ইনসাইড আর্টিকেল

গণভবনে পচাত্তরের মধ্য আগস্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 09/08/2018


Thumbnail

শোকের মাস আগস্ট। এই মাসেই জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীন দেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। শোকের মাসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে জাতির পিতা ও অন্যান্য শহীদদের।

এই শোকাবহ মাসে বাংলা ইনসাইডার পাঠকদের জন্য নিয়েছে বিশেষ আয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কিছু স্মরণীয় লেখা তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ থাকছে মাহবুব তালুকদার এর ‘গণভবনে পঁচাত্তরের মধ্য আগস্ট’ শিরোনামে একটি লেখা। লেখাটি নেওয়া হয়েছে রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে।

গণভবনে পচাত্তরের মধ্য আগস্ট

মাহবুব তালুকদার

আমার লেখা ‘বঙ্গভবনে ৭ বছর` বইয়ে উনিশ’ শতকের মধ্য আগস্টের ঘটনায় বর্ণনা দিয়েছি।  বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বের দিনের ঘটনাবলী তাতে স্থান পেয়েছে। মৃতুর কয়েক ঘণ্টা পূর্বে গণভবনে জাতির জনকের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাতের মুহূর্তগুলো স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। উল্লিখিত গ্রন্থে আমি যা দেখেছি, তাই লিখেছি। কিন্তু গণভবনকে কেন্দ্র করে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যা তখন ডায়রিতে লেখা হয়নি। সেসব অনুল্লিখিত তথ্য ও প্রকাশিত কিছু তথ্যের পুনরাবৃত্তি করে এই রচনা।

উনিশ শ` পঁচাত্তরের পঁচিশে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপদির দায়িত্বভাবে গ্রহণের পর আমি রাষ্ট্রপতির জনসংযোগ অফিসারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির সহকারী প্রেস-সচিবের পদে নিযুক্ত হই। আমি তৎকালে সরকারের উপসচিব থাকায় পরিবর্তিত পদবিটি উপপ্রেস সচিব না হয়ে সহকারী প্রেস সচিব হওয়ায় প্রথমে কিছুটা ম্রিয়মান ছিলাম। কিন্তু জাতির পিতার সান্নিধ্য লাভের সুযোগ আমার জন্য পরম গৌরবের বিষয় ছিল। ফলে ঐসব নেতিবাচক অনুভূতি মন থেকে উবে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি দেশের ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছি এবং ইতিহাস রচনার প্রতিটি মুহূর্তকে স্পর্শ করার সুযোগ লাভ করেছি।

পঁচাত্তরের চৌদ্দ আগস্ট দিনটি আরম্ভ হয়েছিল অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতোই। কিন্তু সন্ধ্যার পরের ঘটনাবলী মেনেই স্বাভাবিক ছিল না। সেদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু ডেকেছিলেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব তোয়াব খান ও আমাকে। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে ভাষণ দেবেন তার খসড়া তৈরির নির্দেশ  দিয়েছিলেন। আমি কিঞ্চিত বিস্মিত হয়েছিলাম, তিনি কি তাহলে লিখিত ভাষণ দেবেন? তোয়াব খান কথাটা জিজ্ঞাসা করলেন তাঁকে। তিনি বললেন, ‘লেখা বক্তৃতা পড়ব না, মুখেই বলবো। তবে হাতের কাছে লেখা সমস্ত ডাটা ও ইনফরমেশন থাকতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু গণভবনস্থ কার্যালয় থেকে মাঝে-মাঝে দুপুরে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর রোডের বাসায় যেতেন। আবার কখনও গণভবনেই দোতলার একটি কক্ষে বিশ্রাম নিতেন। ১৪ আগস্ট দুপুরে তিনি গণভবনে ছিলেন, না বাসায় গিয়েছিলেন, তা মনে নেই।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর প্রথম অনুলেখক ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী ও তোয়াব খান। তারা উভয়ে বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল থেকে উনি শ’ চুয়ান্নর নির্বাচন পর্যপ্ত আত্মজীবনীর ডিকশেন নিয়েছিলেন। এটি টাইপকৃত বাধাই অবস্থায় আমার কাছে হস্তান্তরিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পরবর্তীকালের আত্মজীবনী অনুলিখনের কাজ করছিলাম আমি। এসব কাগজপত্র আমার ব্রিফকেসে থাকত। চৌদ্দই আগস্ট বিফকেস থেকে নামিয়ে আমার অফিসের ড্রয়ারে আমি তা তালাবদ্ধ করে রাখি। ইচ্ছা ছিল, পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের পর গণভবনে ফিরে আমি। আত্মজীবনীর ভাষাগত পরিশুদ্ধির কাজ করব। কিন্তু তার আগেই ইতিহাসের নির্মম ও নৃশং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেল । ১৬ আগস্ট নিজের প্রাণবাজি রেখে পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করার জন্য আমি গণভবনে যাই। কিন্তু জনৈক মেজর ও অন্যান্য সামরিক ব্যক্তির ব্যুহ ভেদ করে আত্মজীবনীটি আমার টেবিলের তালাবদ্ধ ড্রয়ার থেকে নিয়ে আসা স্বম্ভব হয়নি। প্রাণের ভয় নয়, আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপিটি বিনষ্ট করার ভয়ে মেজরের সামনে ড্রয়ার খুলতে পারিনি। চিরদিনের মতোই জাতির এই অমূল্য সম্পদ আমি হারিয়ে ফেলি। আজও সেদিনের ব্যর্থতার গ্লানি আমাকে মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করে। আমি জানি, শত মাথা কুটলেও মানুষটিকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপিটি পাওয়া গেলে আমার শোকের সন্তাপ কিছুটা কমত।

উনিশ শ` পঁচাত্তরের চৌদ্দই আগস্ট দিনটি অন্যান্য দিনের মতো গতানুগতিক হলেও বিকাল থেকে দিনটি ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে। অনেক সময় বিকাল বেলা বঙ্গবন্ধু গণভবনের লেকে মাছগুলোকে আধার খাওয়াতেন। লেকের সিঁড়িতে তার দীর্ঘ দেহের ছায়া পড়লেই মাছের ঝাঁক ছুটে আসত খাবারের জন্য। আমাদের কয়েক জন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়াও অনেক অভ্যাগত এই দুর্লভ দৃশ্য দেখেছেন। চৌদ্দই আগস্ট বিকালে এহেন দৃশ্য দেখা যায়নি। তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিসকক্ষে ব্যস্ত ছিলেন। পরের দিন বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য চারটি স্বর্ণপদক প্রবর্তনের কথা ভেবেছিলেন তিনি। কিছু ফেলোশিপ প্রদানের কথাও ভেবেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী প্রফেসর মোজাফফর আহম চৌধুরী, উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী, শিক্ষা সচিব এম মোকাম্মেল হকের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য বিগত কয়েকদিন আলাপ-আলোচনা করেছেন তিনি।

বিকাল বেলা শিক্ষা সচিব আসবেন গণভবনে। তাঁর কাছ থেকে তথ্যাদি নিয়ে বক্তৃতার একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেস সচিব তোয়াব খান। ন তিনি। কিছু ফেলােশিপ প্রদানের কথাও ভেবেছিলেন। শিক্ষামসী জাফফর আহমদ চৌধুরী, উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী,

এম. মোকাম্মেল হকের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য মুক দিন আলাপ-আলােচনা করেছেন তিনি। বেলা শিক্ষা সচিব আসবেন গণভবনে। তার কাছ থেকে তথ্যাদি নিয়ে টি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেস সচিব । নির্ধারিত সময়ে শিক্ষা সচিবের জন্য অপেক্ষা করছি। শিক্ষা সচিব যথাসময়ে আসছেন না দেখে আমার উদ্বেগ বাড়ল। আগেভাগে তথ্যাদি না পেলে বক্তৃতার খসড়া তৈরি হবে কী করে? ইতোমধ্যে প্রেস সচিব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় জড়িয়ে গেলেন। দুঃসংবাদ এল, ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রামগতিতে ক্রাশ করেছে। তাতে কয়েক জন ১৮ সামরিক অফিসার নিহত হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের কিছুটা মতদ্বৈধতা দেখা দিল। ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন তখন দিল্লিতে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত বললেন, হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার সংবাদটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া ঠিক হবে না। তোয়াব খান বললেন, এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত জানানো হবে। বিষয়টি নিয়ে প্রেসসচিব অত্যন্ত পেরেশানিতে পড়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তার আগেই গণভবন থেকে বাসায় চলে গেছেন। চৌদ্দই আগস্ট সন্ধ্যার পরে বাসায় রওনা হন।

বঙ্গবন্ধু বাসায় চলে যাওয়ার পর-পর শিক্ষা সচিবের ফোন এল। জানালেন, অসুস্থতার জন্য তিনি গণভবনে আসতে পারছেন না। টেলিফোনে তিনি শিক্ষাখাতের ব্যয় ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কতিপয় তথ্য লিখে নিতে বললেন। টেলিফোনে ডিকটেশন নিতে-নিতে আমার উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হল।

তোয়াব খান রামগতির ঘটনা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। পরে তার মনে হল, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আসা প্রয়োজন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাসায় ফোন করলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুমি আমার অফিসে গিয়ে রেড টেলিফোনে আমাকে ফোন করো’। প্রেসসচিব বঙ্গবন্ধুর অফিসকক্ষে গিয়ে তাঁর নির্দেশ নিয়ে ফিরে এলেন। তাদের কী কথা হয়েছে আমি জানি না। কিছুক্ষণের মধ্যে ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের ফোন এল। প্রেসসচিব জানালেন দুর্ঘটনার খবরটা প্রচার করা উচিত হবে। নইলে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে।

ভারতীয় কূটনীতিক বললেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে দিল্লীর সঙ্গে কথা বলেছেন।

প্রেসসচিব জানালেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এমতাবস্থায় আমাদের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।’

প্রেসসচিব যখন বঙ্গবন্ধুর কক্ষে কথা বলতে গেছেন, ঠিক তখনই তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর টেলিফোন করলেন। রাত তখন ন`টার কাছাকাছি। টেলিফোন করলে তিনি বললেন, ‘এত রাতে কী করছ ওখানে?’

বললাম, ‘অফিসের কাজ করছি। আগামীকাল বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। তার বক্তৃতা তৈরি করছি।’

‘তোয়াব সাহেব কোথায়?’

‘তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গেছেন তার অফিসের ফোনে। আমি কি তাঁকে কোনো মেসেজ দেব?’

‘না, দরকার নেই।’ -- তাহেরউদ্দীন ঠাকুর ফোন ছেড়ে দিলেন।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন মনে করি। চৌদ্দই আগস্টের রাতে গুলশানে আরেকটি নৈশভোজের আয়োজন হয়েছিল । ঐ নৈশভোজে যোগদান করেছিলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, রাষ্ট্রপতির সচিব আবদুর রহিম এবং অন্যতম সচিব ডক্টর এম.এ. সাত্তার। উভয় সচিব গণভবনের ডিনারে আমন্ত্রিত হলেও সে রাতে তারা গুলশানে গিয়েছিলেন। প্রেস সচিবকে অবশ্য গুলশানে যেতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আমার ধারণা, তাঁরা সবাই মাহবুব আলম চাষীর গুলশানস্থ বাসভবনে আমন্ত্রণে শামিল ছিলেন। রাষ্ট্রপতির দু`জন ঘনিষ্ঠ সহযোগী তথা সচিবদ্বয়কে তার কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাই উদ্দেশেই যে ঐ কালো রাতে গুলশানে আরেকটি নৈশভোজের ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রেসসচিব তার অফিস প্রত্যাবর্তনের পর আমি নিজের অফিসকক্ষে এলাম। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তথ্যগুলো সাজাতে গলদঘর্ম হলাম। ইতোমধ্যে ডিএফআই-এর নবনিযুক্ত চিফ কর্নেল জামিল এলেন আমার কক্ষে। ঈষৎ ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘আমরা সবাই ডিনার টেবিলে বসে আছি। আপনার আর তোয়াব সাহেবের অফিসের কাজ শেষ হয় না, ব্যাপারটা কী।’

কর্নেল জামিলের সঙ্গে আমার পরিচয়, আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা নতুন বলা চলে। কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতা নিবিড় হয়ে ওঠে। আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী কর্নেল জামিলের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও ছিল। তিনি তার সামরিক জীবনের অনেক গল্প করতেন আমার কাছে। আমিও আমার অভিজ্ঞতাপ্রসূত বিভিন্ন ঘটনা শোনাতাম তাকে। তার তাগিদ পেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম এবং তোয়াব খানকে সঙ্গে করে ডিনারে যোগ দিতে এলাম। ডিনার টেবিলে আমি ও কর্নেল জামিল পাশাপাশি বসেছিলাম। আবার পুরনো দিনের গল্প জমে উঠেছিল আমাদের মধ্যে। তখন কি জানতাম মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কর্নেল জামিলকে শাহাদাত বরণ করতে হবে? চিরদিনের জন্য আমরা তাকে হারাব! শত্রুকবলিত বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন কর্নেল জামিল। জাতির পিতার জন্য আত্মাহুতি দিয়ে কর্নেল জামিল শহীদের শিরোপা লাভ করলেন।

চোদ্দই আগস্ট রাত এগারোটার পর আমি কর্মস্থল গণভবন থেকে আমার বঙ্গভবনে রওনা হই। ফার্মগেট পেরিয়ে এয়ারপোর্ট রোড ধরে যেতে গাড়ির সামনে দুটি গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে কয়েক জন বিদেশীকে কন্টিনেন্টাল হোটেলের দিকে যেতে দেখে আমি কিঞ্চিত বিস্মিত হয়েছিলাম। তে তারা কোনোরকম সঙ্কেত পেয়ে আশ্রয় লাভের জন্য অত রাতে হোটেলে গিয়েছিলেন।

মধ্যরাতে বাসায় ফিরেও আমার অনেক কাজ করার বাকি ছিল। বঙ্গবন্ধুর একটি নিজস্ব টেপ রেকর্ডার আছে। সেটি আমার কাছে থাকে। তিনি কোথাও বক্তৃতা দিলে সভা থেকে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে তাকে টেপ বাজিয়ে শোনাই। কোনো জায়গার কোনো অংশ বাদ দিতে হলে তিনি বলে দেন। আমরা সম্পাদিত অংশটুকু প্রস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টে জানিয়ে দিই। প্রতিবারের মতো সে রাতেও টেপ রেকর্ডারটি চেক করলাম, দুপুরে কেনা নতুন ব্যাটারিগুলো ভরে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দেখলাম, সব ঠিক আছে।

রাতে আবার বসলাম বক্তৃতার খসড়া নিয়ে। কয়েকটা পাতা কাটাকাটি হয়েছিল। ঐ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে দেয়া যায় না। ওগুলো ভাল করে আবার কপি করলাম। রাত প্রায় দেড়টায় আমার কাজ শেষ হল। পরদিন ভোরে ওঠার তাড়া আছে। সকাল বেলাই বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে আমাকে যেতে হবে।

পনেরোই আগস্ট প্রত্যুষে ঘুম ভাঙল এক দুঃস্বপ্ন চোখে নিয়ে। দূরে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া গেছে। কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারলাম না। এর মধ্যে টেলিফোন বেজে উঠল। আমার এক আত্মীয় ফোনে জানালেন, কারা যেন বলছে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। নিতান্ত অবিশ্বাস্য মনে হল তার কথা। রেডিও অন করে নিজের কানে সেই ভয়াবহ কথাগুলো শুনেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রথমে মনে হল, কেউ ঠাট্টা করছে। কিন্তু রেডিওতে কে ঠাট্টা করবে? কেন করবে? তা হলে যা বলা হচ্ছে তাই কি সত্যি?

আমি বঙ্গবন্ধুর টেপ রেকর্ডারটা হাতে তুলে নিলাম। ওটা বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম, ‘এ হতে পারে না। হতে পারে না।’

আজ এতদিন পরে শোকাচ্ছন্ন মনে তাকিয়ে আছি তাঁর একটি ছবির দিকে। মৃত্যুর পঁচিশ ঘণ্টা পূর্বে বঙ্গবন্ধু আমাকে তাঁর ফটোগ্রাফে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘শেখ মুজিব, ১১/৮/৭৫’ সম্ভবত এটিই তাঁর অটোগ্রাফকৃত শেষ ছবি।

আর একটি কথা। বঙ্গবন্ধুর সেই ব্যক্তিগত টেপ রেকর্ডারটি আমি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি হওয়ার পর আমাকে ফেরত দিতে হয়েছিল । কিন্তু পুরনো ক্যাসেট ফেরত না দিয়ে নতুন ক্যাসেট কিনে সরকারিভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। পুরনো ক্যাসেটগুলোতে বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ তিনটি বক্তৃতা রেকর্ড করা আছে। তাঁর বজ্রকণ্ঠ উদাত্ত কণ্ঠস্বর আগের মতোই বাজে।

[রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে নেওয়া। (পৃষ্ঠা- ৭৯ থেকে ৮৩)]


বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ/জেডএ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭