ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

ইদি আমিন: মৎস্যকূলেরও প্রভু ছিলেন যিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 31/08/2018


Thumbnail

একটি দেশের নেতৃত্বে যিনি থাকেন, তিনি দায়িত্ববান এবং ন্যায়পরায়ণ হবেন এমনটাই ভেবে থাকেন সবাই। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের নেতৃত্বে এমন অনেকেই এসেছেন যারা ছিলেন উদ্ভট বা পাগলাটে স্বভাবের। কেউ কেউ আবার তাদের নিষ্ঠুরতা ও খামখেয়ালীপনার কারণে ইতিহাসে বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত হয়ে আছেন। এরকম কিছু ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রপ্রধানের কথাই জানাবো আমরা। আজ থাকলো উগান্ডার কসাই হিসেবে খ্যাত ইদি আমিনের ইতিহাস...

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইদি আমিন দাদা। শাসক হিসেবে তিনি পাগলাটে তো বটেই, একই সঙ্গে ছিলেন বর্বরও। উগান্ডার কসাই নামে পরিচিত ইদি আমিন অশিক্ষিত ও অজ্ঞ এক বাবুর্চি থেকে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় পৌঁছেছিলেন। আট বছরের শাসনামলে কয়েক লাখ মানুষকে নির্যাতন, নির্বাসন, গুম ও হত্যা করেন এই স্বৈরাচারী একনায়ক।

ইতিহাসের অন্যতম উদ্ভট রাষ্ট্রনায়ক ইদি আমিন নিজের পরিচয় দিতেন এভাবে, ‘মহামান্য আজীবনের রাষ্ট্রপতি, ফিল্ড মার্শাল আলহাজ ড. ইদি আমিন দাদা, পৃথিবীর সকল পশু ও সমুদ্রের মৎস্যকুলের প্রভু এবং আফ্রিকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, বিশেষ করে করে উগান্ডার বিজেতা।’

রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশদের অপমানজনক আচরণের বদলা নিতে অদ্ভুত সব কান্ড ঘটিয়েছিলেন আমিন। তিনি একবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর জন্য বিশাল মাপের জুতা সরবরাহের আদেশ দেন। বিভিন্ন সময় পালকিতে করে শ্বেতাঙ্গদের ঘাড়ে চড়তেও দেখা যেত তাকে। ইরাকের ওপর মার্কিন হামলায় ক্ষুব্ধ হয়ে আমিন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশকে বক্সিং রিংয়ে নামার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। 

কথিত আছে, ইদি আমিন বিশেষ এক অভিধান তৈরি করেছিলেন। ‘ভিআইপিকে সম্মান দাও’ বলতে বোঝানো হতো তাঁকে হত্যা কর। ‘চা পান করতে দাও’ বলতে বোঝাতো তাকে বেত্রাঘাত কর। ‘তাকে ঘুমাতে নিয়ে যাও’ এর অর্থ তাকে বন্দি করে রাখো। আমিন এই বিশেষ অভিধানের মাধ্যমেই তাঁর বাহিনীর সদস্যদের কমান্ড করতেন। কথিত আছে, তিনি নাকি মানুষের রক্তও পান করতেন।

ব্যক্তিগত জীবনে বহুপত্নীক ছিলেন আমিন। ডজনখানেকের মতো বিয়ে করলেও ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় বিভিন্ন সময় পাঁচ জনকে দিয়েছিলেন ফার্স্টলেডির মর্যাদা। এদের মধ্যে তিন জনকে আবার বেতার ঘোষণার মাধ্যমে তালাকও দিয়েছিলেন আমিন। তাঁর অন্তত ৪৩ জন সন্তান ছিল বলে জানা যায়। এক সুন্দরীকে নেত্রীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সেই নেত্রী।

জার্মানির কুখ্যাত শাসক হিটলারের ভক্ত ছিলেন আমিন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘অনেকে হিটলারকে খারাপ লোক মনে করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন বীর, এজন্যই মানুষ তাঁকে স্মরণ করে।’

১৯২৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত নীল নদের পশ্চিমাঞ্চলীয় কোবোকো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন ইদি আমিন। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ওই অঞ্চলটি উগান্ডা প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। কোবোকোর ‘কাকওয়া’ নামক আদিবাসী গোষ্ঠীতে জন্ম নেওয়া আমিনের পরিবার ছিল অত্যন্ত গরীব। শৈশবেই বাবাকে হারানো আমিন বড় হয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডিটুকুও পেরিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। দুবেলা খাবার জোটাতে বাল্য বয়সেই কাজে নেমে পড়েন তিনি।

১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ কলোনিয়াল সেনাবাহিনী কিংস আফ্রিকান রাইফেলস (কেএআর) এ বাবুর্চি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আমিন। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যোদ্ধা হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। কেএআর এর সঙ্গে বার্মা, সোমালিয়া এবং কেনিয়াতেও কাজ করেছেন আমিন। কেনিয়ার ‘মাউ মাউ’ বিদ্রোহীদের ওপর চালানো ব্রিটিশদের বর্বর নির্যাতনে তিনি অংশ নেন। নিষ্ঠুর অফিসার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আমিন খুব দ্রুতই সাধারণ বাবুর্চি থেকে ‘ইফেন্ডি’ পদ লাভ করেন। সেসময় ইফেন্ডি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের জন্য সর্বোচ্চ পদ।

ইদি আমিন একজন দক্ষ বক্সার ছিলেন। পরপর ৯ বছর ‘উগান্ডা লাইট হেভিওয়েট বক্সিং’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি বক্সিং দক্ষতা তাকে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেতে সাহায্য করেছিল বলে মনে করা হয়। সাঁতারেও পারদর্শী ছিলেন আমিন।

১৯৬২ সালে উগান্ডা স্বাধীন হবার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী অ্যাপোলো মিল্টন ওবাত ইদি আমিনকে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে মনোনীত করেন। সেসময় দুটি আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে গবাদি পশু নিয়ে দাঙ্গার সৃষ্টি হলে, আমিন সেখানে আক্ষরিক অর্থেই নরবলি দেন। ব্রিটিশ সরকার তখন তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগ তুলে বিচারের দাবি জানায়। কিন্তু ওবাতের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়তে থাকায় নিষ্ঠুরতার জন্য শাস্তির পরিবর্তে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন আমিন।

বন্ধুত্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওবাতকে হটিয়ে একসময় নিজেই ক্ষমতায় বসেন আমিন। মজার ব্যাপার হলো, শুরুর দিকে ইদি আমিনকে উগান্ডার শাসনব্যবস্থায় স্বাগত জানিয়েছিল দেশটির জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ক্ষমতা দখলের পর প্রথমেই তিনি রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী ভেঙে দিয়ে নিজস্ব এক ‘কিলার’ বাহিনী গঠন করেন। সে সময় ইদি আমিনের সরাসরি নির্দেশে হত্যার শিকার হন দেশটির আর্চবিশপ, বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ বহু বুদ্ধিজীবী।

ক্ষমতা দখলের পর ইদি আমিন সম্মানজনক সব সামরিক পদক সংগ্রহ করতে শুরু করেন। বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী এবং সরকারকে ঘুষ দিয়ে বেশ কিছু পদক বাগিয়ে নিতে সক্ষমও হন তিনি। ব্রিটিশ আর্মির সর্বোচ্চ সামরিক পদক ভিক্টোরিয়া ক্রস পেতে বহু চেষ্টা চালান আমিন। এজন্য বিভিন্ন লবিস্ট ফার্মের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয়ও করেন তিনি। বারবার তিনি দাবী করতে থাকেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ আর্মির হয়ে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ঐ পদকটি তার প্রাপ্য। কিন্তু ১৯৪৬ সালে, অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বছরখানেক পর আর্মিতে যোগ দিয়ে তিনি কিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এর উত্তর কখনোই দিতে পারেননি আমিন। মজার ব্যাপার হলো, ব্রিটিশ `ভিক্টোরিয়া ক্রস` পেতে ব্যর্থ হয়ে তিনি নিজেই উগান্ডা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে `ভিক্টোরিয়াস ক্রস` নামে একটি বীরত্বসূচক পদক চালু করেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি নিজেই সেটি গ্রহণ করেন। অন্যান্য পদকের সঙ্গে সেটিও তার ইউনিফর্মে যুক্ত করতেন তিনি।

গুপ্তঘাতকের ভয়ে বারবার নিজের বাসস্থান পরিবর্তন করতেন ইদি আমিন। ১৯৭২ সালে তিনি বিভিন্ন বিদেশি জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। দেশটির সামরিক বাহিনীর অনেক উচ্চপদই ছিল ইসরায়েলিদের দখলে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সিভিল সার্ভিস উভয় ক্ষেত্রেই এশিয়ান ও ব্রিটিশদের দাপট ছিল। আমিন সেনাবাহিনী থেকে সব ইসরায়েলিদের ছাঁটাই করেন। এশিয়ান এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের তিন মাসের মধ্যে উগান্ডা ছাড়ার নির্দেশও দেন তিনি। তাদের ছেড়ে যাওয়া পদগুলো এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নিজের সমর্থকদের মধ্যে বণ্টন করেন আমিন।

দেশের অর্থনীতির দিকে কোন নজরই ছিল না স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের। দেশের যেকোনো খাতের চেয়ে সামরিক বাহিনী এবং নিজের সুরক্ষার জন্য গঠিত বিশেষ বাহিনীর পেছনেই বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে থাকেন তিনি। ১৯৭৫ সালে উগান্ডার মুদ্রাস্ফীতি এক হাজার শতাংশে পৌঁছায়।

কথিত আছে, আমিন ফ্রিজে মানুষের কাটা মাথা ও অন্যান্য অঙ্গ মজুদ রাখতেন। মানুষের মাংস খাওয়ার নেশা ছিল তাঁর। তিনি সুন্দরী মেয়েদের অপহরণ করে তাদের জীবিত কবর দিতেন কিংবা কুমিরকে খাওয়াতেন। এসব নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে ‘ম্যাড ম্যান অব আফ্রিকা’ বলা হতো।

১৯৭৯ সালে তাঞ্জানিয়া এবং আমিন বিরোধী উগান্ডার সেনারা ইদি আমিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর আরেক উদ্ভট শাসক লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচেন তিনি। সেখানে দশ বছর কাটানোর পর ১৯৮৯ সালে সৌদি আরবে চলে যান আমিন। সেখানেই ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন ‘বুচার অব উগান্ডা’ নামে কুখ্যাত এই একনায়ক।


বাংলা ইনসাইডার/এএইচসি/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭