ইনসাইড থট

প্রতিদিন চুরি যায় ........ সোনা!!! 

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/07/2018


Thumbnail

বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা হারানো, কয়লা গায়েবের পরে এবার না দেখা দামী কিছু হারানোর জ্বরে আক্রান্ত আমাদের দেশের শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। একাধিক ছড়া, কবিতা লেখা হয়েছে। পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। প্রেমিকরা ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের তালা ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে, এমন প্রত্যয়। কিন্তু তা কি এত সহজ হবে? অনেকে বলছেন এটা এক ধরনের বিকার, পরিবার প্রধানের অসৎভাবে সম্পদ অর্জনের সাইড ইফেক্ট। 

২০০৭-৮ সালে আমাদের সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় তথা নৈতিক অধঃপতন নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। লেখা বইটা একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ছাপানোর জন্য দেবার পরে তাঁরা বলেন যে, এটা ছাপালে তাঁদের বিজ্ঞাপন সব বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ ঐ লেখায়, পেশাগত নৈতিকতার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন প্রচারে মিডিয়ার নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল।      

সামাজিক গবেষণা বলে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে নৈতিকতার অভাব মূলত: আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ও ভোগবিলাসী মানসিকতা থেকে জন্ম নেয়। তবুও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণগুলোর মধ্যে ভালো থাকার সদিচ্ছার পারিবারিক শিক্ষার অভাব, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তার গ্যারান্টি না থাকা, দারিদ্র,ভোগ বিলাসী মানসিকতা, জাতীয় সম্পদগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার, ইত্যাদি প্রধান বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকদের নূন্যতম নাগরিক সুবিধা না দিয়ে তাঁদেরকে নাগরিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য করানোর চেষ্টা, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা দেশে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকের উপযুক্ত পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করা ও তাঁদের কাজ থেকে অর্জিত করের টাকায় শ্রমিকের শ্রমকালীন ও অবসরকালীন সময়ে জানমাল রক্ষার নূন্যতম নিরাপত্তা রাষ্ট্র দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজের ও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন। 

আমাদের দেশে দুর্নীতি চলে মূলত: হচ্ছে দু’ধারায়। এক শ্রেণীর লোক নিজে ও তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর জন্য, আর অন্য শ্রেণী ভোগ বিলাসিতা, নাম কামানোর জন্য দুর্নীতি করছেন। আবার কেউ কেউ বাঁচার জন্য দুর্নীতি শুরু করে পরে ভোগবিলাসী হয়ে যাচ্ছেন। যাঁদের একজনকে দেখে পর্যায়ক্রমে হাজার হাজার ভাল মানুষ দুর্নীতি করতে উৎসাহিত হচ্ছে। মিডিয়া যেহেতু এই সমাজেরই অংশ তাই তারাও এই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাচ্ছে।   

সৎ ও নৈতিক জীবন যাপনের জন্য পারিবারিক শিক্ষা ও ব্যক্তিগত সদিচ্ছাই যে যথেষ্ট তা আজ আমরা সবাই ভুলতে বসেছি। অর্থনৈতিক কষ্টে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ এখন মূল্যবোধ, সংস্কার, দেশের প্রচলিত আইন, ইত্যাদি মেনে চলার পরিবর্তে বেঁচে থাকার জন্য যেনতেন উপায়ে টাকা আয় করছেন, বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। সেটা নৈতিক না অনৈতিক তার বিচার এখানে মুখ্য নয়। বরং কাজে নৈতিকতা প্রয়োগকারী বা উচ্চ-নৈতিকতার অধিকারীকে আমাদের সমাজে বলা হচ্ছে পাগল বা মূর্খ।

আয়ের সঙ্গে সংগতিবিহীন ব্যয় নির্বাহের জন্য কোনো কোনো সময় আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোক বাধ্য হয়েই অবৈধ আর্থিক লেনদেন,টেলিফোনে মিথ্যা কথা, অন্যকে ফাঁকি দেওয়া, ইত্যাদি পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের সামনেই করে থাকেন। প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে আমরা মিথ্যচার করে চলছি। বই পুস্তকে বা জ্ঞানী লোকেরা পত্র পত্রিকায় ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় সৎ জীবন যাপনের পরামর্শ দিলেও বাস্তবে নিজেরাই তা করেন না; যার প্রভাব পড়ছে সমাজের সবার উপর। পারিবারিক পরিবেশে বাস্তবিক অর্থে নৈতিকতার শিক্ষা আমাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পাচ্ছে না। যে বাবা মা তাঁর কাছে আদর্শ তাঁর স্বরূপ জেনে ছেলে মেয়েরা অনেকেই হয়ে পড়েন হতাশ, তাঁর থেকে বিকৃতি, মানসিক শান্তির প্রত্যাশায় নানান চেষ্টা।  

ব্যক্তি নিয়ে সমাজ, সেকারণে ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে নৈতিকতা না থাকলে সমাজ জীবনে নৈতিকতা আশা করা যায় না। আইন অমান্য করে টিকে থাকাই আমাদের বর্তমান সমাজে ক্ষমতার লক্ষণ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবিচার, অন্যায়, মানুষকে ফাঁকি ও ভয় দেখিয়ে তথাকথিত সমাজপতি, অবৈধ অস্ত্রধারীরা রাতারাতি প্রচুর টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অপশক্তিকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সামাজিক কল্যাণমুখী সংগঠনগুলো ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্ব রক্ষায় সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে আপোষ করছেন। এসব দেখে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার যুবকরা তথাকথিত ক্ষমতাশালী লোকদের দলে ভিড়ে যাচ্ছে। এভাবেই আমাদের সমাজের মূল্যবোধ, সংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস, ইত্যাদি মেনে চলার চর্চা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে।   

বাংলাপিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ১৮১৮ সালে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি ১৮টি গল্প নিয়ে ‘নৈতিকতা’ নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশ করে। এটাকে বাংলা ভাষায় নৈতিকতার উপর প্রকাশিত প্রথম বই হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্কুলে শিশুদের পাঠ্য হিসেবে পড়ানোর জন্য বইটি প্রকাশ করা হলেও বইটি শিশুদের জন্য সুখপাঠ্য ছিল না। তাই বইয়ের মূল কথা বড়দের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মাঝে ক্রমান্বয়ে প্রচারিত ও প্রসারিত হতে থাকে। যার ফল প্রাচীন কালের শিক্ষিত-স্বশিক্ষিত সকলের জীবনাচরণে কমবেশি তা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। পরবর্তীতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ার ছন্দে নীতিকথা প্রচারিত হতে দেখা যায়। যেমন ’সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি/ আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে/ আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে. . .ইত্যাদি। 

স্বাধীনতা উত্তর বাংলায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাস্তরের পাঠ্য বইতে ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে নানাভাবে নীতিকথা শিক্ষার একাটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ইদানীং কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি শিক্ষার তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। ছাত্ররা শিক্ষাজীবন শেষ করার পর কর্মজীবনে কীভাবে তাঁদের কর্মে ও আচরণে নৈতিকতার প্রয়োগ করবে তার কোন শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, বিচারক, বেসামরিক আমলা, ইত্যাদি নানা পেশাদারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামে নীতি শিক্ষার তেমন কোনো উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষণীয় নয়। বিভিন্ন পেশায় মূল্যবোধ তথা নৈতিকতার মাপকাঠি কী হবে তা শেখানো হয় বলে দেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেন না।   

শিক্ষাদান একসময় ছিল ব্রত। তা থেকে হয়েছিল পেশা, আর এখন তা রীতিমত বাণিজ্য! আই বাণিজ্যের শিকার আমাদের বিরাট সম্ভাবনাময় যুবশক্তি। হাতে গোনা দুই চারটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সবখানেই শিক্ষার (মানহীন) সার্টিফিকেট বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকে সার্টিফিকেট কেনারা (!) পরে না পায় চাকরি না পারে করতে ব্যবসা। তখন হতাশা তাঁদের গ্রাস করে, এই হতাশা থেকে রক্তে থাকা মূল্যবোধের অবশিষ্টাংশ তাঁরা শেষ করে দেয় নানাভাবে।        

আমাদের আরেক বন্ধু যিনি পেশায় সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক তিনি তাঁর একটা অভিজ্ঞতার কথা পোস্ট করে জানিয়েছেন কয়েকদিন আগে। সেখানে তিনি তাঁর এক ঘনিষ্ঠজনের বরাতে বলেন, ‘মেয়েটি আমার মহল্লারই ছিল। কোন এক পারিবারিক সমস্যায় এইচএসসির পরে ৩-৪ বছর লেখাপড়ায় গ্যাপ পরেছিল। পরে ধানমন্ডিতে ক্যাম্পাস এমন এক নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ভর্তি হয়েছিল। মাঝে মাঝেই আমার কাছে এসে কিছু গল্প করার ছলে ওদের ক্যাম্পাসের ঘটনা বলত। আমি ভাবতাম গ্যাপের জন্য ওর এসব কথাবার্তা। শুনতাম কখনো বকাও দিতাম কখনো বুঝাতাম আর বলতাম, নিজের লেখা পড়ায় মগ্ন থাক, অন্যদের এসবে মগজ গলাস না। ওর গল্পের দু একটি বলি।   

‘প্রায়শ: ক্লাসমেটরা বয় ফ্রেন্ড, গার্ল ফ্রেন্ড (বিএফ জিএফ) ওপেন ক্যান্টিনে একজন অন্যজনের গায়ে ইচ্ছাকৃত, যদিও ভান থাকে অনিচ্ছাকৃতভাবে পড়েছে, কোক ফেলে তা জিহ্বা দিয়ে চেটে খায়। চেটে খাওয়া স্থান গুলো খুব স্পর্শকাতর, যেমন যেমন হাতের উপরের অংশ, কাঁধ, গলার নীচে.....বুকে!

শিক্ষক সেমিস্টার পরীক্ষার নোট দেখে দিতে রুমে যেতে বলে কিন্তু রুমে একা যেতে হবে’!

তিনি আর বলেন, ‘আমি ভাবতাম ও হয়ত এর মাধ্যমে নিজেকে রূপবতী বুঝাতে এই গল্প বলে। কারণ নিজে শিক্ষকতা করি ২৩ বছর। পড়াই এডাল্টদের কিন্তু কখনো এমন চিন্তা মাথায় আসেনি’।

এবার এক বাড়িওয়ালা (আমার রোগী)র কথা বলি। আশুলিয়ার জামতলা নামক স্থানে তার টিন শেড বাড়ি। প্রায় ৪০ টি রুম ভাড়া। ঝামেলা এড়াতে উনি নোটিশ করেছেন: ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়া হয়না। তার বক্তব্য তার সব রুমেই স্বামী স্ত্রী বলে ভাড়া নেওয়া গার্মেন্টস কর্মী। উনি একবার এক ভাড়াটিয়ার বকেয়া ভাড়ার খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারে তারা একই গার্মেন্টস এ চাকরি করলেও বিবাহিত নয়। সেটা জানার পর অন্যদের খোঁজ নিতে গিয়ে তাঁর হাই প্রেশার হয়ে গেছে। বেশির ভাগই ভাড়া নিতে স্বামী-স্ত্রী সেজে ভাড়া নিয়েছেন। উনি বাড়ি ভাড়া বাদ দেবার কথা ভাবলেও পরিবারের চাপে পারেন নি।

সব কথা প্রকাশ্য আলাপ করা যায় না। সেরূপ স্বামী-স্ত্রী হলেও প্রকাশ্যে চুমোচুমি নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবার কারণ নাই। আর বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে তো তা গৃহীত হবার কোনো কারণই নেই। যারা এসবের বাইরের ভাবনায় ঘি ঢালেন তাদের বলি এদেশের আইন জানুন। বিবাহের সংজ্ঞা আইনে স্পষ্ট দেওয়া আছে। বৈবাহিক সম্পর্কহীন সম্পর্কের ফলাফল বোধকরি বুঝবেন, যদি আইন মানেন। বরং সন্তান বা সন্তানতুল্যদের চুমোচুমিতে উৎসাহ না দিয়ে তাদের উনি শিক্ষা দিয়ে প্রয়োজনে যৌবনের প্রাক্কালেই বিবাহ দিতে উৎসাহিত করুন। সম্মান রক্ষা ও দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারবেন’!

 

নচিকেতার একটা গানের কলি ফেসবুকে পোস্ট করলেন আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু: 

প্রতিদিন চুরি যায় মূল্যবোধের সোনা,

আমাদের স্বপ্ন, আমাদের চেতনা।

কিছুটা মূল্য পেয়ে ভাবি বুঝি শোধ-বোধ,

ন্যায় নীতি ত্যাগ করে, মানুষ আপোষ ক’রে,

চুরি গেছে আমাদের সব প্রতিরোধ...........................

 

লেখক: উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

Email: arefinbhai59@gmail.com

তথ্যঋণ: বাংলাপিডিয়া, সাংবাদিক জুয়েল, ফেসবুক ও অন্যান্য।

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭