ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

পুতিনের পর রাশিয়ার হাল ধরবেন কে?


প্রকাশ: 20/03/2024


Thumbnail

পঞ্চমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন পুতিন। ৮৭.৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনি। স্থানীয় সময় রোববার (১৭ মার্চ) বুথ ফেরত জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যদিয়ে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট হলেন তিনি।

পুতিন অমর নন। তিনিও একদিন মারা যাবেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকাকালেই যদি ৭১ বছর বয়সী এই নেতার মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে কে ধরবেন রাশিয়ার হাল?

এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। কারণ পুতিনের কোনো রাজনৈতিক উত্তরসূরি নেই, আবার তার কোনো জীবিত প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই।

২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিজয় নিশ্চিত করার জন্য নিখুঁতভাবে নির্বাচনে জালিয়াতির পরিকল্পনা করেছেন পুতিন।

ভোট কেনা, ব্যালটের ভুল গণনা, আগে থেকে সিল দেয়া ব্যালট বিতরণ, ব্যালট বাক্সের কারচুপি, ভোটারদের ভোটদানে বাধা এবং ভয় দেখানোর মতো সব পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন পুতিন অনুগতরা। যা তাকে সব নির্বাচনে সুনিশ্চিত বিজয় এনে দিয়েছে।

এছাড়া তিনি তার রাজনৈতিক বিরোধীদের মধ্যে কারও কারাদণ্ড দিয়েছেন, কারও নির্বাসিত করেছেন। আর সুষ্ঠু নির্বাচনে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সক্ষমতা যে কারও আছে, তাও তিনি অস্বীকার করেছেন।

এছাড়া পুতিন বরিস নেমতসভের মতো বিরোধী ব্যক্তিত্বদের হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি কারাগারে আলেক্সি নাভালনির মৃত্যুতেও তার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন বিরোধীরা।

তবে পরিহাসের বিষয় হলো, পুতিন গত ২৪ বছর ধরে নিজের  যেতে পারবেন না বা শান্তির সঙ্গে তার অবসর উপভোগ করতে পারবেন না। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তিনি তার মেয়াদকালে অভূতপূর্ব সম্পদ এবং ক্ষমতা সঞ্চয় করেছেন যেগুলোর প্রতি তিনি অনেক বেশি নির্ভরশীল।

নিখুঁত সুরক্ষা বলয়

পুতিন যদি অবসর গ্রহণের পরও তার প্রাসাদ ও ইয়টগুলো (জাহাজ) তার দখলে রাখতে পারেন, তাহলেও যে তিনি নিরাপদে থাকবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

পুতিন ক্ষমতা ছেড়ে দিলে তার পরে তার উত্তরসূরি আসতে পারে। পুতিনের ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব, ক্যারিশমা ও প্রভাব সর্বদা তার উত্তরাধিকারীর জন্য হুমকি হয়ে থাকবে।

বেশিরভাগ স্বৈরশাসকই তাদের উত্তরসূরির নাম প্রকাশ করে না। এর অন্যতম কারণ হলো, তারা অবসরে যাওয়ার আগে বা মারা যাওয়ার আগেই ক্ষমতার তিক্ত লড়াই শুরু হয়ে যেতে পারে। সেদিক থেকে যদি পুতিন কোনো উত্তরসূরির নাম ঘোষণা করেন, তাহলে সে ব্যক্তি অন্যান্য প্রতিযোগীদের আক্রোশের শিকার হয়ে উঠবে।

এমনকি পুতিনের নিজের বন্ধুদের মধ্যেও তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। যদিও পুতিন এসব বিষয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ২০২৩ সালে ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন যিনি একসময় পুতিনের খুব কাছের লোক ছিলেন, তিনিই তার (পুতিন) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

এ থেকে বোঝা যায় যে, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা কতটা মারাত্মক হতে পারে। তবে প্রিগোজিন ২০২৩ সালের আগস্টে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। যার আসল কারণ এখনো অজানা। হয়তো কখনও জানাও যাবে না। তবে সন্দেহ করা হয়, এর পেছনে পুতিনেরই হাত রয়েছে।

পুতিনকে সমর্থনকারী অভ্যন্তরীণ ধনী ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পেছনে দুর্নীতিবাজদের একটি বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। পুতিন বাদে অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দী যদি ক্ষমতায় আসেন তাহলে তারা তাদের ক্ষমতা, সম্পদ এবং এমনকি স্বাধীনতাও হারাবে। তাই পুতিনের মৃত্যুর পরপরই একটি রক্তক্ষয়ী ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে। তাহলে কেন তিনি আগে উত্তরসূরির নাম ঘোষণা করে ঝুঁকি নেবেন?
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুতিনের অপসারণের কোনো সম্ভাবনা নেই। রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষেবার উপর তার নিয়ন্ত্রণ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করতে এবং মিডিয়া, বিচার বিভাগ, আঞ্চলিক নেতা, সংসদ ও সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার বড় সুযোগ দিয়েছে।

তিনি তার শাসনামলের অভ্যন্তরে এবং বাইরের সম্ভাব্য বিরোধীপক্ষের কাছ থেকেও আসা হুমকিগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর তিনি তার শাসনামলকে ‘অভ্যুত্থান-বিরোধী’ নিশ্চিত করেছেন। পশ্চিমা বিরোধী রুশ জাতীয়তাবাদের নীতির মধ্যদিয়ে তিনি সামরিক এবং বেসামরিক নাগরিকদের বিশ্বাস জিতেছেন।

পুতিন তার ধনী ব্যবসায়ী সমর্থকদের নিজের পক্ষে রাখতে রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। রাশিয়ার প্রধান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল, গ্যাস, খনিজ ও শিল্প উৎপাদনকারী খাতগুলোতে কে নেতৃত্ব দিবেন -- তা স্বয়ং পুতিনই ঠিক করেন।

যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পুতিনের প্রতি অনুগত থাকে এবং তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশকে সমর্থন করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এসব বড় বড় ব্যবসায়ীরা কোম্পানির লভ্যাংশ ভোগ করেন।

এসব বড় ব্যবসায়ীদের সম্পদ এবং স্বাধীনতা ততদিনই থাকবে যতদিন তারা পুতিনের চোখে ভালো থাকবেন। একবার তাকে টেক্কা দেয়ার চেষ্টা করলে সবকিছু হারাতে হতে পারে।

যার অন্যতম উদাহরণ কারাবন্দি বিজনেস টাইকুন মিখাইল খোডোরকভস্কি। তিনি ২০০৩ সালে পুতিনের সমালোচনা করে বন্দি হন। এরপর তার তেল কোম্পানি ‘ইউকোস’ জব্দ করা হয়।

তবে পুতিনের এসব ধনী সমর্থকদের কেউই তাকে উপেক্ষা করতে পারেন না। এর পেছনে আরও একটি কারণ হলো: কয়েক দশক ধরে তিনি আপোষমূলক উপকরণ বা ‘কমপ্রোম্যাট’জোগাড় করে রেখেছেন যা দিয়ে তিনি তার উপদেষ্টাকেও ব্ল্যাকমেইল করতে পারেন।

এক কথায় বলা যায়, পুতিনের জোট থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার অভিজাতদের সবকিছু হারানো ব্যতীত কিছু পাওয়ার নেই।

মৃত্যুর পর কী হবে?

পুতিন যদি অবসরে না যান বা ক্ষমতাচ্যুত না হন; আর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই মারা যান তখন কী হবে? রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, যখন দেশটির প্রেসিডেন্ট তার দায়িত্বপালনে সক্ষম থাকেন না, তখন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সীমিত ক্ষমতা নিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন। এর আগে ২০০০ সালে যখন বরিস ইয়েলৎসিন পদত্যাগ করেন তখন প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য এিই পুতিনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল।

তবে বর্তমানে অনেক কিছুই বদলে গেছে। রাশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন খুবই নমনীয় একজন সাবেক কর কর্মকর্তা। তার নিজস্ব কোনো শক্তিশালী ভিত্তি নেই। তিনি যদি পুতিনের মৃত্যু পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টও হন তাহলেও এটা প্রায় অসম্ভব যে তিনি স্থায়ী প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন।

দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মৃত্যু বা অপসারণের তিন মাসের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু ক্ষমতার জন্য আসল লড়াইটা হবে পর্দার আড়ালে,ব্যালট বাক্সে নয়।
এমনটা সম্ভব যে, সম্ভাব্য সহিংস ক্ষমতার লড়াই নির্বাচনের আগে সমাধান করা যেতে পারে, তবে উত্তরাধিকারীর কাছে তাদের দখলকে সুসংহত করতে এবং পুতিনের রেখে যাওয়া শূন্যতা পূরণ করতে তিন মাস বেশি সময় নয়।

এটাও সম্ভব যে, একটি ঐক্যমত্য প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়ী করে পরে দলগুলোর মধ্যে আসল লড়াই পরের বছরগুলোতে চলবে। নেতাদের একটি অনানুষ্ঠানিক জোট প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও নিরাপত্তা পরিষেবাগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো থেকে সম্মিলিতভাবে শাসন করার চেষ্টা করা হতে পারে।

রাশিয়ায় এই ধরণের ক্ষমতা ভাগাভাগি ব্যবস্থার ঐতিহাসিক নজির রয়েছে। যেমন; ভ্লাদিমির লেনিন ও জোসেফ স্ট্যালিন উভয়ের মৃত্যুর পরে ‘সম্মিলিত নেতৃত্ব’ ঘোষণাকারী জোটগুলো সংক্ষিপ্তভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে,জোটের একজন সদস্য তাদের অংশীদারদের ছাড়িয়ে যেতে এবং নির্মূল করতে সক্ষম হয়। প্রথমে স্ট্যালিন এবং পরে নিকিতা ক্রুশ্চেভ।

তবে পুতিনের মৃত্যুর পরের দিন, মাস ও বছরগুলো যে কারো প্রত্যাশার চেয়েও বেশি উত্তাল হতে পারে। কারণ দেশটিতে এখন কোনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নেই। রোমানভের অধীনের রাজপরিবারই রাশিয়া শাসন করা শেষ রাজপরিবার। এছাড়াও সোভিয়েত সময়ের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধরে রাখার জন্য একক-দলীয় রাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানও নেই।  



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭