ইনসাইড আর্টিকেল

জিয়ার ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা (পর্ব-৪)


প্রকাশ: 10/11/2023


Thumbnail

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়া। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় জিয়া ছিলেন একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার এবং ঠান্ডা মাথার খুনী। তার অপকর্মের কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় ‘মহিউদ্দিন আহমদের’ লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শিরোনামে গ্রন্তটি থেকে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির কিছু অংশ ধারাবাহিক প্রকাশ করা হলো:

তাহেরের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে এবং ১২ নভেম্বর থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ নভেম্বর 'দেশবাসীর প্রতি মেজর জলিল ও আ স ম রবের আহ্বান' শিরোনামে জাসদ একটি প্রচারপত্র বিলি করে। বক্তব্যে বলা হয়:

এ মাসের (নভেম্বর) প্রথম দিকে, বিশেষ করে ৩ তারিখে, বিশ্বাসঘাতক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার প্ররোচনায় তারা দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে চিরতরে বিলুপ্ত করার চরম আঘাত হানার প্রস্তুতি নিয়েছিল। এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পূর্বমুহূর্তেই বাংলার বিপ্লবী সিপাহিরা, বিপ্লবী গণবাহিনী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবীসহ সব দেশপ্রেমিক নাগরিকের সমর্থন ও সক্রিয় সহায়তায় আঘাত হানল শত্রুর দূর্গে। মুক্ত করল মৃত্যুর কবল থেকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে, মুক্ত করল আমাদেরকে । ... কিন্তু ভুললে চলবে না যে, আমাদের এ বিজয় অত্যন্ত সাময়িক।... আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেশীয় শোষক ও সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের দালালেরা তাদের প্রভুদের ইঙ্গিতে নতুন পোশাক পরে আবার জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এদের সমূলে উৎখাত না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে ।....

জলিল ও রব বাকশালকে বাদ দিয়ে সকল প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার' গঠন এবং অবিলম্বে সামরিক আইন বাতিলের দাবি জানান। অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দূতাবাস সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া, জাতিসংঘের কাছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নালিশ জানানো, সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি ও সকল প্রকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি।

জাসদের নেতাদের একটা গোপন সভা ১৫ নভেম্বর রায়েরবাজারে একটা কাঠের আড়তে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তাঁরা বলেন, জিয়া বিট্রে করেছে। জলিল বলেন, ভয়ের কোনো কারণ নাই। বঙ্গভবনের সামনে যেসব ট্যাংক আছে, ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে গেছে।

নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে শাজাহান সিরাজের বাড়িতে জলিলের অনুরোধে তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক আমানউল্লাহ দেখা করতে যান। আমানউল্লাহর বর্ণনামতে:

জলিলকে খুব অস্থির মনে হচ্ছিল। জিয়া সম্পর্কে ক্ষোভের সঙ্গে বলল, ‘দ্যাট বা বাস্টার্ড হ্যাজ বিট্রেইড (বেজন্মাটা বেইমানি করেছে) ।

ইতিমধ্যে সৈনিকেরা বেশির ভাগই সেনানিবাসে ফিরে গেছেন। তাহের বিভিন্ন সেনানিবাসে তাঁর অনুগত লোকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। ২৩ নভেম্বর এলিফ্যান্ট রোডে শাজাহান সিরাজের বাড়ি থেকে রবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। একই দিন জলিল, আবু ইউসুফ ও ইনু গ্রেপ্তার হন। ২৪ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কয়েকজনকে নিয়ে তাহের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষক ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার মোস্তফা সরোয়ার বাদলের বাসায় সভা করার সময় নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের ঘিরে ফেলে। তাহের কয়েকজন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন। মোস্তফা সরোয়ার বাদলও গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাহেরের উপলব্ধি হয়, তিনি ৭ নভেম্বর যাদের ক্ষমতায় এনেছেন, তাঁরা তাঁর সঙ্গে বেইমানি করেছে।

ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন একটি পরিকল্পনা আঁটেন, যা এ দেশে এর আগে কখনো ঘটেনি। ছয়জনের একটা দল তৈরি হয়সুইসাইড স্কোয়াড। দলের সদস্যরা হলেন সাখাওয়াত হোসেন বাহার, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু, মাসুদুর রহমান, হারুনুর রশীদ ও সৈয়দ বাহারুল হাসান সবুজ।

প্রথমে মতিঝিলে আদমজী কোর্টে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস 'রেকি' করা হয়। পরে সিদ্ধান্ত বদল করে ধানমণ্ডির ২ নম্বর সড়কে ভারতীয় হাইকমিশন 'রেকি' করা হয়। ঠিক হয়, গণবাহিনীর একটি দল হাইকমিশনে গিয়ে হাইকমিশনারকে জিম্মি করে তাহেরের মুক্তি এবং আরও কিছু দাবিদাওয়া উপস্থাপন করবে। তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছে, হাইকমিশনার সমর সেন সকাল সাড়ে নয়টায় অফিসে আসেন।

২৬ নভেম্বর সময়মতো ছয়জন অকুস্থলে হাজির হলেন। দলের নেতা বাহার। তিনজন অবস্থান নিলেন রাস্তার দক্ষিণ পাশে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রর চত্বরে। তিনজন অপেক্ষা করতে থাকলেন ভারতীয় ভিসা অফিসের সামনে। সবাই সশস্ত্র। এমন সময় হাইকমিশনার এসে গাড়ি থেকে নামলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাহারদের দলের দুজন তার দুই হাত ধরে বললেন, 'আপনি এখন আমাদের হাতে জিম্মি। আপনার ঘরে চলুন। আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে।' সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দোতলায় যাওয়ার পথে ওপরে অপেক্ষমাণ নিরাপত্তারক্ষীরা ব্রাশফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন নিহত হন। বেলাল ও সবুজ আহত হন। হাইকমিশনারের কাঁধে গুলি লেগেছিল। চোখের পলকে ঘটনা ঘটে গেল। রেকি করার সময় কজন নিরাপত্তারক্ষী ঠিক কোন কোন জায়গায় ডিউটি করেন, তা তাঁরা জেনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, একদল ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষী দোতলায় পাহারায় থাকেন ।

তিতুমীর কলেজ ছাত্রসংসদের সহসভাপতি কামালউদ্দিন আহমেদ এই অভিযানে অংশগ্রহণকারী ছয়জনের জন্য মগবাজারের নয়াটোলায় একটা শেল্টারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ছাত্রসংসদের সহসম্পাদক ফোরকান শাহর বাড়িটি শেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখান থেকেই এই স্কোয়াড়ের ছয়জন ২৬ নভেম্বর সকালে রওনা হয়েছিলেন। ঘটনার পর ফোরকানের বাবা ইসরাফিল সাহেবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

সংবাদ পেয়ে সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর এলেন। তিনি আহত বেলাল ও সবুজকে তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে গেলেন । ৪১

মাসুদ ও হারুনের মৃতদেহ পুলিশের জিম্মায় দেওয়া হয়। ভারতীয় দূতাবাসের পেছনে ৩ নম্বর সড়কে থানার পোর্টিকোর নিচে একটা ভ্যানে মৃতদেহগুলো রাখা ছিল। কামাল ও তাঁর বন্ধু ওয়াহিদুল ইসলাম ওটুল থানায় যান মৃতদেহগুলো দেখতে। শুটুলের বাবা শফিকুল ইসলাম ছিলেন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। তিনি তাঁদের দ্রুত সরে যেতে বলেন। 

ভারতীয় হাইকমিশনে এই অভিযানের ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এক সুরে এর সমালোচনা করতে শুরু করলেন, ডান-বাম কোনো ভেদাভেদ থাকল না। তাঁরা কয়েকজন মিলে একটা যৌথ বিবৃত্তি দিলেন। বিবৃতিটা ছিল এরকম :

আমরা একদল লোকের এহেন কাপুরুষোচিত ও জঘন্য অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা করিতেছি। ঘটনাটি দৃশ্যতই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ইহা করা হইয়াছে। ভারতীয় হাইকমিশনারের উপর পরিচালিত আক্রমণ প্রতিহত করিবার ক্ষেত্রে কর্তব্যরত বাংলাদেশ পুলিশ ও রক্ষীদের উপযুক্ত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আমরা প্রশংসা করি।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন আতাউর রহমান খান, তোফাজ্জল আলী, আলীম আল রাজী, মশিয়ুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, আসাদুজ্জামান খান, কাজী জাফর আহমদ, অলি আহাদ ও রাশেদ খান মেনন।

 

(সূত্র: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি ।। পৃষ্টা: ২০৬-২১০)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭