নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:০১ পিএম, ২৫ জুলাই, ২০১৮
বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা হারানো, কয়লা গায়েবের পরে এবার না দেখা দামী কিছু হারানোর জ্বরে আক্রান্ত আমাদের দেশের শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। একাধিক ছড়া, কবিতা লেখা হয়েছে। পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। প্রেমিকরা ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের তালা ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে, এমন প্রত্যয়। কিন্তু তা কি এত সহজ হবে? অনেকে বলছেন এটা এক ধরনের বিকার, পরিবার প্রধানের অসৎভাবে সম্পদ অর্জনের সাইড ইফেক্ট।
২০০৭-৮ সালে আমাদের সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় তথা নৈতিক অধঃপতন নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। লেখা বইটা একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ছাপানোর জন্য দেবার পরে তাঁরা বলেন যে, এটা ছাপালে তাঁদের বিজ্ঞাপন সব বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ ঐ লেখায়, পেশাগত নৈতিকতার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন প্রচারে মিডিয়ার নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল।
সামাজিক গবেষণা বলে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে নৈতিকতার অভাব মূলত: আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ও ভোগবিলাসী মানসিকতা থেকে জন্ম নেয়। তবুও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণগুলোর মধ্যে ভালো থাকার সদিচ্ছার পারিবারিক শিক্ষার অভাব, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তার গ্যারান্টি না থাকা, দারিদ্র,ভোগ বিলাসী মানসিকতা, জাতীয় সম্পদগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার, ইত্যাদি প্রধান বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকদের নূন্যতম নাগরিক সুবিধা না দিয়ে তাঁদেরকে নাগরিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য করানোর চেষ্টা, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা দেশে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকের উপযুক্ত পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করা ও তাঁদের কাজ থেকে অর্জিত করের টাকায় শ্রমিকের শ্রমকালীন ও অবসরকালীন সময়ে জানমাল রক্ষার নূন্যতম নিরাপত্তা রাষ্ট্র দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়েই নিজের ও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন।
আমাদের দেশে দুর্নীতি চলে মূলত: হচ্ছে দু’ধারায়। এক শ্রেণীর লোক নিজে ও তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর জন্য, আর অন্য শ্রেণী ভোগ বিলাসিতা, নাম কামানোর জন্য দুর্নীতি করছেন। আবার কেউ কেউ বাঁচার জন্য দুর্নীতি শুরু করে পরে ভোগবিলাসী হয়ে যাচ্ছেন। যাঁদের একজনকে দেখে পর্যায়ক্রমে হাজার হাজার ভাল মানুষ দুর্নীতি করতে উৎসাহিত হচ্ছে। মিডিয়া যেহেতু এই সমাজেরই অংশ তাই তারাও এই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাচ্ছে।
সৎ ও নৈতিক জীবন যাপনের জন্য পারিবারিক শিক্ষা ও ব্যক্তিগত সদিচ্ছাই যে যথেষ্ট তা আজ আমরা সবাই ভুলতে বসেছি। অর্থনৈতিক কষ্টে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ এখন মূল্যবোধ, সংস্কার, দেশের প্রচলিত আইন, ইত্যাদি মেনে চলার পরিবর্তে বেঁচে থাকার জন্য যেনতেন উপায়ে টাকা আয় করছেন, বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। সেটা নৈতিক না অনৈতিক তার বিচার এখানে মুখ্য নয়। বরং কাজে নৈতিকতা প্রয়োগকারী বা উচ্চ-নৈতিকতার অধিকারীকে আমাদের সমাজে বলা হচ্ছে পাগল বা মূর্খ।
আয়ের সঙ্গে সংগতিবিহীন ব্যয় নির্বাহের জন্য কোনো কোনো সময় আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোক বাধ্য হয়েই অবৈধ আর্থিক লেনদেন,টেলিফোনে মিথ্যা কথা, অন্যকে ফাঁকি দেওয়া, ইত্যাদি পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের সামনেই করে থাকেন। প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে আমরা মিথ্যচার করে চলছি। বই পুস্তকে বা জ্ঞানী লোকেরা পত্র পত্রিকায় ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় সৎ জীবন যাপনের পরামর্শ দিলেও বাস্তবে নিজেরাই তা করেন না; যার প্রভাব পড়ছে সমাজের সবার উপর। পারিবারিক পরিবেশে বাস্তবিক অর্থে নৈতিকতার শিক্ষা আমাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পাচ্ছে না। যে বাবা মা তাঁর কাছে আদর্শ তাঁর স্বরূপ জেনে ছেলে মেয়েরা অনেকেই হয়ে পড়েন হতাশ, তাঁর থেকে বিকৃতি, মানসিক শান্তির প্রত্যাশায় নানান চেষ্টা।
ব্যক্তি নিয়ে সমাজ, সেকারণে ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে নৈতিকতা না থাকলে সমাজ জীবনে নৈতিকতা আশা করা যায় না। আইন অমান্য করে টিকে থাকাই আমাদের বর্তমান সমাজে ক্ষমতার লক্ষণ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবিচার, অন্যায়, মানুষকে ফাঁকি ও ভয় দেখিয়ে তথাকথিত সমাজপতি, অবৈধ অস্ত্রধারীরা রাতারাতি প্রচুর টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অপশক্তিকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সামাজিক কল্যাণমুখী সংগঠনগুলো ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্ব রক্ষায় সমাজের অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে আপোষ করছেন। এসব দেখে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার যুবকরা তথাকথিত ক্ষমতাশালী লোকদের দলে ভিড়ে যাচ্ছে। এভাবেই আমাদের সমাজের মূল্যবোধ, সংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস, ইত্যাদি মেনে চলার চর্চা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাপিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ১৮১৮ সালে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি ১৮টি গল্প নিয়ে ‘নৈতিকতা’ নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশ করে। এটাকে বাংলা ভাষায় নৈতিকতার উপর প্রকাশিত প্রথম বই হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্কুলে শিশুদের পাঠ্য হিসেবে পড়ানোর জন্য বইটি প্রকাশ করা হলেও বইটি শিশুদের জন্য সুখপাঠ্য ছিল না। তাই বইয়ের মূল কথা বড়দের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মাঝে ক্রমান্বয়ে প্রচারিত ও প্রসারিত হতে থাকে। যার ফল প্রাচীন কালের শিক্ষিত-স্বশিক্ষিত সকলের জীবনাচরণে কমবেশি তা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। পরবর্তীতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ার ছন্দে নীতিকথা প্রচারিত হতে দেখা যায়। যেমন ’সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি/ আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে/ আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে. . .ইত্যাদি।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাস্তরের পাঠ্য বইতে ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে নানাভাবে নীতিকথা শিক্ষার একাটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ইদানীং কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি শিক্ষার তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। ছাত্ররা শিক্ষাজীবন শেষ করার পর কর্মজীবনে কীভাবে তাঁদের কর্মে ও আচরণে নৈতিকতার প্রয়োগ করবে তার কোন শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, বিচারক, বেসামরিক আমলা, ইত্যাদি নানা পেশাদারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামে নীতি শিক্ষার তেমন কোনো উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষণীয় নয়। বিভিন্ন পেশায় মূল্যবোধ তথা নৈতিকতার মাপকাঠি কী হবে তা শেখানো হয় বলে দেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেন না।
শিক্ষাদান একসময় ছিল ব্রত। তা থেকে হয়েছিল পেশা, আর এখন তা রীতিমত বাণিজ্য! আই বাণিজ্যের শিকার আমাদের বিরাট সম্ভাবনাময় যুবশক্তি। হাতে গোনা দুই চারটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সবখানেই শিক্ষার (মানহীন) সার্টিফিকেট বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকে সার্টিফিকেট কেনারা (!) পরে না পায় চাকরি না পারে করতে ব্যবসা। তখন হতাশা তাঁদের গ্রাস করে, এই হতাশা থেকে রক্তে থাকা মূল্যবোধের অবশিষ্টাংশ তাঁরা শেষ করে দেয় নানাভাবে।
আমাদের আরেক বন্ধু যিনি পেশায় সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক তিনি তাঁর একটা অভিজ্ঞতার কথা পোস্ট করে জানিয়েছেন কয়েকদিন আগে। সেখানে তিনি তাঁর এক ঘনিষ্ঠজনের বরাতে বলেন, ‘মেয়েটি আমার মহল্লারই ছিল। কোন এক পারিবারিক সমস্যায় এইচএসসির পরে ৩-৪ বছর লেখাপড়ায় গ্যাপ পরেছিল। পরে ধানমন্ডিতে ক্যাম্পাস এমন এক নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ভর্তি হয়েছিল। মাঝে মাঝেই আমার কাছে এসে কিছু গল্প করার ছলে ওদের ক্যাম্পাসের ঘটনা বলত। আমি ভাবতাম গ্যাপের জন্য ওর এসব কথাবার্তা। শুনতাম কখনো বকাও দিতাম কখনো বুঝাতাম আর বলতাম, নিজের লেখা পড়ায় মগ্ন থাক, অন্যদের এসবে মগজ গলাস না। ওর গল্পের দু একটি বলি।
‘প্রায়শ: ক্লাসমেটরা বয় ফ্রেন্ড, গার্ল ফ্রেন্ড (বিএফ জিএফ) ওপেন ক্যান্টিনে একজন অন্যজনের গায়ে ইচ্ছাকৃত, যদিও ভান থাকে অনিচ্ছাকৃতভাবে পড়েছে, কোক ফেলে তা জিহ্বা দিয়ে চেটে খায়। চেটে খাওয়া স্থান গুলো খুব স্পর্শকাতর, যেমন যেমন হাতের উপরের অংশ, কাঁধ, গলার নীচে.....বুকে!
শিক্ষক সেমিস্টার পরীক্ষার নোট দেখে দিতে রুমে যেতে বলে কিন্তু রুমে একা যেতে হবে’!
তিনি আর বলেন, ‘আমি ভাবতাম ও হয়ত এর মাধ্যমে নিজেকে রূপবতী বুঝাতে এই গল্প বলে। কারণ নিজে শিক্ষকতা করি ২৩ বছর। পড়াই এডাল্টদের কিন্তু কখনো এমন চিন্তা মাথায় আসেনি’।
এবার এক বাড়িওয়ালা (আমার রোগী)র কথা বলি। আশুলিয়ার জামতলা নামক স্থানে তার টিন শেড বাড়ি। প্রায় ৪০ টি রুম ভাড়া। ঝামেলা এড়াতে উনি নোটিশ করেছেন: ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়া হয়না। তার বক্তব্য তার সব রুমেই স্বামী স্ত্রী বলে ভাড়া নেওয়া গার্মেন্টস কর্মী। উনি একবার এক ভাড়াটিয়ার বকেয়া ভাড়ার খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারে তারা একই গার্মেন্টস এ চাকরি করলেও বিবাহিত নয়। সেটা জানার পর অন্যদের খোঁজ নিতে গিয়ে তাঁর হাই প্রেশার হয়ে গেছে। বেশির ভাগই ভাড়া নিতে স্বামী-স্ত্রী সেজে ভাড়া নিয়েছেন। উনি বাড়ি ভাড়া বাদ দেবার কথা ভাবলেও পরিবারের চাপে পারেন নি।
সব কথা প্রকাশ্য আলাপ করা যায় না। সেরূপ স্বামী-স্ত্রী হলেও প্রকাশ্যে চুমোচুমি নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবার কারণ নাই। আর বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে তো তা গৃহীত হবার কোনো কারণই নেই। যারা এসবের বাইরের ভাবনায় ঘি ঢালেন তাদের বলি এদেশের আইন জানুন। বিবাহের সংজ্ঞা আইনে স্পষ্ট দেওয়া আছে। বৈবাহিক সম্পর্কহীন সম্পর্কের ফলাফল বোধকরি বুঝবেন, যদি আইন মানেন। বরং সন্তান বা সন্তানতুল্যদের চুমোচুমিতে উৎসাহ না দিয়ে তাদের উনি শিক্ষা দিয়ে প্রয়োজনে যৌবনের প্রাক্কালেই বিবাহ দিতে উৎসাহিত করুন। সম্মান রক্ষা ও দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারবেন’!
নচিকেতার একটা গানের কলি ফেসবুকে পোস্ট করলেন আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু:
প্রতিদিন চুরি যায় মূল্যবোধের সোনা,
আমাদের স্বপ্ন, আমাদের চেতনা।
কিছুটা মূল্য পেয়ে ভাবি বুঝি শোধ-বোধ,
ন্যায় নীতি ত্যাগ করে, মানুষ আপোষ ক’রে,
চুরি গেছে আমাদের সব প্রতিরোধ...........................
লেখক: উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট
Email: arefinbhai59@gmail.com
তথ্যঋণ: বাংলাপিডিয়া, সাংবাদিক জুয়েল, ফেসবুক ও অন্যান্য।
বাংলা ইনসাইডার/জেডএ
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৪:৪২ পিএম, ২০ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৪:০০ পিএম, ১৭ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও তিনি কাঁদছিলেন।
প্রকৃতিও সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল। পৌনে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতি তাঁর কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। কুর্মিটোলা থেকে তিনি যান বনানী গোরস্থানে। সেখানে যেয়ে আবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বনানী থেকে তিনি যান শেরে বাংলা নগরে। সেখানে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ জনতা অপেক্ষা করছিল। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বক্তব্য রাখেন।
কি বলেছিলেন তিনি লাখ লাখ জনতার সমাবেশে? হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া ফলাও করে এসব খবর সেদিন কোন পত্রিকা বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। ৪৩ বছর আগের সে সব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াও আজ কষ্টসাধ্য। সেদিনের ভাষণের যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই বোন, আরো অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল, আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আমি আপনাদের কাছে এসেছি।
বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা নেতা হবার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসাবে, মেয়ে হিসাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসাবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।
আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলার মানুষের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার পরিজন হত্যা করে বলেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমানো ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কি? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দিনে দুপুরে মানুষ খুন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না, আর একশ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে।
ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃংখলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তবে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকতো না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তববায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি; আপনাদের ভালবাসা নিয়ে, পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। আপনারা আমার সাথে শপথ করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।
স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি।
আপনাদের ভালবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।
(তথ্যসূত্র: সংবাদপত্রে শেখ হাসিনার বক্তৃতা: ১৯৮১-১৯৮৬; প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩)
প্রত্যাবর্তন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০১:০০ পিএম, ১৭ মে, ২০২৪
আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। “বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই ও বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই ও স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।’
ওই লিফলেটে আরো লেখা ছিল: “আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তি সংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে।...তিনি আমাদের কর্ম ও চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।”
প্রচারপত্রে
আরও বলা হয়েছিল: “...ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী ও তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।...আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশা—জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে এ প্রত্যাবর্তন। বাঙালী জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই এ প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।”
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বস্তিতে ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কায় সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শঙ্কিত বোধ করছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরূদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির এক সভায় শেখ হাসিনাকে বিদেশি শক্তির তল্পিবাহক বলে অভিহিত করা হয়। একই দিনে আরেকটি সভা থেকে বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, বাকশালিরা ভারতের গোলাম। তারা বিদেশি সৈন্যের সহায়তায় ক্ষমতায় বসতে চায়। যে দলের প্রধান দিল্লিতে, সে দল জনগণের কল্যান করতে পারে না। সাতাশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুনী মুশতাক গংদের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে বলা হয়েছিল, ইন্দিরার নীলনকশা এখন বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, “৭৫ এর পর তারা দিল্লি ও লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচেষ্টা চালায়। লন্ডনে জমে ওঠে দিল্লির সেবাদাসদের আড্ডা। তারাই আজ বাকশালী কমিটির ছত্রচ্ছায়ায় দেশে ফিরছে। সমস্ত কিছু ঠিক করে হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।”
সে সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের খবরে সে সময়কার জিয়া সরকারের ভিতরে উদ্বিগ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে গিয়েছিল ; আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান)- ওরকমভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর আর্দশের কর্মীরা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেমন একটি সময় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়াকে তৎকালীন জিয়া সরকার মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে তাই ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠন’ করা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালিন জাতীয় সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) ৩ মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না ।
বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন ‘শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।’ পরদিন ৪ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না ।’ এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জানিয়ে দেন তাঁকে যদি হত্যা করার চেষ্টাও করা হয় তাহলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন । গণআকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠন’ শেখ হাসিনা আসার আগেই তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।
দীর্ঘ ছ'বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলে লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে তাদের নেত্রীকে বরণ করে নেন। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকেই শহরজুড়ে কেবলি মিছিল আর মিছিল। সেদিন শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা জানাতে ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের ঢাকা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বন্দীশালা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন, সেদিনটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।
কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান অবতরণ করবে সেদিকে নজর রেখে লক্ষাধিক মানুষ মধ্যাহ্ন থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকেই বিমানবন্দরে কোন নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। হাজার হাজার মানুষ ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে নিয়োজিত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে প্রথমে দেয়ালের উপর ওঠে। একই সময়ে বিমানবন্দর ভবনের দোতলায় কন্ট্রোল টাওয়ারের যেখানে স্থান করা সম্ভব সেখানেই জনতা উঠে যায়। সবারই উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখা। পুলিশ বারবার চেষ্টা করেও তাদের সরাতে পারে নি। বিমানবন্দরের বাইরে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
সাদা-কালো রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যখন ৪টা ৩২ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে সজ্জিত ট্রাকে নামছিলেন; তখন লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই– 'শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব', 'শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা' 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'। বিমান থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত হাসিনাকে নিয়ে আসতে ট্রাকটির ১৫ মিনিট সময় লাগে। সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়। এ পরিবেশ উচ্ছ্বাসের, এ পরিবেশ আনন্দে অশ্রু ফেলার। বিমান থেকে নামার আগে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক যখন শেখ হাসিনার গলায় মালা দিচ্ছেলেন, তখন তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা আসার পথেও শেখ হাসিনা পাঁচ-ছয়বার অঝোরে কেঁদেছিলেন।
বিকেল চারটার দিকেই আকাশে কালো মেঘ ছিল। পৌনে পাঁচটায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে মিছির শুরু হবার পরপরই চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। রাত আটটা পর্যন্ত সেদিন মুষলধারে বিরতীহীন বৃষ্টি ঝরেছিল। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেইসাথে তীব্র ঝড়। প্রকৃতি ভয়াল রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। এরই মাঝে ট্রাকে ও রাস্তার দুপাশের জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান। বর্ষণসিক্ত শেখ হাসিনা ঝড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে যাচ্ছিলেন বনানী হয়ে শেরেবাংলানগরের সভাস্থলে। বনানী গোরস্থানে শেখ হাসিনার মা ও নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি কান্নায় আকুল ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কবরে শায়িত মাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, আমাকে কেন রেখে গেলে?’
কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত আট মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগার কথা খুব বেশি হলে ত্রিশ মিনিট। প্রায় তিনঘন্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরের সভাস্থলে পৌছিয়েছিলেন। তখনও চারদিক অন্ধকার, মুষলধারে বৃষ্টি। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন তখন প্রায় বিপন্ন, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সভাস্থলে তখনো লক্ষ লক্ষ লোক উপস্থিত। শেখ হাসিনাকে তারা দেখবেনই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসম্বর্ধনা সভার মঞ্চে এলেন।
লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সমাবেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।"
বক্তৃতাদানের এক পর্যায়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, "আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।"
বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা পাথেয় করে আমি আগামীদিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করে দেবো।”
১৭ মে রাতে শেখ হাসিনা ছোট ফুপুর বাসায় ছিলেন। সেই সময়েও শেখ হাসিনাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। বাধ্য হয়েই তিনি তখন কিছুদিন ছোট ফুপুর বাসায়, কিছুদিন মেঝো ফুপুর বাসায় থাকতেন। দেশে ফিরে তিনি ধানমন্ডিতে নিজেদের বাসায় গেলে সেখানে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া ও মিলাদ পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ধানমন্ডির বাসাটা সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যকেই এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।
১৮ মে সকালে শেখ হাসিনা দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন এবং পরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্জন করেন। ওইদনই বিকেলে তিনি পিতা শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তিনি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বাড়ির ও গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্রন্দনরত শেখ হাসিনাকে অনেকে সান্ত্বনা দেন। তিনি সেখানে সমাধিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মাজার জিয়ারত করেন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
২০ মে গোপালগঞ্জের ঈদগাঁ ময়দানে মেখ হাসিনার সম্মানার্থে এক গণসম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংষার করছিলাম। আপনাদের ডাকে সবকিছু ছেড়ে এসেছি। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবর দান করতে চাই।” তিনি আরো বলেছিলেন, “গত ছয় বছরে দেশের মানুষের কোনরকম উন্নতি তো আমি দেখি নি। মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কৃষক-শ্রমিক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য পাচ্ছে না।” তিনি উত্তাল জসমুদ্রের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, “তবে কেন বঙ্গবন্থু, শেখ মনি ও চার নেতাকে হত্যা করা হলো?”
লেখক: ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন: সভাপতি, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ।
মন্তব্য করুন
১৩৯ টি উপজেলার মধ্যে ৩০টি উপজেলায় শতকরা ৩০ ভাগের কম ভোট পড়েছে। আর শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে মাত্র ২৩ টি উপজেলায়। সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে ইভিএমে ভোট নেয়া উপজেলাগুলোতে। ২০টি উপজেলায় ইভিএমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনোটিতেই ৫০ ভাগ ভোটও পড়েনি। ইভিএমে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে পাবনার সুজানগর উপজেলায়, শতকরা ৪৯.৭৮ ভাগ। এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আব্দুল ওয়াহাব, তার প্রাপ্ত ভোট ৬২ হাজার ৭৫২। নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী শাহীনুজ্জামান পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৪৪১।
আমি ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেতে এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করার প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরি। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরার পরে তখন আমি একধরনের দোটানায় ছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। যার কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল তিনি নেই। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে আছেন, তারাও দেশে নেই। আমি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমি হাসপাতালে যাই, কাজ করি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা আমার কাছে আসতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ছাত্রলীগ ও বিএমএ’র জুনিয়র ডাক্তারদের সাথেই তখন আমার সময় কাটে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর নেতৃত্বে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আমার বাসায় আসতো। তাদের সাথে কথা বলে অন্তত পক্ষে এটা মনে হতো যে, ঠিকই দেশে ফিরেছি। কিন্তু তারপরও একটা অপূর্ণতার ভাব ছিল।
কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও তিনি কাঁদছিলেন।
আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। “বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই ও বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই ও স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।