ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

রাখাইন রাজ্য কি স্বাধীন হতে যাচ্ছে?


প্রকাশ: 21/02/2024


Thumbnail

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য জান্তা সরকারের হাতছাড়া হতে চলেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহী আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইনের মিনবিয়া এবং কিউকতাও শহরসহ এক সময়ের আরাকান রাজ্যের রাজধানী ম্রাউক-উ দখল করে। গত নভেম্বরে আরাকান আর্মি ও দেশটির সামরিক জান্তার মধ্যে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজ্যের ৬টি শহর দখল করেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ চিন রাজ্যের দুটি শহরও দখল করেছে তারা।

এসব অভিযানে কমপক্ষে ৭টি নৌবাহিনীর জাহাজ ও ১টি হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে আরাকান আর্মির যোদ্ধারা। এই চলমান বিজয়গুলো একটি স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র গঠনের রাখাইন জাতীয়তাবাদের স্বপ্নকে আরো শক্তিশালী করেছে।

৮ ফেব্রুয়ারির বিজয়কে নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতীক হিসেবে দেখছে রাখাইন জাতীয়তাবাদীরা। ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। এই সালে বার্মিজ মান্দালয় রাজ্যের হাতে স্বাধীন আরাকানের পতন ঘটে। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে বার্মিজ শাসকদের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার বিদ্রোহ করে স্থানীয় বাসিন্দারা। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে যখন মিয়ানমার স্বাধীনতা পায় তখন কেন্দ্রীয় সরকারকে যারা চ্যালেঞ্জ করেছিল তার মধ্যে প্রথম দিকেই ছিল রাখাইন। সম্প্রতি জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মি যে বিজয়গুলো অর্জন করেছে তাকে বিপ্লব হিসেবে দেখছে স্থানীয়রা।

মেজর জেনারেল তোয়ান মারত এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিয়ো টোয়ানের নেতৃত্বে আরাকান আর্মি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালে। তাদের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব রাজ্যের জনগণের জন্য একটি নতুন আশা জাগিয়েছিল। এর আগে আরাকান লিবারেশন আর্মি/আরাকান লিবারেশন পার্টি একটি স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করলেও সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১৪ সালে আরাকান আর্মি (এএ) ‘আরাকান ড্রিম ২০২০’ নামে একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ প্রকাশ করে। এই রোডম্যাপ প্রকাশের পর থেকে আরাকান আর্মির জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে।

‘আরাকান ড্রিম ২০২০’ পরিকল্পনাটির মূল বিষয় ছিল: অস্ত্রের জোরে রাখাইন রাজ্যে একটি মুক্ত ঘাঁটি এলাকা তৈরি করা এবং একটি নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপন করা। দেশের ভেতরে হোক বা বাইরে রাখাইনের প্রতিটি মানুষকে এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এই আন্দোলন ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে রাজ্যে দুই বছরের নিবিড় লড়াইয়ে প্ররোচনা দেয়। ব্যাপক বেসামরিক বাস্তুচ্যুত হয় এবং শত শত রাখাইন মানুষকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেড় বছরেরও বেশি সময় এই অঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবস্থা বন্ধ করে রেখেছিল কেন্দ্রীয় সরকার।

আরাকান আর্মি ২০২০ সালের শেষের দিকে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে অন্য গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। এই চুক্তির ফলে রাখাইনের জনগণের প্রতি আরাকান আর্মির নেতৃত্ব আরও বেশি বৈধতা পায়। এক দশকের মধ্যে গোষ্ঠীটি মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী জাতিগত সেনাবাহিনী হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ‘ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান’-ও সফলভাবে তাদের প্রচার চালিয়ে যায়। ফলে অন্যান্য বিদ্যমান জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের মতো নতুন সদস্য নিয়োগে আরাকান আর্মি কোনো ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি। রাখাইনের জনগণের যে সমর্থন তারা অর্জন করে তা এই অঞ্চলে আরাকান আর্মির নেতৃত্বকে বৈধ করে তোলে।

রাখাইনে চলমান যুদ্ধে জান্তা সরকারের অবস্থান অনেকটা নড়বড়ে হয়েছে তা স্পষ্ট। চলতি মাসেই মংডু শহরে লড়াই চলাকালে প্রায় ৪০০ জান্তা সরকারের সীমান্তরক্ষী প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। এক মাস আগে আরও কয়েকশ সৈন্য ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। রাখাইন ছাড়াও অন্য রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহীদের সামনে বিভিন্ন জায়গায় পিছু হটছে জান্তা বাহিনী। জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটা শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।
রাখাইনে আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান সাফল্য সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট এবং টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সত্য ঘটনা নির্ণয় করা কঠিন। তবে ম্রাউক-উ শহর দখলের দিনে বিশ্বজুড়ে রাখাইন নেটিজেনরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। বেশিরভাগই আরাকান আর্মির এই বিজয়কে উদযাপন করেছেন এবং এটিকে তাদের আরাকান স্বায়ত্তশাসনের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের সূচনা হিসেবে মত প্রকাশ করেছেন।

তবে সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। রাখাইনে দীর্ঘকাল ধরে জাতিগত উত্তেজনা চলে আসছে। রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুরাও বার্মিজ শাসনের অধীনে কয়েক দশক ধরে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালে উত্তর রাখাইনের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কুখ্যাত গণহত্যামূলক ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ পরিচালনা করে। বর্তমান সহিংসতার মধ্যে এই ক্ষতগুলো পুনরায় সামনে চলে আসতে পারে। ইতিমধ্যেই একটি ভয়াবহ মানবিক সংকটে পুড়ছে রাখাইন। বহু জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যাকে একটি একক সমঝোতায় নিয়ে আসা একদমই সহজ হবে না। সবমিলে উদ্বেগ থেকেই যায়।

তবে উদ্বেগ আশঙ্কার মধ্যে আশার আলোও রয়েছে। ক্রমবর্ধমান সামরিক অগ্রগতি রাখাইন এবং এর বাসিন্দাদের জন্য একটি ভিন্ন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তুলে ধরছে। এই ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। কী ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠার চিন্তা করছে আরাকান আর্মি? রোহিঙ্গাসহ রাখাইনের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে তারা?

আমি বিশ্বাস করি, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার সময় এসছে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে আরাকান আর্মির একজন নেতা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, গোষ্ঠীটি রাখাইনের জনগণের জন্য একটি সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছে। তবে সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোন মডেলের কথা তিনি বলতে চাইছেন তা পরিষ্কার করেননি তিনি। দলটি রাজনৈতিকভাবে একদলীয় ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে তা স্পষ্ট। একটি নির্বাচনের প্রস্তুতি যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্ভব হবে না বর্তমান পরিস্থিতিতেই তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অনিশ্চিত রাখাইনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ কোন দিকে নিয়ে যাবে তা কেবল সময়ই বলে দেবে।

রাখাইনে হয়তো একটি নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। এই নতুন যুগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রাখাইনের মানুষ নিজেরাই। যুদ্ধের কারণে তারা প্রতিদিন অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। তা সত্ত্বেও তারা তাদের নিজেদের ভাগ্য গঠনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আরাকান আর্মির নেতৃত্ব একটি নতুন যুগের আশা নিয়ে এসেছে। বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়গুলো তাদের দীর্ঘকালের বিভাজনগুলো দূর করে সমর্থন এবং সংহতি নিয়ে একত্র হয়েছে। ধ্বংস এবং হতাশার মধ্যে আশার বাতি জ্বলছে।

তথাপি, রাখাইনের টেকসই উন্নয়ন ও শান্তির পথ এখনো অনেক বন্ধুর। বছরের পর বছর ধরে নিপীড়নের কারণে যে অভিযোগগুলো জমে আছে সহজে তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। দেশের বাইরের স্বার্থগোষ্ঠীগুলো এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। চরমপন্থিরা মাথা তুলতে পারে যা শান্তি প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়াকে লাইনচ্যুত করার আশঙ্কা তৈরি করে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, সব স্টেকহোল্ডারকে সহযোগিতা ও আলোচনার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। রাখাইনের জনগণ একটি শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যতের হকদার। এটি অর্জনের জন্য প্রয়োজন হবে সাহসী নেতৃত্ব এবং ত্যাগ।

ম্রাউক-উ শহরের দখল রাখাইনের জনগণকে নতুন আশা দেখিয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, আগামী কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস জান্তা বাহিনী রাখাইনে আরও নৃশংস হামলা করতে পারে। তারা নির্বিচারে কামানের গোলা নিক্ষেপ ও বিমান হামলা চালাতে পারে। তবে আমি বিশ্বাস করি, ধীরে ধীরে রাখাইনের আকাশে সূর্য উঠছে। সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত একটি জমিতে তার সোনালি আলো ফেলছে। এই নতুন যুগের আলোতে এই অঞ্চলের জনগণ অতীতের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবে। একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তারা এগিয়ে যাবে যারা এই অঞ্চলকে তাদের বাড়ি বলে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭