে দিয়ে সুধা সদনে পুলিশ গিয়ে নেত্রীকে গ্রেফতার করলো! কোনো কিছু মেলাতে পারছিলাম না। বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত নৌবাহিনীর ফ্রিগেডের নাম পরিবর্তন করা হলো।বুঝলাম - মাইনাস টু ফর্মূলা বাস্তবায়ন চলছে। আর বসে থাকার সময় নয়।দ্রুত কান্না বুকে চাপা দিলাম, ভাবতে শুরু করলাম কিভাবে এই নিষ্ঠুরতাকে জবাব দেয়া যায়। 

২০০১ সালে আমি তখন সিডনিতে। ২০০০ সালে বন্ধু চুন্নু ( প্রায়ত সাধারণ সম্পাদক , বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অস্ট্রেলিয়া ) ১৫ অগাস্ট উপলক্ষে সোনার বাংলা পত্রিকা বের করবার সিদ্ধান্ত নিলো।  আমার একটা দুর্বলতা ছিল সাংবাদিকতার উপর।আমি বন্ধুর পত্রিকার অবৈতনিক সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব নিলাম।আমাদের এই টীমে মরহুম . আব্দুর রাজ্জাক, সভাপতি বঙ্গবন্ধু পরিষদ অস্ট্রেলিয়া ( শহীদ . জোহা জামাতা ) এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য জনাব শেখ শামীমুল হক  সাহেব আমাদের উপদেষ্টা/সম্পাদকমণ্ডলীতে যোগ দিলেন।  পাতার পত্রিকা বাড়তে বাড়তে ৩২ পাতায় গিয়ে উপনীত হলো বছর না ঘুরতেই ।  শুধু তাই নয় ২০০৪ সালে অনলাইনে "সোনার বাংলা " যুক্ত হল। মাননীয় সাংসদ জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর আমাদেরকে নেত্রীর একটি বাণী সংগ্রহে সহযোগিতা করলেন।      

দেশে আমার স্ত্রী।তাকেও এই পথে নামালাম।ঢাকা থেকে আমার বোন (করোনা যাকে আমাদের মাঝ থেকে না ফেরার দেশে নিয়ে গেছে)  এবং কখনো কখনো আমার দুই মুক্তিযোদ্ধা ভগ্নিপতি সেই পথে হাঁটেন।পত্রিকা পাঠান DHL ।সেখান থেকে কেটে কেটে সংবাদ জোড়া দিয়ে পত্রিকার ডামি বানিয়ে তবে ছাপা।তার সঙ্গে আমার টাইপ করা কিছু নতুন নিউজ।এরই মধ্যে বৌ এলেন আমাকে দেখতে।তিনি যখন দেখলেন আমি বিনা পয়সায় পত্রিকার কাজ করি রাত জেগে তাতে তিনি সহযোগিতা শুরু করলেন তার আগ্রহ আমাকে অনুপ্রাণিত করলো।

আসলে নামমাত্র বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পড়তে গিয়েছি।কাজ করে টিউশন ফি জোগাড় করবার কথা।সেটা না করে পত্রিকা বের করি! কিন্তু কাজ নেই।দুটি কারণ! অলিম্পিক শেষ এবং নিউজিলান্ড থেকে ৩০ হাজার নাগরিকের প্রবেশ।ফলে বেড়ে যায় বাসাভাড়া-বাড়ির দাম।বিদেশে নাকি কাজ আর কাজ।কিন্তু কাজ নেই আমাদের।এরই মাঝে ৯/১১।মোহাম্মদ -আহমেদ নামের সঙ্গে থাকলে কাজ নেই।আঞ্চলিকতা-ধর্মীয় বলয় অতিক্রম করে আমরা চেষ্টা করেছি বিশ্বমানব হতে।কিন্তু ৯/১১ আমাদের আঘাত করে প্ৰচণ্ড ভাবে।তখন হতভাগা মনে হয়।আমার মাঝে সাদা -কালো , মুসলিম -অমুসলিম , দৈত্যরা লড়াই করতে থাকে। 

/১১ বাংলার রাজনীতি বদলে দেয়।  শত ভালো কাজ করবার পরেও ধর্মীয় উন্মাদনা জয়ী হয়।  ফিরে আসে জামাত বিএনপি।  জামাত -বিএনপির ঐক্য গড়াতে নাকি সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী।  এবং সিডনিতে শ্রুতি আছে সেই ঐক্য নাকি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে যে পাড়ায় আমরা থাকতাম সেখানে হয়েছিল।

২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে ষড়যন্ত্রের কারণে পরাজিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সহ আওয়ামী পরিবারগুলোতে নেমে আসে অমানবিক নির্যাতনের ঢল।  এমনভাবে তারা নিপীড়ন শুরু করেছিল যে আওয়ামী লীগ দাঁড়াতেই পারছিলো না।  খালেদা জিয়ার সরকার শিক্ষা গ্রহণে বিদেশে থাকা সকল সরকারি কর্মকর্তা /বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে দেশে ফিরে আসতে বলে।  আমি ও আমার পরিবার চিন্তায় পড়ে  যায় আমাদের কি তবে আর উচ্চ শিক্ষা নেয়া হবে না ? সেদিন অনেকেই দেশে ফিরে আসেন তাদের ডিগ্রী শেষ না করে।  এমন একটি অবস্থায় আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি দেশে ফিরবোনা তাতে আমার চাকরি না থাকুক।  আমাদের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য শামীম ভায়ের স্ত্রী মিসেস চন্দনা যাকে  আমার চন্দনা ভাবি বলে ডাকি তিনি নাকি ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পর অঝোরে কেঁদেছিলেন। 

আমার তখন মনে পড়ে গেলো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের কথা।  আমাদের আশংকা  সত্যি হয়ে গেলো।  খালেদা জিয়া সরকার খুনিদের বিচার বন্ধ করে দিলেন।  আর এভাবে বিএনপি জামাত প্রমাণ করলো তারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দোসর। আমি প্ৰতিজ্ঞা করলাম আমরা আর কাঁদবো না এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা খালেদা জিয়া সরকার হটিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার না করতে পারবো ততক্ষন আমাদের আন্দোলন চলবে।  আর এভাবে "সোনার বাংলা " প্রকাশ হয়ে গেলো আমাদের প্রথম কাজ- প্রবাসে মুক্তির বারতা নিয়ে সোনার বাংলা একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় রুপান্তিরিত হলো।  অস্ট্রেলিয়া ছাড়া কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে কপি পাঠানো হতো। ২০০১ সালে যেমন আমি সোনার বাংলা পত্রিকার মাধ্যমে গণতন্ত্র মুক্তির শপথ নিয়েছিলাম তেমনি,  ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সকাল বেলাতেই  আমি সিদ্ধান্ত নয় ফেলি " নেত্রীর মুক্তি আদায় আমার একমাত্র কাজ।"

সিডনির "সোনার বাংলা"র গল্পটা এবং নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে আজ আর লেখা  হলো না।  কারণ আজ সংলাপের কথা আবার এসেছে সেই দলের সঙ্গে-যারা ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা  দখল করেছিল। ১৯৭৫ সালের নির্মম হত্যাকাণ্ডের  পরে থামেনি বরং চার নেতা ও হাজার হাজার সৈনিক - অফিসারকে জীবন দিয়ে হয়েছে তাদের হাতে। ২০১৪-২০১৫তে পেট্রল বোমা মেরে নিরীহ জনগণকে হত্যা করেছিল। 

যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ কিভাবে বাংলার জনগণ গ্রহণ করবে সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। কি নিষ্ঠুর রাজনৈতিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে আমরা অতিক্রম করছি! ২০০১  সালের নির্বাচনের আগে ওই দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছিলেন। নানা উপদেশ দিয়েছিলেন। আমরা গরীব, সুতরাং, আমাদের উপদেষ্টাদের কথা শুনতে হয়। পর্দার অন্তরালের আন্তর্জাতিক রাজনীতি আমি মনে করতাম প্রপাগান্ডা - ভালো কাজকে সন্দেহের চোখে দেখা।  কিন্তু সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করে দিয়েছেন ওই আমেরিকান গবেষক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক যার সঙ্গে খুব কাছ থেকে জানবার সুযোগ হয়েছিল।

যারা ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিলো।  বিদেশ থেকে লেখা পড়া বন্ধ করে দেশে ফিরতে নির্দেশ জারি করেছিল , এবং গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিলো,  তারা সংখ্যা লঘুদের উপর সহ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী পরিবারগুলোর উপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ছিল। আজ আবার তাদের সঙ্গে সংলাপ?  কিন্তু কেন ? এজন্য আসলে কারা দায়ী ? অর্থ পাচারকারী, মানবাধিকার লঙ্ঘন কারী, শ্রম আইন লঙ্ঘনকারী কে ? তাদের অনুসন্ধান না করে কেন রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসে তাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে ? নির্বাচনের আগে এই সব অন্যায়ের বিষয়ের ফয়সালা না করে যদি আমরা অগ্রসর হই তবে সংসদ যে তাদের দখলে যেতে পারে সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি ?

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্ব পরিবারে হত্যা করে যারা ক্ষমতা বসেছিল আজ তাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে জাতি পিতার কন্যাকে!  কি নির্মম রাজনীতি নিজের পিতার হত্যাকারীদের মুক্ত করে দেয়া দলটির সঙ্গে সংলাপ ! এতো এক কঠিন শাস্তি ছাড়া আর কিছু নয় ! ! এই রাজনীতির অবসান কবে হবে জানিনা, তবে যে অশনি সংকেত তা থেকে যেন বাংলাদেশ উত্তরণ লাভ করতে পারে। 

কি নিষ্ঠুরতা - আমার আজ বারবার মনে পড়ে ৫৭ জন সামরিক অফিসারের কথা।  কি নিষ্ঠুর ভাবে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবার জন্য। এবং সেদিনও সেই খুনিদের সঙ্গে বসতে হয়েছিল আটক সৈনিক , অফিসার ও তাদের পরিবার পরিজনদের মুক্তির জন্য।   

আমার  এ মুহুর্তে মনে পড়ছে কথা, সুর,শিল্পীঃ হায়দার হোসেন এর ওই গানটি "কতটুকু অশ্রু গড়ালে হৃদয় জলে সিক্ত,কত প্রদীপ শিখা জ্বালালেই জীবন আলোয় উদ্দীপ্ত,কত ব্যথা বুকে চাপালেই তাকে বলি আমি ধৈর্য,নির্মমতা কতদূর হলে জাতি হবে নির্লজ্জ, আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া,করিতে পারিনি চিৎকার, আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া,করিতে পারিনি চিৎকার, বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার।" কতটুকু নির্লজ্জ ও নির্মম হলে আমরা খুনিদের সঙ্গে সংলাপের কথা বলি। এই নিষ্ঠুরতা শেষ কবে ? কবে আমরা মুক্ত হবো ?



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭