প্রকাশ: 13/09/2023
উত্তর কোরিয়ার নেতা
কিম জং উন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের জন্য রাশিয়া সফরে গেছেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই কিমের এ রাশিয়া যাত্রার কথা শোনা যাচ্ছিল। অবশেষে রাশিয়ায় পৌঁছালেন
তিনি। রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা ইন্টারফ্যাক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কিম জং
উন রাশিয়ার পূর্বাঞ্চল সফর করবেন। তবে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে কিমের মূল লক্ষ্য মূলত রাশিয়ায়
অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করা। জানা গেছে, রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র
কিনবে আর এ কারণেই পুতিনের সাথে বৈঠক করতে কিমের এই রাশিয়া সফর। কিন্তু পরাশক্তি রাশিয়ার
মত পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডারে পরিপূর্ণ দেশ কেন অস্ত্রের জন্য উত্তর কোরিয়ার দ্বারস্থ
হবে? নাকি এর পেছনে আছে আরও বৃহৎ স্বার্থ, যাতে লাভ হতে পারে উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়া
দু’দেশেরই?
অতি নিভৃতিকামী উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করলে এর উত্তর পাওয়া খুব কঠিন। কেননা, দেশটি কখনো তাদের বাণিজ্যের পরিসংখ্যান জানায় না। তেমনি জানায় না এর সম্পদের পরিমাণও।
কোভিড মহামারির কারণে
কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় গত তিন বছর ধরে সীমান্ত বন্ধ রেখেছিল উত্তর কোরিয়া। করোনাভাইরাসের
বিস্তার ঠেকাতে এমনকী তাদের বাণিজ্যও স্থগিত করা হয়েছিল। মানবিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর
মতে এর ফলেই দেশটিতে খাদ্য ও ওষুধের চরম ঘাটতি দেখা দেয়। দু বছর আগে মি. কিম দেশটিতে
“খাদ্য সংকটের”কথাও স্বীকার করেছেন যা বেশ বিরল।
সাথে সাথে দেশটির অর্থনীতিও পড়ে চরম ধ্বংসের মুখে, যে সংকট অবস্থা এখনও কাটিয়ে উঠতে
পারেনি উত্তর কোরিয়া। আর এই সংকট অবস্থা কাটাতেই মি. কিমের
এই রাশিয়া সফর বলে অনেকে মনে করছেন।
মূলত, রাশিয়ার কাছে
অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া দেশটির অর্থনৈতিক ভগ্নদশা কিছুটা হলেও কাটাতে
চাইছে। অস্ত্রের দিক দিয়ে বেশ ভালো ক্ষমতাধর দেশটির এদিক দিয়ে কোনো কমতি নেই, যেরকম
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আছে। তাই, রাশিয়ার সাথে অস্ত্রের এ বাণিজ্য উত্তর কোরিয়ার জন্য
ব্যাপক লাভজনক হবে।
অপরদিকে, রাশিয়া
চাইছে বিশ্ব অর্থিনীতিতে ডলারের প্রভাব বিস্তার কমাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই
বিশ্বের রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে মার্কিন ডলারের একাধিপত্য বজায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুসারে (আইএমএফ) বর্তমানে বিশ্বের
৬০ শতাংশ রিজার্ভই মার্কিন ডলারে। বিশ্ব বাণিজ্যেও মার্কিন ডলারই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত
হয়। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেসব নিষেধাজ্ঞা
দিয়েছে, তাতে বিশ্বের অনেক দেশই ডলারের রিজার্ভ ও লেনদেন নিয়ে বর্তমানে শঙ্কিত হয়ে
পড়েছে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো
এখনই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্য মুদ্রা ব্যবহারের তোড়জোড় শুরু
করেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য মুদ্রা ব্যবহারও শুরু করে দিয়েছে।
ডলারের আধিপত্য নিয়ে
বিশ্বের দেশগুলোর এ অস্বস্তি বহু বছর ধরেই চলমান। মার্কিন মিত্র দেশগুলোও এই বিষয়টি
নিয়ে নিজেদের অস্বস্তি প্রকাশ করেছে। কিন্তু বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে
এটি আরও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর করার
পরপরই ইউরোপ এবং আমেরিকা মিলে রাশিয়ার উপর নানা ধরণের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা
দিয়েছিল। কিন্তু পুতিনের চমৎকার কুটনীতির প্রয়োগ এসকল নিষেধাজ্ঞাকে ম্লাণ করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং
ইউরোপের প্রবল নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে রাশিয়া তাদের প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়া মূদ্রা রুবলকে
তাদের জীবাশ্ম জ্বালানী অর্থাৎ গ্যাস ও তেল রপ্তানির মাধ্যমে শক্তিশালী
করে তোলে। রাশিয়া বলে, তাদের কাছ থেকে যারা তেল গ্যাস ক্রয় করবে, সেটির মূল্য
পরিশোধ করতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মাধ্যমে। এর ফলে ইউরোকে রুবলে পরিবর্তন করা
হয়।
এছাড়াও যারা রুবল
বিক্রি করে ডলার বা ইউরো কিনবেন না, অর্থাৎ রুবল সঞ্চয় করবেন, তাদের জন্য প্রণোদনাও
ঘোষণা করে রাশিয়া। রাশিয়ার অনেক কোম্পানি বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে ব্যবসা করে ডলার,
ইউরো এবং ইয়েন আয় করে। কিন্তু এখন রাশিয়ার কোম্পানিগুলো বিদেশে ব্যবসা করে যে আয়
করবে তার ৮০ শতাংশ রুবলে কনভার্ট করে নিতে হচ্ছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়ার
মুদ্রা রুবলের একটি বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার কোন নাগরিক যাতে দেশের বাইরে
অর্থ নিতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিয়েছে পুতিন সরকার। কারণ আগে দেশের বাইরে অর্থ
পাঠাতে হলে সেটি ডলার বা ইউরোতে পাঠতে হতো। যেহেতু সেটি বন্ধ করা হয়েছে, সেজন্য ডলার
বা ইউরোর চাহিদা কমেছে। ফলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা দেশের ভেতরে রয়ে গেছে। আর এটি রুবলের
দরপতন ঠেকাতে সাহায্য করেছে।
রাশিয়ার এ অবস্থা
দেখে আন্তর্জাতিক বিশ্বের অন্য দেশগুলোও ডলারের বিকল্প খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠছে। কারণ
মার্কিন মুদ্রানীতি বাকি বিশ্বের উপর খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করে। বিশ্বের বিভিন্ন
দেশ এই প্রভাবকে অস্বস্তিকর বলে মনে করে এবং তারা মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য
মুদ্রার ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ফ্রান্স ও ভারতও রয়েছে।
বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার
সর্বোচ্চ নেতা কিমের সাথে অস্ত্র কেনা বিষয়ক বৈঠক করছেন পুতিন। মূলত, রাশিয়ান মূদ্রা
রুবলের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনে বিশ্ব বাণিজ্যে রুবলের ব্যবহারের
বিস্তার ঘটানোই পুতিনের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ। কিম এই
অস্ত্র বেচা অর্থ বা রুবল নিয়ে চীনের সাথে বাণিজ্য করলে রুবলের ব্যবহার বা প্রসার আরও
বাড়বে।
মূলত প্রত্যেক দেশ
তার নিজস্ব মূদ্রা ব্যবহার করে ব্যবসা বাণিজ্য করলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলার বা ইউরোর
চাহিদা কমবে এটিই পুতিনের আসল উদ্দেশ্য।
এদিকে মি. কিমের এই রাশিয়া সফর নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র
ম্যাথিউ মিলার পুতিনকে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, “সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে
বিচ্ছিন্ন ও অস্পৃশ্য কিমের কাছে হাত পেতে পুতিন এটিই দেখাচ্ছেন যে, ইউক্রেনে পূর্ণ
মাত্রায় আগ্রাসন চালানো তার (পুতিনের) অবশ্যই ‘কৌশলগত ব্যর্থতা’ ছিল।“
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট
ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে মিলারের এসব কথাবার্তা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো আর কিছু নয় বলেই
মনে করেন বিশ্লেষকগণ। কারণ পুতিনের এসব কুটনৈতিক চাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অজানা
কিছু নয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে রুবলের ব্যবহারের প্রসার ঘটানো বা ডলারের প্রভাব বিস্তার
রোধ করতে যে পুতিন বর্তমানে বদ্ধপরিকর। আর এ কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধকে পুঁজি করে রাশিয়ার
বিরুদ্ধে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে দেশটি।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭